Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

কাঞ্চনমালার বিয়ে ।। সুপ্রসা রায়


 

এক ছিল রাজা আর তাঁর রূপমতী রানি। রাজপুরী সদাই গমগম। লোক-লস্কর, সৈন্য-সামন্ত ভরপুর। হাতিশালে আর ঘোড়াশালে গিয়ে দাঁড়ালে ওপার দেখা যায় না। সেখানে সারাদিন, সারারাত শুধু হাতিদের ধপাধপ আর ঘোড়াদের খটাখট। আরও যে কতরকম পশু আছে, পাখি আছে, দাসী আছে, বাগান আছে, গাছ আছে, ফল আছে, ফুল আছে তার কোনো হিসেব নেই।

তা রাজা-রানির আর কি আছে বলো তো? কী আবার রাজপুরী আলো করা, রাজা-রানির প্রাণভরা, ফুলের মতো চোখ জুড়ানো ছোট্ট রাজপুত্তুর  চম্পক কুমার।

রাজপুত্র যখন বাগানে খেলে বেড়ায়, দেখে সবাই ভাবে ওকি মানবশিশু নাকি দেবশিশু, নাকি এই বাগানের কোনো ফুল গাছ থেকে টুপ করে পড়ে খেলতে লেগেছে!

রাজপুত্র যখন সারা গায়ে জোৎস্না মেখে রাজবাড়ির ছাদে হুটোপুটি করে, তখন যারা দেখে তারা ভাবে এ কি সত্যিই আমাদের চম্পক কুমার, নাকি চাঁদের কিরণ দিয়ে আঁকা কোনো ছবি!

এমনিভাবে চাঁদের কিরণ আর ফুলের সৌরভ মেখে দিনে-দিনে বেড়ে উঠতে লাগল চম্পক কুমার। দেখতে দেখতে বারো বছর বয়স হল তার। একদিন রাজপুরী গমগম, রাজসভা রমরম, দুয়ারে দ্বারির কোমরে তলোয়ার ঝনঝন। হঠাৎ রাজকুমার এসে আর্জি জানাল, মহারাজ, আমি শিকারে যেতে চাই, অনুমতি দিন।

শুনেই সেখানকার সব শব্দ থেমে গেল। মুখের কথা হারিয়ে গেল মুখে। সিংহাসনে বসে ঘামতে লাগলেন রাজামশাই। ফ্যাকাসে হয়ে গেল তার চোখ-মুখ। অধৈর্য হয়ে চম্পক কুমার আবার বলে, কি হল  পিতা, অনুমতি দিন।

রাজামশাই কথা বলবেন কি, ভয়ে-ভাবনায় তাঁর গলা দিয়ে তো শব্দই বেরচ্ছে না। তখন বৃদ্ধ মন্ত্রীমশাই এগিয়ে এলেন। তিনি বিচক্ষণ মানুষ। তাঁর ওপর রাজামশাইয়ের খুব ভরসা। তিনি রাজকুমারের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, রাজকুমার, এখনও তো তুমি বালক।  বনে কতরকমের বিপদ। হিংস্র প্রাণী আছে, রাক্ষস-রাক্ষসীদৈত্যি-দানো ওত পেতে বসে আছে ছোটো ছেলেদের খাবে বলে। তুমি সেসব সামলাবে কী করে?

শুনে তো রাজকুমারের মানে লাগল খুব। মাটিতে জোরে-জোরে পা ঠুকে রাগি গলায় বলে উঠল, বারো বৎসর বয়স আমার। মায়ের আঁচলের তলায় আর দাস-দাসীদের পাহারায় থাকতে মন চায় না। আমি রাজার ছেলে। বীরের মতো কোনো কাজ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে চাই।

এইভাবে চলল অনেক কথার ঠেলাঠেলি, অনেক সাধাসাধি, মান-অভিমান। অন্তঃপুরে খবর গেল। সখীদের সঙ্গে নিয়ে ছুটে এলেন রানি মা। কিন্তু রাজপুত্র যেন কারো কথা শুনবে না বলে পণ করেছে। বুক টান করে সে বলল, শিকারে যাবার অনুমতি না পেলে আমার যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব।

কি আর করা। রাজা-রানি হার মানলেন রাজকুমারের জেদের কাছে। তবে, একা ছাড়লেন না। মন্ত্রীপুত্রকেও সঙ্গে নিতে বললেন। চম্পক কুমার এতে খুশি হল। একজন কথা বলার লোক তো সঙ্গে থাকল। শুভ দিনক্ষণ দেখে লোকলস্কর, অস্ত্ররশস্ত্রর নিয়ে গুরুজনদের প্রণাম করে চম্পক কুমার চলল শিকারে। সঙ্গে মন্ত্রীপুত্র।

