![]() |
রূপকথার দেশে যাবে? বেশ তো, চিন্তার কী আছে? আমার ডানায় চেপে বসো, আমি তোমাকে রূপকথার দেশে নিয়ে যাব।
সত্যি বলছো? দু-চোখে অপার বিস্ময় মাখিয়ে বলল টুকুন।
হ্যাঁ। এতে মিথ্যের কী আছে? আমি তো ওদেশে রোজই একবার করে যাই। আহা, যা সুন্দর দেশ! ওখানে না গেলে যে আমার রাত্তিরে ঘুমই আসবে না। কালই তো আমার ছোট্ট দিন-দশেকের ছানাটাকেও নিয়ে গেলাম সেখানে।
ওমা, তাই নাকি?
হ্যাঁ, বলেই ফিক করে হাসল বড়ো শালিক।
আর দেরি করল না টুকুন। খাতা-বই-পেন্সিল সব ব্যাগে ঢুকিয়ে শালিকের সঙ্গে এক পলকে হাওয়া।
আসলে গতকাল রাত্তিরে ঠাম্মার মুখে রূপকথার দেশের বর্ণনা শুনেই ওর মনটা কেমন আনমনা হয়ে পড়েছিল। সক্কালবেলাও ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসে কেবলই মনে-মনে ভাবছিল, ইস, অমন সুন্দর রূপকথার দেশ! রাজপঙ্খী, রাজপুত্তুর, রাজকন্যা, লালপরী, নীলপরী আরো কত্ত কী! আহারে, একবার যদি যেতে পারতুম। ব্যাস, যেই না ভাবা, অমনি তা কেমন করে জানতে পেরে গেল বড়ো শালিক। আর যাবে না-ই বা কেন, ও তো টুকুনদের উঠোনেই রোজকার মতো ঘুর-ঘুর করে খুদ-কুঁড়ো খাচ্ছিল। আর তাছাড়া টুকুনের বন্ধু বলতে তো ওরাই। এই যেমন ধরো বড়ো শালিক, ওর বউ শালিক, তিনটি ছানাপোনা, চড়ুই, প্রজাপতি আর কাঠবিড়ালি।
ডানা দুটিকে বেশ করে জাপটে ধরল টুকুন।
বড়ো শালিক বললে, ভয় পাচ্ছো?
মুচকি হেসে শাকিলের দিকে তাকায় টুকুন। তুমি যে রকেটের মতো ছুটছ হে বড়ো শালিক। ভয় লাগবে না?
ধ্যুৎ। ভয় কিসের? আমি তো আছি। জানো, ওই ডানায় চেপে গতকাল আমার তিন-তিনটে ছানা চলে এল। আর তুমি তো একা।
টুকুন আরো একটু আঁটোসাঁটো হয়ে বসল বড়ো শাকিলের ডানায়। মেঘের ভেতর দিয়ে দুরন্ত হাওয়ার গতিতে উড়ে যাচ্ছে ওরা। আর নিচের দিকে তাকাতেই কেমন যেন মাথা চক্কর দিয়ে উঠছিল টুকুনের। চোখের নিমেষে দেশের পর দেশ ছাড়িয়ে ওরা এসে পৌঁছল রূপকথার দেশে।
রূপকথার সাম্রাজ্যে প্রবেশ করে যারপর নাই মুগ্ধ হল টুকুন। অবাক বিস্ময়ে সে ঘুরে-ঘুরে দেখছিল চারদিক। হীরে-মাণিক জ্বলা একটা গুহার সামনে এসে কেমন যেন গা-ছমছম করে উঠল তার। ভয় চোখে বড়ো শাকিলের দিকে তাকাতেই হেসে ফেলল শালিক। আরে, ভয় পাচ্ছ কেন? ওর ভেতরে ঢুকলেই তো দেখতে পাবে আসল রূপকথার দেশ।
অলৌকিক আলো-ছায়ার গুহায় ঢুকে পড়ল টুকুন। একপা-একপা করে এগিয়ে যেতেই সামনে এসে হাজির হল হীরের মুকুট পরা দুটি হরিণছানা। একটি এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরল টুকুনকে। ফিক করে হাসল। কথাও বলল।
ভালো আছো? তোমার নাম কী?
