![]() |
তখন আমি ক্লাস নাইনের ছাত্র। সুজনপুর হাইস্কুলের আনকোরা কিছু বদমাশ মুখের ভিড়ে জ্বলজ্বল করছি। কান ধরে ওঠা-বসা প্রত্যেক পিরিয়ডে নিয়ম হয়ে গেছে। নীলডাউন বাধ্যতামূলক অঙ্ক আর ইতিহাসের ক্লাসে। অসিত স্যার যখনই অ্যাটেনডেন্সের খাতা নিয়ে ইতিহাস ক্লাসে ঢোকেন আমি মনে মনে বাইরে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই। যে প্রশ্নই আমার দিকে ধেয়ে আসুক আমার কোনো টেনশন নেই। উত্তর একটাই, পারব না স্যার।
কান ধরে বারান্দায় নীলডাউন দে - পরবর্তী নির্দেশও জামা।
আমি সময় নষ্ট না করে সোজা দরজার বাইরে চলে যাই। আমি তো আর একা নই। পিছনে পিছনে রাজু, সুনীল, কালু এল বলে। ওদের ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস, পড়া ওরা কিছুতেই বলতে পারবে না। অন্যথাও হয়নি কোনোদিন।
এভাবেই দিন কাটছিল, ক্লাস চলছিল, চলছিল পড়া না-পারা আর হাঁটু ব্যথার মহড়া। আচমকাই একদিন ক্লাসে এসে জুটল কাজল। বিনা নোটিশে এল কুলটি থেকে। ওর বাবা ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন এখানে। কাজল তো প্রথম দিনেই এমন কাণ্ড করল আমরা সব ওর শিষ্য বনে গেলাম। এমন গুরুদেব পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। যে অসিত স্যারের ক্লাসে সাল-তারিখ আমরা গুলিয়ে টুলিয়ে গোবেচারা মুখে প্রতিদিন নীলডাউন দিতাম সেই স্যারের ভুঁড়িতে এসে আছড়ে পড়ল কাগজের মিসাইল। স্যার নিজের ছন্দেই পড়াচ্ছিলেন। কি ভাগ্যে আমরা তখনও ক্লাসে বসে আছি। কোনো প্রশ্নই ধরা হয়নি। স্যার বোঝাচ্ছিলেন গুপ্তযুগকে কেন সুবর্ণ যুগ বলে। সেই যুগের সব অসাধারণ শিল্প, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি ইত্যাদি। হঠাৎই নিপুন হাতের টিপে কাগজের গুলি উড়ে এসে অ্যাটাক করল স্যারের মধ্যপ্রদেশে।
এমন আচমকা দুঃসাহসে হতভম্ব অসিত স্যার আমাদের বকবেন কি হাঁ করে রইলেন বেশ খানিকক্ষণ। তারপর কাউকে কিছু না বলে ধাঁ করে ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। আমরা এ-ওর মুখ চাওয়া-চায়ি করছি। দেখি কাজল ফিক ফিক করে হাসছে।
পরেরদিন স্যারের ক্লাসে ডাক পড়ল কাজলের। আগের দিনের অভূতপূর্ব ঘটনা যে আমাদের মতো সাদামাটা বদমাশের নয় সেটা স্যার আঁচ করেছেন। স্যার যে কতটা বদমেজাজী আর পেটাবার সময় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে যান তা আমরা মোক্ষম জানি। কাজেই দুঃসাহস কে দেখাল?
এই যে ছোকরা, কী নাম তোর?
কাজল ঠাকুর, স্যার।
বাড়ি?
কাছেই স্যার।
কোন পাড়া?
আজ্ঞে এই তো কদিন এসেছি, পাড়ার নাম এখন
মুখস্ত হয়নি।
বলিস কিরে! রোজ সেখান থেকে স্কুলে আসছিস, আবার স্কুল থেকে ফিরে যাচ্ছিস, কোথায় যাচ্ছিস জানিস না?
আমি স্যার রাস্তা ঠাউরে ঠাউরে যাই, তাই ঠিক পৌঁছে যাই। নাম এখনও জানি না।
আমরা প্রমাদ শুনছি। অসিত স্যারের সঙ্গে মুখে মুখে তর্ক চালিয়ে যাচ্ছে কাজল। কি সাহস!
বাবার নাম কি? অসিত স্যারের সুর আরও খানিক চড়েছে।
কাজল মাথা চুলকোচ্ছে, কোনো উত্তর দিচ্ছে না।
কী হে এটাও কি ঠাউরে ঠাউরে বলবে? মুখস্ত নেই?
