Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ভূতের নাম ।। সুস্মিতা কুণ্ডু


 

মস্ত আতান্তরে পড়েছে ভূতেদের সরদার  মামদো ঘটাংঘট আর তার পেত্নী বউ খটখটি। মাথা চুলকে চুলকে খুলিতে গর্ত হয়ে যাবার জোগাড়। শেষমেষ ওই মানুষদের থেকে ধার নিতে হবে!

ছ্যা-ছ্যা! তাহলে যে ভূতসমাজে আর মুখ দেখানোর জো থাকবে না।

তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছো ভূতেদের আবার বিপদ কী! তারাই তো মানুষদের নাস্তানাবুদ করে বিপদে ফেলতে ওস্তাদ। আর ভূতেরা মানুষের থেকে ধারই বা কী নেবে! আরে ভূতেদের কি টাকা-পয়সা লাগে যে, মানুষের মহাজনের থেকে চড়া সুদে ধার নিতে ছুটবে! রোসো, ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি তাহলে।

ঘটাংঘট আর খটখটির তিনটি ছেলে, হাঁউ, মাঁউ, আর খাঁউ। নামগুলো শুনে মজা লাগছে তো? ভুরভুরিয়ে হাসি বেরিয়ে আসছে তো? কিন্তু ওই নামের বাহার করতে গিয়েই তো বিপদে পড়েছে ঘটাংঘট আর খটখটি? হাঁউ, মাঁউ, খাঁউ তো মানুষদের ভয় দেখিয়ে উৎপাত করে, জন্তু জানোয়ারদের লেজ টেনে সব্বাইকে তিতিবিরক্ত করে বাবা-মায়ের মুখ গর্বে উজ্জ্বল, থুক্কু থুড়ি, কালো করতে থাকে। এদিকে খটখটির মনে মনে একটা মেয়ের শখ। নিজের হাতে পাঁক আর পোড়া হাঁড়ির কালি দিয়ে রূপটান লাগাবে মেয়েকে। মাকড়সার জাল দিয়ে চুল বেঁধে দেবে। গুগলি, শামুকের চচ্চড়ি রাঁধতে শেখাবে মেয়েকে। আরো কত্ত-কী করবে! ছেলে তিনটে তো দু-দণ্ড মায়ের কাছে বসেই না।

তা মানুষ হাজার ডেকে ভগবানের সাড়া না পেলেও ভূতেরা চট করে তাদের আরাধ্য দেবতা, মানে অপদেবতা শয়তানের সাড়া পেয়ে যায়। খটখটির মনের সাধ পূর্ণ করে এক ছোট্ট দুষ্টু পেত্নী ছানা এল তার কোলে। ঘটাংঘট বললেন, মেয়ের নাম তার দাদাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে হোক- পাঁউ। না মানে একটা ফুটফুটে ঘুটঘুটে ভূতের ছানার নাম তো আর 'মানুষের গন্ধ পাঁউ' রাখা যায় না, তাই শুধু পাঁউ। চার ভাইবোন বেশ একসঙ্গে ভয় দেখাতে যাবে!

'হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ

মানুষের গন্ধ পাঁউ'

কিন্তু বাধ সাধলো খটখটি। খটখটি আসলে বেশ যাকে বলে ওই মডার্ন পেত্নী। ভূতেদের ওই নেত্যকালী, আন্নাকালী, ক্ষান্তমণি এইসব ধরণের নাম খটখটির পছন্দ নয়। নাম হতে হবে এমন যে, ভূত-ভূত ছোঁয়াও থাকবে আবার বেশ ইয়ে মানে আধুনিকও হবে। নাম শুনলেই যেন মানুষেরা ভয়ে একেবারে ভিরমি খায় এমন ধারা নাম হতে হবে। তবে না ভূতসমাজের মোড়ল বংশের মান থাকবে!

খটখটির নিজের নামের বেলায় তো আর তার কোনো হাত ছিল না! বাপ-মা যা নাম রেখেছে তাই মেনে নিতে হয়েছে। কিন্তু নিজের মেয়ের বেলায় কারো কথা শুনবে না খটখটি। এমনকি স্বামী ঘটাংঘটের কথাও না। ছেলেদের বেলায় ঘটাংঘট খটখটির কথা শোনেনি। এখন ও-ই বা পাত্তা দেবে কেন শুনি?

