Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

হার্ট অ্যাটাক ।। অনিন্দ্য ভুক্ত

 হার্ট অ্যাটাক ।। অনিন্দ্য ভুক্ত

বাবা বাজার থেকে ফিরলে একছুটে ঋভুর একবার বাবার কাছে যাওয়া চাই। কাজটা আগে আমিই করতাম। তারপর দুজনে। এখন সামনে মাধ্যমিক বলে আমি আর উঠি না। ঋভু এসে খবরটা দেয়।

সেদিন অবশ্য আর ঋভুকে খবরটা দিতে হল না। সদর দরজা ঠেলে বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই বাবা হাঁকাহাঁকি শুরু করে দিল, অ্যাই টুনু, অ্যাই ঋভু এদিকে আয়।

ঋভু মেঝেতে বসে দুধ-মুড়ি খাচ্ছিল। বাবার গলা শুনেই খাওয়া ফেলে উঠতে গেল। এদিকে ডাক শুনে বিছানা থেকে এক লাফ মেরেছিলাম আমিও। আর তাতেই বিছানা থেকে আমার বাড়ানো পা-টা ঠক করে লাগল ওর চাঁদিতে। অন্যদিন অন্য সময় হলে এই নিয়ে ধুন্ধুমার কান্ড লেগে যেত। কিন্তু আজ বাবার ডাকে এমন একটা জাদু ছিল যে কেউ আর দাঁড়ালাম না। এর ফয়সালাটা না হয় পরে হবে।

বাবা কলেজে পড়ায়। কলেজের সময়টুকু ছাড়া আমরা সারাক্ষণই বাবাকে পাই। বাবার কোনো আড্ডার ঠেক নেই। আড্ডার সঙ্গী আমরা তিনজন। মা আর আমরা দু-ভাইবোন। বাবা আমাদের পড়ায়, আমাদের সঙ্গে খেলে, আবার আমাদের সঙ্গে আড্ডাও মারি। বাকি সময়টা হোমিওপ্যাথির বই পড়ে আর মার সঙ্গে ফাইটিং করে কাটায়। ঋভু অবশ্য বলে মক ফাইটিং। নইলে আমাদের বকার সময় দু-জনে অমন একাট্টা হয়ে যায় কী করে?

মার সঙ্গে যাই হোক, আমরা সবসময় বাবার পিছনে ঘুরঘুর করি। বাবার ডাকে ছুটে যেতে যেতেই দেখি বাবা মাঝ-সিঁড়িতে পৌঁছে গেছে। আমদের দেখেই বলল, ঋভু এক গ্লাস জল ভর তো। শাড়িতে হাত মুছতে মুছতে মা-ও ততক্ষনে আমাদের পিছন পিছন এসে হাজির, কী গো, কী হল?

মাছ বলতে বলতে বাবা বাইরের ঘরের মেঝেতে গিয়ে বসে পড়ল। তাড়াতাড়ি ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে মা বলল, যা তো টুনু এক গ্লাস জল নিয়ে আয়। দরদর করে ঘামছিল বাবা। যা প্রচণ্ড গরম পড়েছে এবার ! দোতলায় আমাদের ঘরগুলোতে তো সকাল দশটার পর থেকে টেকাই মুশকিল হয়ে উঠেছে। বাবা সেদিন বোঝাচ্ছিল ঋভুকে, এসবই গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফল। বোঝাচ্ছিল গ্লোবাল ওয়ার্মিং কি, কেন হয়। গরম এতটা বলেই বাবা হাঁফাচ্ছে। নইলে বাবা কখনো ঘামে না। বাবা, জামাটা খুলে ফ্যালো, বলে আমি জল আনতে ছুটলাম।

ফিরে এসো দেখি গজকচ্ছপের লড়াই শুরু হব হব করছে। মা বাইরের ঘরের মেঝেতেই বাজারের ব্যাগ খালি করছে আর গজগজ করছে, তোমাকে আর বাজার যেতে হবে না বাপু। এই গরমে একগাদা বাজার নিয়ে হাজির। রাখব কোথায় এখন এগুলো আমি? বাবার ঠোঁটদুটো সবে পাল্টা দেবার জন্য খুলতে শুরু করছিল, আমি সেখানে চট করে জলের গেলাসটা গুঁজে দিলাম।