না স্যার, আসলে বাবার নামটা বললেই আরও কতকগুলো প্রশ্ন আপনি করবেন তো, তাই সেগুলো আগে ভেবে নিচ্ছি।
আচ্ছা বেয়াদব তো, বাবার নামটা বল না?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
আমাদের ভেতর সহসা একটা হাসির স্রোত বয়ে গেল। কাজলের বাবার নাম আচমকাই ওরকম শুনে বোধহয়।
অসিত স্যার মস্ত গোঁফের মাঝে হাসি আটকে বললেন, তা এতে প্রশ্নের কি আছে?
আজ্ঞে আমার বাবা কবিতা লিখেন কিনা, কটা লিখেছেন, দু-একটা যদি বলি, এইসব আর কি।
তুমি তো আচ্ছা ডেঁপো, আমি কি এসব জানতে চেয়েছি?
না স্যার, তা চাননি। তবে আগের স্কুলের সব স্যারেরা চাইতেন তো, তাই।
দেখতে দেখতে কাজলের নাম স্কুলময় ছড়িয়ে পড়ল। ক্লাস নাইনে একটা বাক্যবাগীশ বিচ্ছু ছেলে এসেছে, সামলানো দুর্দায়, স্যারেদের আলোচনাতেও একই কথা। আমাদের সঙ্গে কিন্তু কাজলের দারুণ ভাব হয়ে গেছে। ছেলেটা এমনি ভালো, শুধু আলটপকা এমন কিছু কাণ্ড ঘটায়, আগে থেকে বোঝে কার সাধ্য। তার জন্যই অবশ্য সুখ্যাতি। কিন্তু আবার এক অঘটন ঘটল অচিরেই।
স্কুলের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা চলছে। সব লেখা পরীক্ষা হয়ে গেছে। মৌখিক পরীক্ষাও শেষ। বাকি আছে শুধু শারীরশিক্ষা আর কর্মশিক্ষা পরীক্ষা। মোটাসোটা চেহারার গোপাল স্যার একই দিনে দুটো পরীক্ষা নেবেন। প্রথমে সকাল দশটা থেকে কর্মশিক্ষা তারপর শারীরশিক্ষা। পরীক্ষার দিন স্কুলের হলঘরের মাঝখানে স্যার চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে আছেন। আমরা সবাই যে যার সাধ্যমতো কর্মশিক্ষার মডেল বানিয়ে এনেছি। কেউ ঝাঁটা, কেউ কভার ফাইল, কেউ আবার মোমবাতির প্যাকেট বানিয়েছে। সবাই পৌঁছে গেছি স্কুলে। বসে আছি হল ঘরের এক কোণে। শুধু কাজলের দেখা নেই। স্যার এক এক করে নাম ডাকছেন, সে হলঘরে ঢুকে গিয়ে কি বানিয়েছে, কেন বানিয়েছে, কীভাবে বানিয়েছে এইসব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। জনা দশেকের পরীক্ষা হয়ে গেছে। তারা হলঘরের বাইরে চলে গেছে, শারীরশিক্ষা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। হঠাৎ কাজল হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির, আসব স্যার?
কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
বাচ্চা ছেলের খোঁজে বাড়ি বাড়ি ঘুরছিলাম স্যার।
কেন?
আমার মডেলটা একবার টেষ্ট করতাম।
কি মডেল বানিয়েছ?
দেখাচ্ছি স্যার।
কাজল দৌড়ে এসে স্যারের টেবিলে তার মডেলটা রাখল। একটা কাঠের বোর্ডের ওপর পিচবোর্ডের ঘর বানিয়েছে। কাঠের বোর্ডের চারিদিকে পেরেক পুঁতে তাতে সরু তার লাগিয়ে বাউন্ডারি তৈরি করেছে। আর একটা লোহার ছোটো পাত পড়ে আছে বাড়ির বাইরে। তাতে আবার একটা তার বাঁধা। তারটা বাড়ির ভেতর গিয়ে লুকিয়েছে।
কী এটা? স্যার জানতে চাইলেন।
আজ্ঞে, জল পড়লেই বাজবে।
তার মানে?
এই যে পাতটা দেখছেন স্যার, জল পরলেই বাজবে, দেখবেন স্যার?
কাজল শশব্যাস্ত হয়ে নিজের স্কুলব্যাগ খুলে ওয়াটার বোতল বের করে দুফোঁটা জল ছড়িয়ে দিল পাতটার ওপর। তৎক্ষণাৎ প্যাঁ প্যাঁ করে বাচ্চা ছেলের কান্নার আওয়াজ উঠল। আমরা সবাই হো হো করে হেসে উঠলাম।
গোপাল স্যার ধমক দিয়ে উঠলেন, চুপ কর সবাই। এটা দিয়ে কী রাজকার্য হবে বাবা কাজল?
