![]() |
শীত পড়তে না পড়তেই শীতের সরাল হাজির সাঁতরাগাছির ঝিলে। সকালে উঠেই খবরটা বলে কাগজে পড়েই বুদ্ধিমান সারস বলে, বোনু, এবার এরই মধ্যে শীতের পাখি আসতে শুরু করেছে। কাকাইকে বলে চল এই রবিবারেই সরাল পাখি দেখে আসি।
মিষ্টি মুনিয়া বলে, ঠিক বলেছিস দাদা। তারপর একটু থেমে বলে, না রে বাবাকে বলে কিছু হবে না। বাবা ও মামমাম যে জেম্মার সঙ্গে কথা বলে ঠিক বলবে, চল সবাই সাউথসিটি যাই। তারপরই পাকা বুড়ির মতো বলে, কি হবে বল, প্রতি রবিবার সাউথসিটি গিয়ে?
কিছুক্ষণ পরই মুনিয়া বলে, উপায় পেয়ে গেছি। জেঠু-জেঠু-জেঠু।
সারস বলে, ঠিক বলেছিস তো বোনু। তুই বললে বাবা ঠিকই নিয়ে যাবে।
এরপর সারস মামমামের কাছে গিয়ে বলে, মামমাম এখনও খাবার রেডি করনি? ড্রেস পড়ে আসছি। স্কুল যেতে দেরি হয়ে যাবে তো।
মামমাম চোখ কপালে তুলে অবাক হয়ে মনে মনে বলেন, কি ব্যাপার! এই একটু আগেই বলছিল আজ কিছুতেই স্কুল যাবে না আর মুনিয়ার কাছ থেকে এসেই বলে কিনা তাড়াতাড়ি খাবার রেডি কর।
দুটিতে মিলে কী ফন্দি এঁটেছে কে জানে বাবা!
সেদিন রাতে যখন মুনিয়া আর সারস টিভিতে কার্টুন দেখতে ব্যস্ত এবং বাকিরা সবাই ডাইনিং টেবিলে ডিনার নিতে বসেছে ঠিক তখনই মুনিয়া বলে, বাবা, আমরা রবিবার শীতের সরাল দেখতে যাব।
মুনিয়ার বাবা যথারীতি বলেন, না মামনি, এই রবিবার আমরা সবাই মিলে সাউথসিটি যাব। যেই না একথা বলা এ কথা বলা অমনি মুনিয়া কাঁদতে শুরু করে। ওর জেঠু তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে ওকে কোলে নিয়ে বলেন, না সোনামণি কাঁদে না। কি চাও বল?
এই সময় মুনিয়ার মামমাম চিন্ময়ী বলেন, ও দাদাভাই, ওর দুষ্টুমিতে ভুল করো না।
মুনিয়া ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, আমি আর দাদা সানডেতে পাখি দেখতে যাব।
জেঠু বলেন, কী পাখি? কোথায়? পাখির শো হচ্ছে নাকি?
মুনিয়া বলে, এ মা জেঠু কিচ্ছু জানেনা। তুমি নিউজপেপার দেখনি? সাঁতরাগাছির ঝিলে অনেক সরাল এসেছে।
সারস পাখি বলে, যাযাবর পাখি এসেছে না?
জেঠু হেসে বলেন, ওঃ তাই বল। এসব পাখিকে আর কি নামে ডাকা হয়?
এবারও বুদ্ধিমান সারস বলে, পরিযায়ী পাখি। এদিক থেকে সারসের কাকাই বলেন, ঠিক বলেছিস।
মুনিয়া বলে, জেঠু আমরা সবাই রবিবার পাখি দেখতে যাব তো?
জেঠু বলেন, ঠিক আছে আমরা এই
রবিবারেই শীতের সরাল দেখতে যাব।
কাকাই বলেন, তাই বলে কি ওই সাঁতরাগাছি যেতে হবে?
জেঠু বলেন, সাঁতরাগাছি না যেতে চাও চল, সবাই মিলে চিড়িয়াখানা যাই। ওখানে শীতের পাখিও যেমন দেখা যাবে তেমনি অন্যান্য পশুও দেখা যাবে।
সারস ও মুনিয়া আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে। ওরা বলে, পাশের ফ্লাটের খঞ্জনা আর ওপরের ফ্লাটের ফিঙেটাকেও সঙ্গে নিতে হবে। চল, ওদেরকে বলে আসি।
কাকাই বলেন, রাত হয়েছে, কাল বললেই হবে। এখন ব্রাশ করে শুতে চল।
শনিবারের বিকাল। সারসের পড়ার ঘরে ফিঙে ও খঞ্জনাও হাজির। এমন সময় ওদের কাকাই ও জেঠুর ঘরে ঢোকেন। সকলেই বলে, আমরা কখন যাব?
কাকাই বলেন, সকাল দশটার মধ্যেই আমরা রওনা হব। এই যে খঞ্জনা আর ফিঙে তোমরা কিন্তু ঠিক সময়েই মামমামদের নিয়ে চলে আসবে।
ওরা সবাই বলে, এখানে কোন কোন পাখি দেখা যাবে?
জেঠু বলেন, সাঁওতাল পরগনা থেকে আসা সরাল তো দেখা যাবে।
কাকাই বলেন, ভাগ্য ভালো থাকলে সাইবেরিয়া থেকে আসা নানারকম হাঁসের দেখাও মিলতে পারে।
একথা শুনে ওরা বলে অতদুর থেকে আসতে ওদের খুবই কষ্ট হয়। তাই না?
