প্রতিদিন হাওড়া থেকে সকাল ছ'টা পাঁচ মিনিটে ছাড়ে ''গণদেবতা'' এক্সপ্রেস। একটি বিখ্যাত বাংলা উপন্যাসের নামে ট্রেনটির নামকরণ করা হয়েছে। উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
তারাশঙ্কর জন্মেছিলেন বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে। হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল বেশ কিছু সম্পত্তি, বাগান, পুকুর এবং দেবালয়। তাঁরা সে যুগের জমিদার বংশ। হরিদাস ছিলেন তন্ত্রের উপাসক। কালী ও তারা মায়ের নিত্য পূজা হত বাড়িতে। হরিদাসের স্ত্রী ছিলেন প্রভাবতী দেবী। তাঁদের প্রথম পুত্রের মৃত্যু হয় খুব ছোটোবেলায়। তারা মায়ের প্রতিষ্ঠা ও পূজা শুরু হবার দশ মাস পরে আটই শ্রাবণ ১৩০৫ (২৪ জুলাই ১৮৯৮) জন্মগ্রহণ করেন মেজপুত্র। তারা মায়ের দয়ায় জন্ম হয়েছে বলে পুত্রের নাম রাখা হয় তারাশঙ্কর।
বালক তারাশঙ্করের পাঁচ বছর পর্যন্ত ছিল মানসিক করা লম্বা চুল। তার কল্যাণের জন্য বহু ধরণের মানসিক ও পুজোপাঠ করা হত। তার হাতে, গলায় ও কোমরে নানা আকারের মাদুলি তাবিজ ছিল। ধর্ম বিশ্বাসের এই আবহাওয়ায় বড়ো হয়ে উঠেছিলেন তারাশঙ্কর।
বাড়িতে বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্য গ্রন্থ ছিল প্রচুর। বাবা ও মা দুজনেই ছিলেন সাহিত্য অনুরাগী বাবা তন্ত্র শাস্ত্র পাঠ করতেন। কালিদাস থেকে শুরু করে রামায়ণ-মহাভারত, বঙ্কিমচন্দ্র পর্যন্ত পড়েছিলেন তারাশঙ্কর। এ বিষয়ে তাঁর কোনো বাছবিচার ছিল না।
১৯১৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তবে প্রবেশিকা পরীক্ষার কয়েক মাস আগে লাভপুরের জমিদারকন্যা উপার শফীর সঙ্গে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়।
মায়ের অপরিসীম প্রভাব পড়েছিল তারাশঙ্করের ওপর। তিনি বলেছিলেন, 'মা-ই আমার সত্যি সত্যিই ধরিত্রী।' বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে বাংলাদেশের প্রথম রাখি বন্ধনের দিন (৩০শে আশ্বিন ১৩১২) মা একটি রাখি তারাশঙ্করের হাতে বেঁধে মন্ত্র পড়েছিলেন 'বাংলার মাটি বাংলার জল'। এই ঘটনাটির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায় 'ধাত্রীদেবতা' উপন্যাসে। প্রচুর গল্প শুনেছেন মায়ের কাছে। মা-ই তাঁকে শিখিয়েছেন যে ভূত প্রেত বলে কিছু নেই। বাবা, মা ছাড়া তারাশংকরকে প্রভাবিত করেন তার পিসিমা শৈলজা দেবী। বাল্যবিধবা এই পিসিমাকে 'ধাত্রীমাতা' বলে চিহ্নিত করেছেন তারাশঙ্কর। পিসিমা চেয়েছিলেন তারাশঙ্কর মধ্যেও জমিদারের পৌরুষ ফুটে উঠুক। আট বছরের পিতৃহারা বালকের অভিভাবিকা হয়ে উঠেছিলেন এই পিসিমা।
জন্মস্থান লাভপুরের প্রতিটি অনু-পরমানু তারাশঙ্করের রক্তে প্রভাবিত হয়েছিল। সমাজের জমিদার শ্রেণির সঙ্গে নতুন ধনী শ্রেণির দ্বন্দ্ব তিনি নিজের চোখে দেখেছেন। তাই রূপায়িত করেছেন গল্পে, উপন্যাসে। চণ্ডীমণ্ডপের প্রসঙ্গকে ভুলতে পারেননি। আঞ্চলিক ভাষা, বেদে বেদেনীর দল, থিয়েটার রুক্ষ প্রকৃতি, বিচিত্র মানুষজন সবই বাল্য অবস্থা থেকে চোখ মেলে দেখেছেন তারাশঙ্কর।
আট বছর বয়সে কবিতা রচনার মধ্যে দিয়ে তারাশঙ্করের সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত। তিন বন্ধু খেলতে খেলতে গাছের ডাল থেকে একটি পাখির বাচ্চা পড়ে যেতে দেখেন। বাচ্চাটি মারা যাওয়ার দৃশ্য বালক তারাশঙ্করকে প্রভাবিত করেছিল। তিনি বৈঠকখানার দরজায় খড়ি দিয়ে লিখেছিলেন-
'পাখির ছানা মরে গিয়েছে
মা ডেকে ফিরে গিয়েছে
মাটির তলায় দিলাম সমাধি
আমরাও সবাই মিলিয়া কাঁদি'।
কালিন্দী, আরোগ্য নিকেতন, হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, সন্দীপন, পাঠশালা প্রভৃতি উপন্যাস রচয়িতা জলসাঘর, তারিণী মাঝি, না, তাসের ঘর, প্রভৃতি গল্পের রচয়িতা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
অসংখ্য ছোট-বড় পুরস্কারের পাশাপাশি তিনি জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ই সেপ্টেম্বর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রয়াত হন।
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭
Topic : Biography of Tarashankar Bandopadhyay, Fiction writer Tarashankar Bandopadhyay's childhood, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের জীবনী, কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের ছেলেবেলার কথা
0 মন্তব্যসমূহ