Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

কবুতরখানা ।। শর্মিষ্ঠা ব্যানার্জি


তখন বুঝলি সবে চাকরিটা পেয়েছি। শেয়ালদায় অফিস, কাজেকাজেই কলেজ স্ট্রীটের নবীন কুণ্ডু লেনের গলির মধ্যে শঙ্কর চাটু্জ্যের মেস বাড়িতেই ঘাঁটি গাড়লাম। ছোটোদাদু চায়ের কাপে সুরুৎ করে চুমুক দিতে গিয়ে থামল একটু। আমরাও দাদুর মুখের দিকে বাকিটুকু শোনার জন্য হাঁ করে রইলাম। ছোটোদাদু হল আমার দাদুর নিজের ছোটো ভাই। থাকেন বরানগরের এক আশ্রমে। মাঝে-মাঝে আমাদের আসানসোলের বাড়িতে ঘুরতে আসেন। আর এলেই জমিয়ে গপ্পো আর খাওয়া-দাওয়া।

আমার নিজের দাদু সেই কবেই মারা গেছেন। তাই দাদু বলতে ছোটোদাদুই আমাদের সব। বাবা-কাকাদের নিজের হাতে মানুষ করেছেন, লেখাপড়া করিয়েছেন। ঠাম্মার অমন বিপদের দিনে ঠাম্মার বড়ো ছেলের মতো হয়ে পুরো সংসারের হাল ধরতে গিয়ে তাঁর নিজের আর সংসার করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু চাকরি থেকে রিটায়ার্ড হয়েও তিনি বাবাদের অনুরোধ সত্বেও আসানসোলের বাড়িতে এসে থাকেন না। তাঁর মতে কলকাতার জল একবার যার পেটে পড়ে তার কলকাতাকে ছেড়ে থাকা মুশকিল। তাই তাঁর এখনকার ঠিকানা বরানগরের এক সেবাশ্রম। সেখানে থেকেই ছোটোদাদু নানা সমাজসেবা মূলক কাজকর্ম করেন, এবং সেটা করে তিনি খুব খুশিতেই থাকেন। শুধু মাঝে-মাঝে সেই আশ্রম থেকে ছুটি নিয়ে হাজির হন আসানসোলে পুরানো পৈতৃক বাড়িতে। আর এলেই আনেন বাক্স ভর্তি ডেয়ারিমিল্ক চকলেট আর ঝুলি ভর্তি গল্প। যা তিনি অকাতরে বিলি করেন নাতি-নাতনিদের কাছে, মানে আমাদের কাছে।

চায়ের লাস্ট চুমুকটা দিয়ে ঠক করে কাপ নামিয়ে রেখে ছোটোদাদু আবার শুরু করলেন, মেসবাড়িটা বেশ পুরনো বুঝলি। বড়ো দোতলা বাড়ি টানা বারান্দা। উঠোনে কলঘর আর চৌবাচ্চা। তবে সবচেয়ে সুন্দর ছিল মেসবাড়ির লম্বা ছাদখানা। ওই ছাদটাই মেসবাড়ির আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হয়ে উঠল বুঝলি। উত্তর কলকাতা চিরকালই বড্ড ঘিঞ্জি। বাড়ির গায়ে বাড়ি, ছাদের সঙ্গে ছাদ লাগা। এর বাড়ির রান্নার ফোঁড়নের গন্ধ ওর বাড়ি যায়। ছাদটাই ছিল যেন দম ফেলার জায়গা।

ছাদে ছিল একটা পুরনো অফিস ঘর, সেটা তালা বন্ধ হয়েই পড়েছিল। তার পাশেই একটা পুরনো ঘর, তো সেই ঘরেই চৌকি পেতে আমার শোয়ার ব্যবস্থা হল। মেসের আর কোথাও সিট খালি ছিল না। তবে শঙ্করবাবু তিন মাস বাদে একজন বোর্ডার চলে গেলে নিচে আমার জায়গা হবে এই আশ্বাস দেওয়াতে আমি ছাদের ঘরেই সেঁধিয়ে গেলাম।

মেসে গিয়েই, দোতলার একজন বোর্ডার সুনীতি মুখুজ্যের সঙ্গে খুব জমে গেল। ছেলেটার বর্ধমানের দিকে বাড়ি, কস্টিং পড়তে এসেছে কলকাতায়। আমার চেয়ে বছর দু-তিনের ছোটো। কিন্তু ভারি ছেলেমানুষ আর সরল ছেলেটা। কলকাতায় নতুন চাকরি, রোজ সকালে খাই-দাই অফিস করি। বিকেলে মেসের দোতলায় সুনীতিদের কল ব্রিজের আড্ডাতে তাস পেটাই আর রাতে সারাদিনের ক্লান্তিভরা দেহ বিছানায় এলিয়ে দিই। শুক্রবার অফিস থেকেই সোজা হাওড়া স্টেশন যাই আর ট্রেন ধরে সোজা আসানসোলের বাড়ি।

