Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ।। বিধান সাহা

বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মগ্রহণ করেন হুগলি জেলার দেবানন্দপুরে। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ১৫ সেপ্টেম্বর মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও ভুবনমোহিনী দেবীর পুত্র রূপে শরৎচন্দ্রের জন্ম। শরৎচন্দ্ররা তিন ভাই ও দুই বোন। শরৎচন্দ্রের ছোটোবেলায় ডাকনাম ছিল ন্যাড়া।

শরতের পিতা মতিলাল ছিলেন অস্থির চিত্ত ও ভবঘুরে প্রকৃতির মানুষ। অল্প কিছুদিন চাকরি করা ছাড়া আর কখনো কিছুই করেননি। অভাব অনটনের জন্য বেশিরভাগ সময় স্ত্রী ও পুত্র-কন্যাদের নিয়ে ভাগলপুরে শ্বশুর বাড়িতে থাকতেন। শরতের দাদু কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি চব্বিশ পরগনার হালিশহর হলেও ভাগলপুরে কালেকটারি অফিসের কেরানি হওয়ার কারণে তিনি ভাগলপুরে সপরিবারে থাকতেন। তাই শরৎচন্দ্রের ছেলেবেলায় অনেকগুলো বছর কেটেছিল ভাগলপুরে, মামার বাড়িতে।

পাঁচবছর বয়সে দেবানন্দপুরের প্যারি পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি হন। চণ্ডীমণ্ডপে বসত পাঠশালা। যজমানির ফাঁকে দু'বেলা পাড়ার ছোটো-ছোটো ছেলে-মেয়েদের পড়া দেখিয়ে দিতেন প্যারি পণ্ডিত। মাঝেমধ্যে তামাক সেবন করা তাঁর অভ্যাস ছিল। শরৎচন্দ্র একদিন পণ্ডিতমশাইয়ের তামাক সেজে দিলেন। তামাক না দিয়ে দিলেন ইঁটের টুকরো। পণ্ডিতমশাই কিছুতেই ধোঁয়া বের করতে পারলেন না। ছাত্রদের এই কাণ্ডে ক্ষেপে গেলেন তিনি। তাঁর প্রচণ্ড ধমকানিতে ভয় পেয়ে ছাত্ররা বলে দিল শরৎচন্দ্রের নাম। শরৎচন্দ্র পাঠশালা ছেড়ে ছুট দিলেন। অন্য ছাত্ররা তাকে ধরতে ধাওয়া করল। শরৎচন্দ্র ঘাটে বাঁধা জেলের ডিঙি খুলে পালালেন। সারাটা রাত নৌকোয় কাটিয়ে দিলেন পণ্ডিতমশাইয়ের ভয়ে। এমনই ছিল তার দস্যিপনা।

পণ্ডিতমশাইয়ের পুত্র কাশিনাথ ছিল শরৎচন্দ্রের প্রধান শিষ্য। আর ছিল কালিদাসী। এই তিনজনের মধ্যে ছিল গলায় গলায় ভাব। রোজ ঝগড়াঝাটিও হত, আবার মুহূর্তের মধ্যে ভাবও হত। পাঠশালা চলার সময় আফিং খেয়ে পণ্ডিতমশাই ঝিমুতেন। এই সুযোগে শরৎ ও কালিদাসী পাঠশালা থেকে পালাতেন। বেঁচি ফল ছিল শরতের অত্যন্ত প্রিয়। কালিদাসীর উপর বেঁচি ফল সংগ্রহের ভার ছিল। সংগ্রহে টান পড়লে কালিদাসীকে চুলের মুঠি ধরে উত্তম-মধ্যম দিতেন শরৎ। তারপর আবার সোহাগের সুরে বলতেন, এই কথা দিলাম, আর কোনোদিন তোর গায়ে হাত তুলব না।

দু-তিন বছর পাঠশালায় পড়ার পর দেবানন্দপুরের বাংলা স্কুলে ভর্তি হন শরৎচন্দ্র। এখানেও বছর তিনেক পড়েন তিনি। দুরন্ত শরতের কোনো পরিবর্তন ঘটল না। এরপর দাদু শরৎকে ভাগলপুরের দুর্গাচরণ বালক বিদ্যালয়ে ছাত্রবৃত্তি শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু স্কুল পালানো শরতকে থামানো গেল না। এ বাগান সে বাগান থেকে আম, পেয়ারা, কাঁঠাল চুরি চলতেই থাকল। ছেলে-মেয়েদের বাইরে বেরোনোর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও শরৎ সেই নিষেধ মানার ছেলে ছিলেন না। এখানেও কয়েকজন সঙ্গী-সাথী জুটে গেল। যাদের নিয়ে এরপর বাগানে হানা দেওয়া তাঁর কাজ হয়ে উঠল। লুটের মাল শরৎ তার সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে ভাগ করে দিতেন। শরতের মা ছেলের সম্পর্কে বলতেন, ''ওটা ছেলে না, একটা ডাকাত''

ছাত্রবৃত্তি পাশ করে শরৎ ভাগলপুরে জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ফোর্থ ক্লাসে ওঠার পর পিতার ডিহিরির চাকরি গেল। আবার দেবানন্দপুর ফিরে আসতে হল। শরৎ হুগলি ব্রাঞ্চ স্কুলে ভর্তি হলেন। ফার্স্ট ক্লাসে পড়ার সময় অভাবের কারণে বিদ্যালয়ের মাইনে দিতে না পারায় তাঁকে পড়া ছাড়তে হয়। অভাবের কারণে আবার ভাগলপুর যেতে হয়। এবার ভর্তি হলেন ভাগলপুরের তেজনারায়ণ জুবিলি কলেজিয়েট স্কুলে। এখান থেকে ১৮৯৪ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

মেধাবী শরৎচন্দ্রের দুরন্তপনায় সকলেই অস্থির হত। এক শনিবারের বিকেলে মামা মনিলাল ও শরৎচন্দ্র থজুনীরা ক্ষেতে ভুট্টা গাছের মধ্যে দাপাদাপি করে সন্ধের আগেই বাড়িতে গিয়েছিলেন। বাড়িতে ঢুকতেই মনিলালের কপালে জুটল উত্তম-মধ্যম। শরৎচন্দ্র উধাও হলেন। এরপর তাঁকে পাওয়া গেল গোয়াল ঘরে। ছোটদির দেওয়া পেয়ারা খেয়ে সেই গোয়াল ঘরেই লুকিয়ে ছিলেন। শরৎচন্দ্র নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ''আমার শৈশব ও যৌবন ঘোর দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। অর্থের অভাবেই আমার শিক্ষা লাভের সৌভাগ্য ঘটেনি''

দুরন্ত শরৎচন্দ্র পরবর্তীকালে বাংলা সাহিত্যে এক অমর আসনে অধিষ্ঠিত হলেন। শ্রীকান্ত, বড়দিদি, গৃহদাহ প্রভৃতি উপন্যাসের স্রষ্টা শরৎচন্দ্র ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারি পরলোকগমন করেন।

 

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । মাঘ ১৪১৫

Topic : Biyography of Sharatchandra Chattapadhyay, childhood of the wise, শরৎচন্দ্রের ছেলেবেলা, কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