গভীর বনে ঢুকে প্রচুর পাখি, খরগোশ, বনমুরগি ইত্যাদি শিকার করল রাজকুমার। অবশ্য সবগুলোই যে সে মারল তা নয়।  যারা সঙ্গে ছিল তারাও তো কিছু-কিছু শিকার করল। তারপর একটা ফাঁকা জায়গায় তাঁবু খাটানো হল। সন্ধে হতে না হতেই রাজকুমারের চোখ ঢুলুঢুলু। এত পরিশ্রম করা অভ্যেস তো নেই। কাজেই তাঁবুর নিচে পরিপাটি বিছানা পাতার সঙ্গে-সঙ্গেই তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

এদিকে হয়েছে কি, সেই সময় দুই পরি বোন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছিল। তাদের নাম ঘুমপরি আর নিঝুমপরি। ভাসতে-ভাসতে এদিক-ওদিক চাইতে-চাইতে হঠাৎ চম্পক কুমারের ওপর চোখ পড়ল ওদের। দেখে তো তারা চমকে উঠেছে। নিঝুমপরি ফিসফিসিয়ে ঘুমপরিকে বলল, বোন, রোজই তো এখান দিয়ে যাই, এমন হীরের টুকরো তো আগে দেখিনি! বোন বলে, শুধু হীরে নয় গো দিদি। সব মণি-মাণিক্য, স্বর্গপুরীর বাগানের সব ফুল, চাঁদের আলোর সঙ্গে মিলেমিশে যেন সৃষ্টি হয়েছে এই ছেলের। দেখে-দেখে দু'বোনের আর আশ মেটে না। ঘুমপরি বলে, দিদি গো এমন রূপকুমারের যোগ্য সুন্দর বউ কি ধরাধামে আছে?

আছে বোন, আছে। পুষ্পক নগরের রাজকন্যা কাঞ্চনমালা। দুজনকে পাশাপাশি দেখলে, কে বেশি সুন্দর তাই নিয়ে তর্ক বাধবে।

তাই বুঝি! তবে এসো দিদি, আজই সৌন্দর্যের লড়াই দেখে চোখ সার্থক করি।

এই না বলে যেখানে যত অনুচর রাত জেগে পাহারা দিচ্ছিল তাদের সকলের চোখে বেশি-বেশি ঘুম ঢেলে দিল ঘুমপরি। তারপর সোনা-মণি-মুক্তোর কাজ করা মখমলের চাদর শুদ্ধ ঘুমন্ত রাজকুমারকে তুলে নিয়ে হুশ করে আকাশে উড়ল দুই পরি। তারপর নিমেষের মধ্যে হাজির হল পুষ্পক নগরে, একবারে রাজকন্যা কাঞ্চনমালার শোবার ঘরে। পাশাপাশি দুজনকে রেখে নয়ন ভরে দেখতে লাগল দু-বোন। নিঝুমপরি বলল, এদের দুজনের ভাগ্যে দুজনের দেখা হওয়া লেখা আছে কিনা কে জানে!

ঘুমপরি চোখ নাচিয়ে বলল, ভাগ্যের ভরসায় না থেকে এসো না, আজই দুজনের  বিয়ে দিয়ে দিই।

যেমন কথা, তেমনি কাজ। ঘুমপরি তার ডানার পালক বুলিয়ে রাজপুরীর সকলের ঘুম ভাঙিয়ে দিল। রাজকন্যা চোখ খুলে ভাবল, একী! এত বেলা হয়ে গেছে! দিনের আলোয় ভরে গেছে ঘর! সখীরা এতক্ষণ ডাকেনি কেন! সুখ-সারিই বা ভোরের বেলায় গান গায়নি কেন!

রাজপুত্র ঘুম ভেঙে হাঁকডাক করে অনুচরদের ডাকতে লাগল, আমার পোশাক দাও, ঢাল-তলোয়ার দাও, শিকারে যাবার সময় হল।

আর সখি-দাসীরা? তাদের কথা আর না বলাই ভালো। তারা তো দুজনকে দেখছে আর ভাবছে, ঊষাকালের আলো আর চাঁদের কিরণ পাশাপাশি থাকে কি করে! যাইহোক, ধীরে-ধীরে সকলে ধাতস্থ হল। উল্লাসে হইহই করে উঠল সকলে। আসলে হয়েছে কি, পুষ্পকরাজ অনেকদিন ধরেই কাঞ্চনমালার বিয়ের চেষ্টা করছেন। কিন্তু রাজকুমার আর পছন্দ হয় না কাউকে। কতশত রাজ্যের রাজকুমার সেজেগুজে, নানা উপহার নিয়ে আসে। কিন্তু রাজকুমারী সকলকেই ফিরিয়ে দেয়। রূপের পরীক্ষায় হার মেনে যায় সকলে। এই প্রথম একজনকে পাওয়া গেল, যাকে দেখে সখীরা বুঝে উঠতে পারছে না কে বেশি সুন্দর। এই ভিনদেশি কুমার, নাকি তাদের রাজকন্যা। তারাও দুজনে-দুজনকে দেখছে মুগ্ধ হয়ে। সখীরা বিয়ের প্রস্তাব দিতেই লজ্জায় চোখ নামাল দুজনে।