এমন ভাবে সপ্তাহ দুই বেশ কেটে গেল। সেদিন ছিল বিশ্বকর্মা পুজো। মেস বাড়ি পুরো ফাঁকা, শঙ্করবাবুর দেশে গেছেন বাড়িতে অরন্ধনের অনুষ্ঠান আছে বলে। বেশিরভাগ লোকেরই আজ ছুটি, তাই সবাই যে যার নিজের বাড়ি ফিরে গেছে। মেসে শুধু আমি, সুনীতি আর দু-একজন বোর্ডার। সঙ্গে উড়ে রাঁধুনি রাজেন, আর দারোয়ানটা।

অফিসে আজ বিশ্বকর্মা পুজোর ছুটি থাকায় অফিস যাইনি। পরেরদিন শুক্রবার, অফিস যেতে হবে। সুনীতিরও সামনের সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা শুরু তাই সেও বাড়ি যায়নি। বেলা এগারোটা-বারোটা নাগাদ সুনীতি ছাদে এসে দরজার কাছে হাঁকাহাঁকি করতে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি ছেলেটার হাতে একরাশ ঘুড়ি। সঙ্গে লাটাই আর মাঞ্জা দেওয়া সুতো। আমাকে দেখেই হেসে বলল, কি ভবানীদা ঘুড়ি ওড়াবে?

ওর ছেলেমানুষি দেখে হেসে ফেললাম। সে কোন ছেলেবেলায় ঘুড়ি ওড়াতাম। বিশ্বকর্মা পূজোর দিনের আকাশ এমনিতেই নানা রং বেরংয়ের ঘুড়িতে ছেয়ে গেছে, আশেপাশের প্রত্যেকটা বাড়ির ছেলেদের হাতে লাটাই আর মাঝে মাঝেই ভোকাট্টা আওয়াজ সাড়া পাড়া জুড়ে।

সুনীতির সঙ্গে আমিও বিকেল অব্দি ঘুড়ি ওড়ালাম। বেশ ভালোই লাগছিল বুঝলি। রাতের দিকে তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কিন্তু এপাশ-ওপাশ করতে-করতেও যখন ঘুম এল না তখন মাথার পাশের টেবিলে ল্যাম্প ছেলে শ্রীকান্তটা পড়ব বলে টেনে নিলাম। বেশ অনেকটা পড়ে ফেলেছি। বলতে গেলে পড়তে-পড়তে বইয়ের মধ্যে ডুবে গেছি। এমন সময় আমার পাশের ঘরে খরড়-মড় ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম একি রে বাবা এই রাত দুপুরে এসব কিসের আওয়াজ। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম। চারপাশ এতটাই নিস্তব্ধ যে, নিজের হাত-ঘড়ির টিকটিক আওয়াজে যেন কানে শুনতে পাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পর আবার সেই আওয়াজ পেলাম। এবার বেশ জোরে, আর আওয়াজটা যে আমার পাশের বন্ধ ঘরটা থেকেই আসছে সেটা বেশ বুঝতে পারলাম। ডানার ঝাপা দিয়ে-দিয়ে কেউ যেন দরজাটা ক্রমাগত ঠেলছে, পারলে হয়তো ভেঙে ফেলবে এত তার গায়ের জোর।

এবার ভয় পেয়ে গেলাম বুঝলি। বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম ছাদে। আমার ঘরের আলোটাই বেঁকে এসে পড়ে ছাদের কিছু অংশ আলোকিত হয়েছে। তাতেই যা দেখলাম, দেখে শিউরে উঠলাম। পাশের ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা, সারা ঘর জুড়ে পায়রার খোপ করা, সবগুলোই খালি। তবুও প্রতিটা ক্ষোভ থেকে অদৃশ্য অনেকগুলো পায়রা যেন ডানা ঝাপটে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি, ছটফট করছে। তারা যেন মৃত্যুযন্ত্রণায় বেরিয়ে আসতে চাইছে ক্ষোভের মুখে আটা জাল ছিঁড়ে।

কতক্ষণ ছিলাম ওখানে জানি না, কিন্তু বিশ্বাস কর ভয় পাওয়ার চেয়ে মনটা হঠাৎ বড্ড খারাপ হয়ে গেল। কি যে হঠাৎ হল তখন, দৌড়ে গিয়ে পাগলের মতো প্রতিটা খোপের দরজা টেনে-টেনে খুলে দিলাম। সেই মুহূর্তে মনে হল, একটা দমকা হাওয়া যেন সারা ঘরে পাক খেয়ে-খেয়ে বেড়াচ্ছে। আর আচমকাই আমার ঘুমটাও গেল ভেঙে।

তারপর?