কিন্তু আধুনিক নাম দেব বললেই তো আর এত সহজে দেওয়া যায় না। ভূতেরা চিরকাল ওই ঘটাংঘট, খটাংখট মার্কা নাম দিয়েই অভ্যস্ত। অনেক ভেবে-ভেবে শেষে খটখটি গেল ব্রহ্মদত্যি পণ্ডিত মশাইয়ের কাছে। পণ্ডিত মশাইয়ের অনেক জ্ঞান, নিশ্চয়ই একটা উপায় বাতলাতে পারবেন। খটখটির মনের সাধ শুনে ব্রহ্মদত্যি মশাই খড়ম খটখটিয়ে, টিকি নাড়িয়ে বললেন, হুমম, মানুষরাও আজকাল অনেক অদ্ভুত-কিম্ভুত নাম রাখে বটে। ওই যে কি বলে ডিসপ্যাচ নাকি ডিসকোরানী! গাব্দাগোব্দা মোটাসোটা বই হয়। মানুষরা শুনি তো ওই থেকেই খুঁজে খুঁজে ছেলেপিলের নাম রাখে। তোমরাও তাই করো গে বরং।

খটখটি তো এই শুনে নাচতে নাচতে মহানন্দে বাড়ি এল। তারপর ঘটাংঘটকে বলল, মানুষদের বাড়িতে বাড়িতে তোমার ভূত পিশাচ অনুচরদের পাঠাও। আমার ডিসকোরানী চাই চাই চাই।

খটখটির কথা অমান্যি করে এমন সাধ্যি ভূত সরদার ঘটাংঘটেরও নেই। অগত্যা দিকে দিকে ভূত গেল। রাতের অন্ধকারে মানুষেরা যখন সবাই নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে তখন আলমারি থেকে, টেবিল থেকে, সবচেয়ে মোটা বইগুলো জানলা দিয়ে লম্বা লম্বা আঁকশি গলিয়ে, বস্তায় ভরে, তুলে আনতে লাগল ভূতের দল। এক রাতের ভেতরেই ঘটাংঘট আর খটখটির ঘর বইয়ে ভর্তি হয়ে গেল। খটখটি তো ভীষণ উত্তেজিত, মেয়ের একটা দারুণ নাম হবে বলে কথা! এদিকে উত্তেজনার বশে এটাই ভুলে গেছে সকলে যে ভূতেরা মানুষের লেখা পড়তে পারে না। কি কেলেংকারী কাণ্ড! এই এত ডিসপ্যাঁচ জোগাড় করা তাহলে বৃথা? খটখটি তো মেয়ে কোলে নিয়ে ডাক ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। ঘটাংঘট আবার বউয়ের দুঃখ সইতে পারে না। ফের শরণাপন্ন হল মুশকিল আসান ব্রহ্মদত্যির।

ব্রহ্মদত্যি বললেন, দেকো বাপু, যক পুরুতগিরি করতুম সব ওই মুকস্ত মন্ত্র পড়তুম। সংস্কৃত, বাংলা কোনোটাই ছাই আমি না পড়তে পারতুম, না লিকতে পারতুম! আর জীবদ্দশাতেই পড়াশোনা হল না, তার এই প্রেত দশায় কি আর মানুষদের পুঁথি পড়তে পারি? ঘটাংঘট বাছা, তুমি বরং এক কাজ করো, এত খেটে যকন মানুষদের বই জোগাড় করলেই তকন একটা গোটা মানুষকেই না হয় ধরে আনো। সে-ই পড়ে পড়ে বলে দেবে-খন।

ঘটাংঘট আর খটখটির বেশ পছন্দ হল বুদ্ধিটা। তিন ভাই হাঁউ, মাঁউ, খাঁউ গিয়ে অমনি ফের হানা দিল মানুষদের পাড়ায়।

মানুষদের পাঠশালার মাস্টারমশাই দিননাথ পোদ্দার মনের সুখে ছাত্র পিটিয়ে, পান্তা আলু চচ্চড়ি আর মৌরলা মাছের টক দিয়ে ডিনার সেরে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। হঠাৎই ঘুমের মধ্যে অনুভব করলেন খাটশুদ্ধ হুস হুস করে উড়ে চলেছেন। প্রথমে ভাবলেন, পান্তা ভাত আর মাছের টক খেয়ে গ্যাস অম্বল হয়েছে বুঝি, কিন্তু চোখ খুলতেই ভুল ভাঙল। মাথার ওপর টিনের চালের বদলে কালো আকাশ আর নিচে সারি সারি তাল গাছের মাথা। দিননাথ পোদ্দারকে হাঁউ, মাঁউ, খাঁউ সোজা উড়িয়ে নিয়ে এল ভূতেদের আড্ডায়। ওরা থামতে দিননাথ চোখ খুলে দেখেন, তাঁকে ঘিরে গাদা গাদা ভূত আর মোটা মোটা বই। ঠিক যেন ভূতেদের সাহিত্য সভা হচ্ছে আর তিনি যেন মধ্যমণি সভাপতি।

একটা বিকট দর্শন ভূত এসে দিননাথকে বলল, এইয়ো, মানুষ! আমি ভূতেদের সরদার ঘটাংঘট। তোমাদের ওই মোটা মোটা ডিসকোরানী পড়ে শিগগির আমার মেয়ের জন্য একটা নাম ঠিক করে দাও তো। নামটা ভৌতিকও হতে হবে আবার আধুনিকও হতে হবে। যদি তোমার দেওয়া নাম আমার গিন্নি খটখটির পছন্দ না হয় তাহলে ঘটাং করে তোমার ঘাড়টা মটকে দেব। আমার নাম এমনি-এমনি ঘটাংঘট হয়নি, বুঝলে?