ঢকঢক করে  জলটা খেয়ে বাবা সবে গ্লাসটা মেঝেতে রেখেছে, গামলা নিয়ে ঋভু ঘরে ঢুকল। ওকে দেখেই আমার হাসি পেল। দু-হাত দিয়ে জল ভরতি গামলাটা ধরে এক পা-এক পা করে এগোচ্ছে। গামলার ভারে এতটাই নিচু হয়ে গেছে যে গামলাটা মাটি ছুঁই ছুঁই হয়ে এদিক-ওদিক দুলছে। আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। ফ্যাক করে যেই না হেসেছি ঢক করে ঋভু গামলাটা একবারে বাবার নামিয়ে রাখা গ্লাসটার ওপরই বসিয়ে দিল। গ্লাস ওলটালো, গামলা হেলে গেল, গড়িয়ে যাওয়া জলে সদ্য বার করা একটা কাঁচা লঙ্কা ভেসে গিয়ে সুরুৎ করে নর্দমা দিয়ে বেরিয়ে গেল আর বাবার প্যান্টটা পুরো জলে ভিজে গেল।

আবার একটা অট্টহাসি আমার মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঋভুর মুখ দেখে ঢোঁক করে সেটা ঘিঁটে নিলাম। ঋভু ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে। আমিও যখন সবে ভাবতে শুরু করেছি এই বাবার রামবকুনিটা বেড়িয়ে এল, তখনই দেখি বাবা নিজেই হাসতে শুরু করেছে।

বাবার হাসি দেখে ঋভুর মুখ প্রথমে উজ্জ্বল হল, তারপর হাসিতে ভরে গেল। আমারও হাসি চেপে রাখার দরকার ছিল না। আমরা তিনজনে হাসছিলাম আর মা জলের মধ্যে থেকে আনাজগুলো কুরিয়ে নিচ্ছিল। এসব ছোটোখাটো ব্যাপারে মার হাসি পায় না। আনাজগুলো জড়ো করতে করতেই মা বলল, বলতো রাস্তা দিয়ে একটা মোটা লোক যেতে যেতে হঠাৎ কলার খোসায় পিছলে পড়ে গেল, তার আগে তাকে না তুলে সবাই হেসে ফেলে কেন? মা মাঝে মাঝে এমন বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন করে। কিন্তু হাসির মুখে এমন প্রশ্ন শুনে আমাদের আরো হাসি পেয়ে গেল। আমাদের শুধু নয়, বাবাও আরো জোরে জোরে হাসতে শুরু করল। মা বিরক্ত হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আদিখ্যেতা বলে চলে গেল। আর মা চলে যেতেই বাবার টনক নড়ে উঠল, এই রে!

মাছ খেতে আমার বেজায় খারাপ লাগে। তবে অবশ্য ঋভুর মতো সব মাছ খেতে নয়। চিংড়ি, ইলিশ, ভেটকি, পমফ্রেট এসব মাছ পেলে অবশ্য আমি ম্যাগি ছেড়ে দিতেও রাজি আছি। তবে ঋভু সব মাছই খায় ঘোড়ার লেজ চিবোনোর ভঙ্গিতে।

মাছ বাবার মুখে এই একটা শব্দ শুনে অবশ্য ও ভেবেছিল বাবা অ্যাকোরিয়ামের জন্য নতুন মাছ এনেছে।

আমিও যে একেবারে ভাবিনি তা নয়, নইলে হঠাৎ বাজার থেকে ফিরে আমাদের ডাকাডাকি করবে কেন? কিন্তু এইরে বলে চেঁচিয়ে উঠে বাবা যখন বাজারের ব্যাগ থেকে মাছের ব্যাগ বের করতে শুরু করল আমাদের দুজনের মুখই ব্যাজার হয়ে গেল।

বুঝলি টুনু, চিংড়ি মাছটা তো আগে দেখতে পাইনি। এই মাছটা তাই আগে কিনে ফেলেছিলাম।

চিংড়ি মাছ আনোনি? আমার মুখটা পবননন্দনের মতো কালো হয়ে গেল। কে বলল আনিনি? তোর মা আগে নিয়ে চলে গেল দেখিস নি।

এটা তাহলে কি মাছ বাবা? ঋভুর মুখটা ফের উজ্জ্বল হয়ে উঠতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই বাবা ব্যাগটা খুলে ফেলেছে।

মাগুর মাছ।এইজন্য বাবা আমাদের ডাকাডাকি করছিল। এই মাছটার কথা তো ভুলেই গেছিলাম। কতদিন যে খাইনি। এই মাছটাই যা ঋভুরও খুব পছন্দ।

মাগুর আবার চিংড়ি আজকে ভোজটা কেমন হবে ভেবে যখন আমি উত্তেজিত হয়ে উঠতে যাচ্ছি তখনই বাবা বলল, এই মাছ দুটো কালকের জন্য জিইয়ে রাখা হবে। ঋভু যা তো বায়োকেমিকের ওষুধের বাক্সটা নিয়ে আয়।

আমি হাঁ করে গেলাম বাবার কথা শুনে। ভোজ হারানোর দুঃখ কোথায় উবে গেল। বাবা কি মাছেরও চিকিৎসা করবে!