উত্তর দেবে কী, টুকুন তো কান্ড দেখেই থ। হরিণরাও কথা বলতে জানে? হরিণের গায়ে এতো সুগন্ধ? এমন অপরূপ হাসতে জানে ওরা? বিষ্ময়ের শেষ নেই টুকুনের।
চুপ করে আছো কেন, উত্তর দাও। বড়ো শালিকের কথায় বিস্ময়ের ঘোর কাটল টুকুনের। হরিণের সঙ্গে সেও হাসল। কথার উত্তর করল।
তবে সবচেয়ে চমকে গিয়েছিল সে ফুল উছলে পড়া বড়ো বকুল গাছটার নিচে এসে! সেখানেই থম মেরে বসেছিল সোনার জরি গায়ে জড়ানো সিংহমামা। টুকুনকে দেখেই তড়াক করে এক লাফে সামনে এল সে। কাণ্ড দেখে টুকুন তো আধমরা। চোখ বুজে ফেলল ভয়ে। কিন্তু চোখ খুলতেই অবাক হয়ে দেখল সে সিংহমামার কোলে বসে আছে। তার নরম তুলোর মতো দুটো থাবা আছে। অথচ নখ নেই। হাঁড়ির মতো অথচ মিষ্টি মুখটা আছে। গোঁফও আছে। কিন্তু ধারালো দাঁত নেই।
খেলবে খোকন? সিংহ মামা বললে।
টুকুন মুখ তুলে তাকাল। মৃদু হাসলো ও। তারপর সিংহমামার তুলো-তুলো থাবায় হাত বুলিয়ে বলল, হ্যাঁ।
যেই না বলা, অমনি আকাশের নীল পর্দা ফুঁড়ে নাচে লাফিয়ে পড়ল। আরো দুটি সিংহমামা। টুকুনের দিকে তাকিয়ে বলল, এই নাও, তোমার জন্য বল এনেছি।
খেলবে কী, সিংহ মামার হাতে বল দেখে তো টুকুন আরো অবাক। বল কোথায়, এত রাত্তিরের আকাশের টুকটুকে চাঁদ। রোজ ওই তো জানলার ফাঁক গলে টুকুননকে 'আয়-আয়' বলে ডাকে।
চাঁদটা গড়াতে গড়াতে টুকুনের সামনে এসে থামল। টুকুন পরখ করে দেখল। সত্যি সত্যি ওটা চাঁদ। টুকুন ওর গায়ে হাত ছোঁয়াতেই সে কথা বলে উঠল। কিন্তু হাসল না।
জানো, আমি ঘুমোচ্ছিলাম। ওরা আমাকে টেনে তুলে আনল। চাঁদ বলল-
ও, তুমি বুঝি দিনেরবেলা ঘুমোও? টুকুনের অবাক প্রশ্ন।
হ্যাঁ তো, নইলে রাতের বেলায় তোমাদের জন্য জ্যোৎস্না ছরাবে কে শুনি? বাব্বা তোমরা তো যা, একরাত কামাই গেলেই তো তোমরা চোখে ধাঁধা দ্যাখো। মনে-মনে গাল মন্দ করো। আচ্ছা, যাক সে কথা। নাও, খেল। আমি আবার ঘুমোতে যাব। আমার তো আবার ঘুম বেশি। দ্যাখো না, মাসে কত রাত ছুটি নিই।
সিংহমামা, তার দুই ছানা আর
টুকুন- চারজনে বেশ খানিকক্ষণ খেলে নিল। আর বড়ো শালিক তো সিটি বাজিয়ে রেফারিগিরি
করছিল বেশ। দারুণ মজা হল টুকুনের। যত দেখছে তত আনন্দ হচ্ছে ওর। এক আশ্চর্য আনন্দের
দেশে।
খেলা শেষ করে একটু দক্ষিণে এগোতেই বড়ো শালিকের সঙ্গে টুকুনকে দেখে, এসো এসো বলে লাফিয়ে উঠল শিয়ালমামা। ভাবল বড়ো শালিক ছাত্র জোগাড় করে এনেছে নিশ্চয়ই। সামনে গোল করে বসা লালপরী, নীলপরী, ময়ূরপঙ্খী, ইঁদুর, পেঁচা- সবাই হা করে দেখছিল টুকুনকে।
পড়বে না কি? বড়ো শালিকের প্রশ্ন।
না। টুকুন মুখ ভার করে বলল।
শিয়ালমামা সামনে এগিয়ে এসে একগাল হেসে বললে, পড়বে না কেন খোকা? এসো না, আমি তোমাকে কেমন মজা করে পড়াই, দেখবে কোনো কষ্ট নেই এদেশের পড়াতে। খালি মজা আর মজা। বলেই শোনাতে লাগল একের পর এক মজার-মজার সব গল্প।
আশ্চর্য, শিয়ালমামার পড়া মেশানো অদ্ভুত সব মজার গল্পগুলি শুনতে শুনতে কখন যে ঘুম এসে গেল টুকুনের, নিজেও বুঝতে পারল না সে।
কিন্তু ঘুম ভাঙতেই দেখল বড়ো শালিক তার তিনটে ছানাপোনাকে নিয়ে ওদের উঠোনের হলুদ রোদ্দুরে এক্কা দোক্কা খেলছে। আর মাথার পাশে দাঁড়িয়ে গোঁফে তা দিচ্ছে অংকের স্যার করুণ প্রভাত বাচু। টুকুন চোখ মেলতেই গোঁফের ফাঁক দিয়ে ফিক করে হেসে বললেন, উঠে অংক বইটা খোল। আজ লাভ-ক্ষতির হিসেবটা তোর মাথায় ময়দা ঠাঁসান ঠেঁসে তবেই বাড়ি যাব!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা। মে ২০১১
Topic : Story of Fairy tale in bengali, Best story of Children and kids, story of Stork রূপকথার গল্প, শালিক পাখির গল্প
0 মন্তব্যসমূহ