দমবন্ধ করে এতক্ষণ ছোটোদাদুর মুখে গল্প শুনছিলাম আমরা, ছোটোদাদু থামতে তাই আমরা অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলাম।

ঘুম ভাঙল যখন আমি কিন্তু বিছানাতেই ছিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানিস, আমি ওই ঘর থেকে কখন ফিরলাম নিজের ঘরে কখন বিছানায় শুলাম কিছুই মনে পড়ছিল না। আরও অবাক কাণ্ড যে রাতেরবেলায় আমার পাশের ঘরটা যে খোলা দেখেছিলাম সেটা কিন্তু দিনেরবেলায় বন্ধই ছিল। খুব অদ্ভুত লাগল ব্যাপারটা। আমি যে স্বপ্ন দেখেছি সেটাই মেনে নিলাম। কিন্তু এমন স্বপ্ন দেখলামই বা কেন? মনে কৌতুহলটা চেপে রাখলাম। শঙ্করবাবু ফিরে আসা পর্যন্ত ওই ঘরে কি আছে সেটা জানার জন্য মরিয়া হয়ে ছিলাম।

শঙ্করবাবু মেসে ফিরতেই আসল রহস্যটা খোলসা হল। শংকরবাবুর খুব পায়রা পোষার সখ ছিল একসময়। ছাদের এই ঘরে তাই কবুতরখানা খুলে তিনি পুষে ছিলেন একদল সাদা গোলা পায়রা। পায়রাগুলো ছিল তার প্রাণ। নিজের হাতে সকালে দানা পানি খাইয়ে খোলা আকাশে উড়িয়ে দিতেন। সারাদিন পর সন্ধ্বেবেলায় পায়রার দল উড়ে ঠিক ফিরে আসতো নিজেদের কবুতরখানাতে।

বিশ্বকর্মা পুজোর দিনে পাশের ছাদের কতগুলো ছেলের ঘুড়ির মাঞ্জা গলায় জড়িয়ে শঙ্করবাবুর দুটো পায়রা মারা যায়। রেগে গিয়ে শঙ্করবাবু তাদের গালে চড় মেরে ঘুড়ি লাটাই কেড়ে নেন। আর সেই অপমানের বদলা নেওয়ার জন্য বদমাশ ছেলেগুলো কখন যে ফাঁকতালে এসে শঙ্করবাবুর মেসবাড়ির ছাদে কবুতর খানায় ঢুকে পায়রার জলে বিষ মিশিয়ে দেয় তা কেউ টের পায়নি। বিকেলে ফিরে সেই জল মুখে দিতেই যা হবার তাই হয়। এক ধাক্কায় সবকটা পায়রা রাতারাতি ওই বিষয়ে এই ছটপট করতে করতে মারা যায়। যেহেতু কেউ দেখেনি কাজটা কে করেছে, তাই শঙ্করবাবু কাউকে এর জন্য কিছু বলতেও পারে নি। প্রায় বছর পাঁচেক হয়ে গেছে ঘটনাটার। মনের দুঃখে তাই শঙ্করবাবু এই ঘরটায় তালা মেরে রেখে দিয়েছেন। ঘরটা এখন কেমন দেখতে যাওয়া, ঘরটা খুলতেই আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার স্বপ্নে দেখা হুবহু এক ঘর ঠিক সেই সময়ই শুনলাম শঙ্করবাবুর কথাটা। আরে আমি তো পায়রার খোপের দরজাগুলো বন্ধ করে রেখেছিলাম, এগুলো খুলল কে?

তারপর, আরো দু-মাস আমি ছাদের ঘরে ছিলাম। কিন্তু ওই রকম ঘটনা আর কোনোদিন ঘটেনি বুঝলি। তবু আজও মাঝে-মাঝে ভাবি সেদিন রাতে যা দেখেছিলাম সেটা স্বপ্ন ছিল না সত্যিই! আর পায়রার খোপের দরজাগুলোই বা কে খুলেছিল? তবে কি বিষের জ্বালায় অস্থির পাখিগুলোই কি মুক্তি পেতে চেয়েছিল সেই রাতে!

ছোটোদাদু একটু থামলেন, তাই তোদের বলি তোরা খেলাধুলো সব কর, কিন্তু তাতে কোনো পশুপাখির ক্ষতি যেন না হয়। সবসময় মনে রাখবি, পশুপাখিরাও কিন্তু আমাদের বন্ধু। তাই নিজেরা মজা পাব ভেবে কখনোই কিন্তু কোনো পশু পাখির ক্ষতি করে বসিস না।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । জুন ২০১৯

Topic : Best ghost story in Bengali, Children's ghost story, Popular ghost story, Peason's story, Grandpa's story, Pigeon house's story, ভৌতিক গল্প, ভূতের গল্প


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