ঋভু বাক্স নিয়ে এলে বাবা বলল, আসলে জানিস তো, এই মাছ দুটো তো আগে কিনে ফেলেছিলাম। তারপর আর মনেই ছিল না।

তাতে কি হয়েছে বাবা?

সব আনাজপত্র স্পর্শ ওদের ঘাড়ে চাপিয়েছি। আহা দেখনা বেচারারা দুর্বল হয়ে পড়েছে।

তুমি তাই ওষুধ দেবে? উজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করল ঋভু।

দিয়ে দেখি দু ডোজ ক্যালিফস।

বারে বারে, উত্তেজনায় হাততালি দিয়ে উঠল ঋভু। বাক্স থেকে নির্দিষ্ট শিশিটা খুঁজে নিয়ে বাবা চারটে দানা বের করতেই ঋভু বলে উঠল, বাবা আমি দেব, আমি দেব।

আমিও সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, না বাবা, আমি দেব। দু-জনে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে অবশ্য চারটে দানাই বাবার হাত থেকে পড়ে গেল। এই শোন, শোন করতে করতে বাবা আমাদের ছাড়াতে এলেও আমরা তখন পুরোদস্তুর লেগে পড়েছি। তুই কেন দিবি, আমি জল এনেছি। ই-ঈঃ, সে জল তো আদ্দেক উল্টে গেছে। আমি বাবাকে খাবারের জল এনে দিয়েছি।

বাবা চট করে উঠে পড়ে ড্রয়ার থেকে হুইশেলটা বের করে জোরে জোরে বাজাতে শুরু করে দিল। এই হুইশেলটা বাবার রেফারির বাঁশি। গতবছর মেলা থেকে কিনে এনেছে। আমরা ঝগড়া করতে করতে হাতাহাতি শুরু করে দিলে বাবা ফাউলের বাঁশি বাজায়। তাতেও না হলে টেনে দুজনকে ছাড়িয়ে দুজনের পায়ে ফটাস ফটাস করে দু-ঘা বসিয়ে দেয়।

আজ অবশ্য অতদূর যেতে হল না। বাঁশি বাজতেই আমরা চুপ করে গেলাম। বাবা বলল, শোন মোট চার ডোজ দিতে হবে। চার ঘণ্টা অন্তর চারটে দানা। টুনু দু-বার দিবি ঋভু দু-বার।

আমি আগে-আমি আগে। দুজনেই একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠলাম। বড়ো থেকে ছোটো, বাবা ঘোষণা করে দিতে আমরা থেমে গেলাম।

শোন ঘন্টায় ঘন্টায় জল পাল্টাতে হবে কিন্তু, বলে বাবা বাথরুমে ঢুকে পড়ল।

সারাটা দিন অতঃপর এই ভাবেই চলল। মাছগুলোও ধীরে ধীরে দিব্যি চাঙ্গা হয়ে খেলতে শুরু করেছে মনে হল। রাত্রে শুতে যাবার সময় মনটা খারাপ হয়ে গেল। কাল এদের খেয়ে ফেলব। শোবার আগে আরেকবার জল পাল্টে, ওষুধ দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

পরদিনও ঘুম ভাঙলো একটু দেরিতে। উঠে দেখি বিছানায় ঋভু নেই। ও রোজই আমার পরে ওঠে। আজ তাহলে...

মনে পড়ে গেল মাছগুলো কথা। একলাফে বিছানা থেকে নেমে বাইরে বেরোতেই দেখি বারান্দায় মাছের গামলার পাশে উবু বসে আছে বাবা আর ভাই, পাশে মা দাঁড়িয়ে। বাবা-

আমার গলায় বোধহয় কোনো বিপন্নতা ছিল। চমকে উঠে বাবা আর ভাই দু-জনেই পিছু ফিরল। আর আমাকে দেখেই ঋভু বলে উঠল, দিদি একটা মাছ মরে গেছে।

সকাল বেলায় হঠাৎ করে যেন একটা ধাক্কা খেলাম আমি। আস্তে আস্তে বাবার পাশে গিয়ে বসলাম।

বাবা কি হয়েছিল?

জল থেকে মরা মাছটা হাতে তুলতে তুলতে বিষন্ন গলায় বাবা বলল, হার্ট অ্যাটাক।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত-চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৯

Topic : ছোটোদের গল্প, মাছেদের গল্প, বিজ্ঞানের গল্প, Children's stories,  story of the fish, Science story

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