খবর পেয়ে ছুটে এলেন রাজা-রানি, রাজপুরোহিত, মন্ত্রী, সেনাপতি সবাই। সেই রাতেই বিয়ে হয়ে গেল চম্পক কুমার আর কাঞ্চনমালার।

এদিকে, বনের ভিতর সারি-সারি তাঁবুতে ঘুম ভাঙছে মন্ত্রীপুত্র ও অন্যান্য অনুচরদের। কিন্তু একী! রাজকুমারের বিছানা খালি কেন! সাতসকালে কোথায় গেল সে! তবে কি সে আজ একাই শিকারে চলে গেল! কিন্তু তাই বা কি করে হবে! ওই তো রাজকুমারের শিকারের পোশাক, অস্ত্রশস্ত্র সব যেমনকে তেমনই পড়ে আছে। খোঁজ-খোঁজ-খোঁজ। কাছে-পিঠে, জঙ্গলের ভিতর পর্যন্ত খুঁজে এল সবাই। রাজকুমার কোথাও নেই। মন্ত্রীপুত্রের তো মাথায় হাত। হায়-হায় কী করে মহারাজা আর রানি মার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সে। তাঁরা যে ওর ভরসাতেই রাজকুমারকে ছেড়েছিলেন। সারাদিন কেটে সন্ধে হয়ে গেল। কোনো তাঁবুতে আলো জ্বলল না। দুশ্চিন্তায় সকলের মন খারাপ। আলো-টালো জ্বালানোর কথা কি আর মনে থাকে। কাজেই, অন্ধকার জঙ্গলে, খিদে-তেষ্টা ভুলে, বসে-বসে মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল ওরা। সময় যত গড়ায়, অন্ধকার ততই গাঢ় হয়। একসময় তো এমন হল যে, পাশের লোককেও দেখা যাচ্ছে না। শুধুই হুস-হাস ভেসে বেড়াচ্ছে দীর্ঘশ্বাস।

এমন সময় হঠাৎ... একী! রাতের বেলাতে আকাশে সূর্য উঠল নাকি! না, শুধু সূর্য না, চাঁদের আলোতেও তো ঝলমল করছে চারধার। কী হল! কি হল! সবাই তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল। ওমা! এ তো দেখি আমাদের রাজপুত্র! সঙ্গে বৌরানিও আছে। দুজনের রূপের আলোয় ভরে গেছে চারপাশটা।

সেই রাতে তাঁবুতে উৎসব সেরে, পরদিন সকালেই বাড়ির দিকে রওনা হল তারা। হাতি-ঘোড়া, লোকলস্কর, বাজনাদার, অনুচর, অস্ত্রশস্ত্র সব নিয়ে ফিরতি যাত্রা। রাজপ্রাসাদের দুয়ারে ডঙ্কা বাজল। রাজা-রানি, দাস-দাসী, সভাসদরা ছুটল সিংহদুয়ারে। ঘোড়া থেকে নেমে বাবা মাকে প্রণাম করল রাজকুমার। রাণিমা তাকে বুকে জড়িয়ে অনেক আদর করে শুধোলেন, কি শিকার করে আনলে বাছা?

রাজকুমার মিটিমিটি হেসে সোনার পালকির সামনে মাকে নিয়ে এল। পালকির দরজা খুলে তো রানির মায়ের মূর্চ্ছা যাবার জোগাড়। জঙ্গলের মরা পশু-পাখি তো এ নয়! এ যে লক্ষ্য মানিক, হাজার তারা, শত সূর্যের মিলিত আলো! সোনার পালকি থেকে নেমে এল রূপের ডালি। বৌরানি কাঞ্চনমালাকে বুকে করে ঘরে নিয়ে এলেন রানিমা। আলোয়-আলোয় ভরে গেল রাজপ্রাসাদ। মনে হল যত ঘন অন্ধকারই আসুক না কেন, রাজপ্রাসাদের কোথাও তার ছায়াটুকুও থাকবে না।

এরপরে চম্পক কুমার আর কখনও শিকারে যাবার বায়না করেনি।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১১

Topic : Fairy tales in Bengali, রূপকথার গল্প, best Fairy tales in Bengali, Raja Ranir golpo, Rajkumar Rajputrar gplpo, porir golpo, Champak Kumar ar Kanchanmalar golpo


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