আজ্ঞে স্যার, বাচ্চা ছেলেদের বিছানার চাদরের তলায় দিয়ে রাখলেন, বাচ্চা ওই ঘরটা নিয়ে খেলতে থাকল। এবার যদি বাচ্চাগুলো বিছানায় কিছু করে সঙ্গে সঙ্গে আমার এই সাইরেন বাজবে।
বা বা, খাসা। মেরে তোমার হাড়গোড় ভেঙ্গে দিতে হয়। ফাজলামি করতে এসেছ? বেরোও।
কর্মশিক্ষা পরীক্ষায় যা হোক করে বেঁচে গেলেও শারিশিক্ষা পরীক্ষায় কাজল আর এক কাণ্ড ঘটাল। ফাস্ট-হাফের মতো একই কায়দায় গোপাল স্যার হলঘরের মাঝে চেয়ারে বসে আছেন। সামনে শতরঞ্জি পাতা। আমরা সবাই হলঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার রোল নাম্বার ধরে ডাকলেই যার রোল নাম্বার সে ছুটে গিয়ে শতরঞ্জির ওপর বেয়াম দেখাচ্ছে। স্যার কিছু প্রশ্ন করছেন আর একটি করে দেশাত্মবোধক গান বা কবিতা বলতে বলছেন। যাদের হয়ে যাচ্ছে তারা অন্যদিকের দরজা দিয়ে বাড়ি চলে যাচ্ছে। কাজলের ডাক পড়ল সে হলঘরে ঢুকেই শতরঞ্জিতে গিয়ে শুয়ে পড়ল।
এটা কী হচ্ছে? স্যার জিজ্ঞাসা করলেন।
শবাসন করছি স্যার। এবার তো ব্যায়াম করতে বলবেন।
শবাসন ব্যায়ামের আগে নয়, পরে করতে হয়।
আগেও হয় স্যার, পরেও হয়।
হুঁ
স্যার ব্যায়াম দেখাব?
দেখাও।
কাজল শুয়ে-শুয়েই কোমরটা উচু করে তুলে ধনুরাসনের মতো কিছু একটা করল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কোমর নামিয়ে শুয়ে পড়ল। স্যার একদৃষ্টিতে ওকে দেখছেন। কোনো কথা বলছেন না। আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিতে হলঘরের বাইরে আমরা দাঁড়িয়ে আছি চুপ করে। কাজল ফট করে দাঁড়িয়ে পড়ে স্যারের সামনে এসে গড়গড় করে বলতে শুরু করল, এই আসন করলে আমাদের হজম ক্ষমতা বাড়ে, খিদে বাড়ে। পেটের পেশী শক্ত হয়।
অসহিষ্ণু গলায় স্যার বললেন, আমি কি এসব জানতে চেয়েছি?
না স্যার, এক্ষুনি চাইবেন তো।
হুঁ।
স্যার একটা গান করব?
কেন?
সবাইকে বলছেন তো।
কর। স্যারের গলায় তখন বজ্রনিনাদ। রাগে ফুঁসছেন। চোখ লাল হয়ে গেছে। খুলে রেখেছেন টেবিলে হাতের ঘড়ি।
কারার ওই লৌহকপাট বলেই, কাজল চুপ। চারিদিক গভীর নিস্তব্ধতা। নিজে নিজেদের পেটের গুড়গুড় আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি।
তারপর? স্যার গর্জে উঠলেন।
কাজল মনে হয় ভুলে গেছে। কিন্তু সে কি আর হাল ছাড়ার পাত্র। গেয়ে উঠল-
টিরিং রিং টিং টিরিং টিং
কি হল এটা কাজল?
স্যার মিউজিকটা দিলাম।
আর কোথায় যায়। এক লহমায় কাজলের মাথা টেবিলের ওপর নুইয়ে ওর পিঠে গুম গুম করে ঝরে পড়ল ভাদ্রমাসের তালের সাইজের কিল।
বাপরে, স্যার ছেড়ে দিন খুব লাগছে।
টিরিং রিং টিং টিরিং টিং। তোর মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গত করছি রে ব্যাটা, ভালো লাগছে না।
সেদিনের পরীক্ষার শেষে কাজল সেই যে বাড়ি গেল আর তার পাত্তা নেই। খবর নিয়ে জানলাম পিঠের ব্যথায় চারদিন শয্যাশায়ী ছিল। তারপর? ওর বাবা ট্রানস্ফার হননি, কিন্তু কাজলকে ট্রানস্ফার করে দিয়েছেন কোথায় জানি না।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জানুয়ারি ২০১৩
Topic : ছোটোদের হাসির গল্প, Children's Laughter story in Bengali, best Funny story for children's, story on smile for children's, ছোটোদের হাসি মজার গল্প
0 মন্তব্যসমূহ