জেঠু বলেন, এ সব পাখি আমাদের এখানে আসার জন্য যাত্রা শুরু করার অনেক আগে থেকেই অ্যাত্ত অ্যাত্ত খাবার খেয়ে শরীরে অনেক চর্বি জমা করে, যাতে বহুদিন ধরে আকাশে ওড়ার ধকল সইতে পারে।
ফিঙে খঞ্জনা বলে, এসব পাখি যখন আকাশে উড়ে আসে তখন দেখতে তো খুব ছোটো লাগে। এরা অনেক উপহার দিয়ে যায়।
মুনিয়া বলে, এদের কী মজা তাই না সারস দাদা? ওড়ার সময় এরা চাঁদের কাছাকাছি চলে যায়, মনে হয় চাঁদের বুড়ির চরকা কাটা দেখে আসে।
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে আসে।
ফিঙে ও খঞ্জনার মামমামরা ওদেরকে নিতে আসেন। যাওয়ার সময় কাকাই বলেন, কাল কিন্তু আপনারা ওদেরকে নিয়ে সকাল সকাল চলে আসবেন।
রবিবার সকাল। এমনিতে স্কুলের দিনেও যে মুনিয়াকে ডেকে ডেকে তুলতে হয়, সেই মুনিয়াই আজ সকালে সবার আগে উঠে তার সারস
দাদাকেও ডেকে তুলে একটা হৈ চৈ কান্ড বাধিয়ে দিল।
ঠিক সকাল সাড়ে নটার মধ্যেই গাড়ি এসে হাজির। সারস সহ ওরা চারজনই দুরদার করে ছুটতে ছুটতে গিয়ে গাড়িতে সুবিধা মতো সীট নিয়ে বসে পড়ল। সারসের গলাতে ঝোলানো দূরবীনটা দেখে খঞ্জনা বলল, ওটা কী রে?
সারস বেশ ভারিক্কি চালে উত্তর দেয় বা-ই-না-কু-লা-র। শীতের সরাল দেখতে হবে না?
চিড়িয়াখানায় পৌঁছে আজ ওরা মুলোদাঁত হাতি বা লম্বা গলা জিরাফ দেখতে যায় না। সবাই একেবারে একেবারে জলাশয়ের ধারে হাজির হয়। পাখি দেখে সবার মুখেই এক কথা, কত পাখি রে? জলাশয়ের জলই যেন দেখা যায় না। শুধুই পাখির মাথা। কেউ পাখা ঝাপটাচ্ছে, কেউ জল থেকে উড়ে গাছে বসছে, কেউ অকারণেই জল ছেড়ে একটু উড়েই আবার জলেই ভাসছে। পাখির গায়ে সূর্যের আলো পড়ে নানান বর্ণের সৃষ্টি করছে। সারস চোখে বাইনাকুলার লাগিয়ে বলে, ওই দেখ, একটা ছোট্ট সরাল। কি সুন্দর দেখতে!
খঞ্জনার মামমাম বলেন, ওকে ইংরেজিতে কী বলে? ওদিক থেকে সারস বলে, লেসার হুইসলিং টিলস।
ঠিক বলেছ।
এরপর আরও অনেক রকম পাখি দেখা হল। জেঠু ও কাকাই ওদেরকে পরিচয় করিয়ে দেন পাতারি হাঁস, গিরিয়া হাঁস ও ছুঁচোলো লেজের হাঁসের সঙ্গে। এত পাখি দেখে ওরা চারজন খুবই উত্তেজিত।
দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে এল। মাঝে একবার জলাধার ধারেই মাঠে একটুখানি ফাঁকা জায়গা খুঁজে পড়ন্ত রোদ পিঠে লাগিয়ে জিরিয়ে নেওয়া, সঙ্গে চলে বাড়ি থেকে আনা ড্রাই খাবারের লাঞ্চ। তারপর একটু ঘুরে কয়েকটা পশু দেখেই যখন কাকাই বলেন, এবার ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরি হও। তখনই মুনিয়া বলে, চল তো সারস দাদা সেই ছোট্ট পিংপং সরালটাকে দেখে আসি। সঙ্গে সঙ্গেই ওরা চারজন একছুটে আবার জলার ধারে।
পড়ন্ত বেলায় জলাশয়ের জলে আর সরালের দেখা মেলেনা। গাছের ডালে দেখা যায়, তখনও কয়েকটা সরাল ঠোঁট দিয়ে পাখনার নিচের দিকটা ঠোকরাচ্ছে।
মুনিয়া দেখতে পায় তার পিমপংটা তখনও গাছের মাথায় বসে আছে। সে জেঠুকে বলে, জেঠু ওই ছোট্ট সরাল পিংপংটাকে এনে দাও না। আমি ওকে আমার পুতুল মেয়ের খেলার সাথী করব।
জেঠু বলেন, মামনি, তাহলে পিংপং-এর মামমামের মন খারাপ করবে না?
মুনিয়া কি যেন ভাবে। তারপর বলে, ঠিক বলেছ তো জেঠু। তাহলে, তুমি সামনের বছর আবার শীতের সরাল দেখতে আনবে? প্রমিস?
জেঠু বলেন, প্রমিস।
দেখতে দেখতে শেষ সরালটাও উড়ে যায়। উড়ে যায় পিংপং-ও মুনিয়া হাত নেড়ে বলে,
বাই-বাই, সী-য্যু। পিংপং তুই আবার আসিস কিন্তু।
অলংকরণ-অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জানুয়ারি ২০১৩
Topic : Environmental children's story in Bengali, Environmental kids story, birds story, The story of a little girl, The story of visiting the zoo, চিড়িয়াখানায় বেড়ানোর গল্প, পরিবেশের গল্প, পাখিদের গল্প
0 মন্তব্যসমূহ