কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে গণিতে অনার্স নিয়ে বি.এস.সি তে ভর্তি হলেন প্রবোধচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। কলেজ জীবনে একদিন পড়াশুনার ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল। কথায় কথায় উঠে এল সাহিত্যের কথা। সে সময়কার নামকরা পত্র-পত্রিকার কথা। এক বন্ধু বললেন যে নামকরা লেখক না হলে পত্রিকায় লেখা ছাপায় না। দু-একজন পত্রিকার সম্পাদকের নামে কিছু কটুকথাও বলে ফেললেন। এই ধরণের আলোচনা প্রবোধচন্দ্রের ভালো লাগল না। বিরক্ত হলেন তিনি। বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরলেন যে তিন মাসের মধ্যে গল্প লিখে তিনি নামকরা পত্রিকায় প্রকাশ করবেন। বন্ধুরা হেসে উড়িয়ে দিলেও দমে যাবার ছিলেন না প্রবোধচন্দ্র।
জেদ বজায় রাখতে তিনদিনের মধ্যে লিখে ফেললেন একটি গল্প। গল্পের নাম দিলেন অতসীমামী। প্রবোধচন্দ্রের ডাকনাম ছিল মানিক। গল্পের লেখক হিসেবে প্রবোধচন্দ্র না দিয়ে লিখলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। বিচিত্রা ছিল তখনকার নামকরা পত্রিকা। সেই পত্রিকার দপ্তরে গিয়ে গল্পটি দিয়ে এলেন সম্পাদকের টেবিলে। দিন কয়েক পরে সকাল বেলাতেই লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বচক্ষে দেখতে আসেন পত্রিকার সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। লেখকের হাতে গল্প প্রকাশের জন্য কুড়ি টাকা দিয়ে আরও গল্প চাইলেন।
১৩৫৫ বঙ্গাব্দের পৌষ সংখ্যা বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল অতসীমামী। প্রথম গল্পেই বিখ্যাত হয়ে গেলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। আসল নাম প্রবোধচন্দ্র গেল হারিয়ে। বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব হয়েছিল এই ভাবেই।
সাঁওতাল পরগনার দুমকা শহরে ১৯০৮ সালের ১৯ মে জন্মগ্রহণ করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। হরিহর বন্দোপাধ্যায় ও নীরদাসুন্দরী দেবীর ছিল ছয় পুত্র ও চারকন্যা। চতুর্থ পুত্র ছিল মানিক। ছোটোবেলা থেকে খুবই দুরন্ত ছিলেন মানিক। তিনি অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদ করতেন। চুপ করে থাকার ছেলে ছিলেন না তিনি। অসম্ভব জেদী ছিলেন। জেদ চাপলে যা মনে করতেন তাই করতেন। এরকম জেদ থেকেই তো গল্প লেখা ও প্রকাশের কাজটি করে দেখিয়েছিলেন।
ছোটোবেলায় একসময় মানিক ছিলেন পূর্ববঙ্গের টাঙ্গাইলে। তখন তিনি বিদ্যালয়ের ছাত্র। বাড়ির কাছেই ছিল নদী। ঘাটে আনাগোনা করত অজস্র ছোটো বড়ো নৌকা। মাঝিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলেন। তাদের তামাক ধরিয়ে দিতেন, তাদের সঙ্গে মাছের ঝোল ভাত খেতেন, কখনো বা নৌকা বাওয়ায় সহযোগিতা করতেন। এমনকি দু-তিন রাত কাটিয়েও বাড়ি ফিরেছেন। এইভাবে মাঝিদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তাদের জীবনযাত্রাকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেন। কিশোর বেলার এই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি পরবর্তীকালে পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসটি লেখেন। যা বাংলা সাহিত্যে এক বিখ্যাত গ্রন্থ হয়ে বিরাজ করছে। মাঝির ছেলে নামে মাঝি-মাল্লাদের জীবনযাত্রা নিয়ে একটি কিশোর উপন্যাস লিখেছিলেন। এটিতেও ছেলেবেলার স্মৃতি ঘুরে ফিরে এসেছে। ১৬ বছর বয়সে মানিক মেদিনীপুর থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তারপর বাঁকুড়া কলেজ থেকে আই.এস,সি পাশ করে কলকাতায় চলে আসেন।
প্রায় ২৮ বছর বাংলা সাহিত্য চর্চা করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। সাহিত্য রচনাই
ছিল তাঁর একমাত্র পেশা। এতে অবশ্য পেট ভরানো অসম্ভব ছিল। সারাটা জীবনই দারিদ্র্যের
সঙ্গে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এর মধ্যে থেকেই তিনি পুতুল নাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, শহরতলি ইত্যাদির মতো উপন্যাস সৃষ্টি করেছেন
প্রাগৈতিকারে ছোটোবকুল পুরের যাত্রী, সরীসৃপ, সমুদ্রের স্বাদ
প্রভৃতি গল্পও তাঁর কলমেই রচিত হয়েছে। ১৯৫৬ সালের ৩রা ডিসেম্বর কলকাতাতেই শেষ
নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়।
প্রকাশিত-ছেলেবেলা । শ্রাবণ ১৪১৫
Topic : মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলেবেলার কথা, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনী, Manik Bandopadhyay's childhood, Biography of Manik Bandopadhyay
0 মন্তব্যসমূহ