সরদার ঘটাংঘটের কথা শুনে আর তার পেত্নী গিন্নি খটখটিকে দেখে দিননাথ পণ্ডিতের সত্যিই ভয়ে দাঁতে দাঁত লেগে খটখট আওয়াজ উঠতে লাগল? আর বাক্য ব্যয় না করে সামনে থেকে একটা মোটা ডিক্সেনারি টেনে নিয়ে নাম খুঁজতে শুরু করলেন। দিননাথ ভীতু হলেও মূর্খ নন, বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয় জানেন।

এক-এক করে যা চোখে পড়ছে বলতে থাকলেন। তড়কা, সুর্পনখা, হিড়িম্বা, এমনকি কদলীবালা, সবরকমই চেষ্টা করলেন। কিন্তু ঘটাংঘট আর খটখটির কোনো নামই পছন্দ হয় না। বারবার বলে, এই বইটা নয়, ওই বইটা দেখো। কিন্তু ওদের কে বোঝাবে যে সব ডিক্সেনারিই সমান। শেষমেষ এ-বই, সে-বই করতে করতে দিননাথ মাস্টারের হাতে উঠে এল একপিস কৃত্তিবাসী রামায়ণ। কোনো ব্যাটা মূর্খ ভূত বইয়ের মোটাসোটা চেহারা দেখে ডিক্সেনারি ভেবে ভুল করে আঁকশি দিয়ে রামায়ণ টেনে এনে ভরেছে বস্তায়। এই সুযোগ দিননাথ পোদ্দারের। দিননাথ উচ্চস্বরে সুর করে রামায়ণ পড়তে শুরু করলেন। প্রথমটায় ভূতেরা বুঝতে না পারলেও খানিক বাদে রামায়ণ শুনে সবার বোঁ-বোঁ করে মাথা ঘুরতে লাগল। ভিরমি খেয়ে পড়তে লাগল একে-একে।

এই, এই, একী পড়ছ, বলে খটখটি যেই না দিননাথের হাত থেকে বইটা টেনে কাড়তে গেছে অমনি কারেন্টের শক লাগার মতো ছিটকে পড়ল দশ হাত দূরে। খটখটিকে পড়ে যেতে দেখে ঘটাংঘট যেই না বইটা ধরতে এল ওরও একই দশা হল। বাবা-মার এই অবস্থা দেখে হাঁউ, মাঁউ, খাঁউ তিন ভাই এগিয়ে এল। বলাই বাহুল্য যে তাদেরও একই গতি হল। সব কঙ্কাল হাড়গোড়ে যেন ভূমিকম্পের মতো ঝাঁকুনি লাগল। ঘটাংঘট মাটিতে পড়ে কাতরাতে কাতরাতে চেঁচাতে লাগল, ওরে কে কোথায় আছিস, এই অলুক্ষণে বইসহ এই বজ্জাত মানুষটাকে শিগগির ফেরত দিয়ে আয়। নইলে আমাদের ভূত বংশ নির্বংশ করে ছাড়বে।

খাটের ওপর রামায়ণ হাতে বসা অবস্থাতেই দিননাথ পোদ্দারকে ফের হুসহুসিয়ে উড়িয়ে ভূতের দল তার বাড়িতে রেখে এল। দিননাথ হাতের রামায়ণটাকে সশ্রদ্ধায় মাথায় ঠেকিয়ে ঠাকুরের আসনের সামনে রেখে এলেন। এ যাত্রায় এই বইটাই প্রাণ বাঁচাল।

ওদিকে ঘটাংঘট একটু ধাতস্থ হয়ে উঠে গিন্নি খটখটিকে বললে, মেয়ের নাম ওই পাঁউ-ই থাকবে। ফের যদি আধুনিক নামের বায়না করেছ...

 

অলংকরণ অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । আগস্ট ২০১৯

Topic : Best ghost story in Bengali, Bangla bhooter golpo, Bengali Ghost story, bhuter golpo, ভূতের গল্প, সেরা ভূতের গল্প, জমজমাট ভূতের গল্প, বেদম হাসির ভূতের গল্প


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