Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বৃষ্টি ভেজা ঘুড়ি ও মরা ব্যাঙ ।। প্রবীর জানা


 

দুদিন হল আমাদের স্কুলে গরমের ছুটি পড়েছে। হঠাৎ এই সময় হাজির গুনুমামাও। আরতী বলল, গুনুমামা, এখন ইসকুলে গরমের ছুটি। তুমি এখন না আসতে পারতে।

- এ কথা বলছ কেন?

- যা গরম পড়েছে, আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরছে!

-গ্রীষ্মকালে গরম পড়বে নাকি বরফ পড়বে?

- তুমি তো থাকো সাগরদ্বীপে। সেখানে কত গাছপালা, খাল-বিল। এখানে এসব কম আছে বলেই এত গরম। এই গরমে তোমার থাকতে কষ্ট হবে তাই কথাটা বললাম।

আরতি আমার ছোটো বোন। সে পড়ে ক্লাস টু-তে আর আমি ফাইভে। বয়স কম হলে কি হবে অনেক সময় সে বড়োদের মতো এমন কথা বলে, শুনলে সকলে অবাক হয়ে যায়। আমি বললাম, তুমি এলে মনে হয় ওর অসুবিধা হয়। আসলে তুমি তো নিয়ম করে দাও, কখন পড়ব, কখন ইসকুলে যাব, কখন খেলতে যাব, কতক্ষণ খেলব। সেটা হয়তো ওর পছন্দ নয়।

অনেকক্ষণ ধরে পুতুল নিয়ে আর খেলতে পারবে না।

আমার হাতে চিমটি কেটে বলল, দাদা ভালো হবে না বলে দিচ্ছি। গুনুমামা হাসল। আমি বললাম, মামা তুমি দুপুরে ঘুমোবে না?

গুনুমামা বলল, হ্যাঁ। অনেকটা পথ এসেছি একটু গড়িয়ে নিই।

গুনুমামা আমাদের বাড়িতে এলে আমাদের বাড়ির কেন, পাড়ার চেহারাটাই পাল্টে যায়। গুনুমামা সুন্দরবনের কোনো একটা ইসকুলে মাস্টারি করেন। মাস্টারমশাইদের কাছে যেতে আমরা ভয় পাই, কিন্তু মামাকে দেখে আমরা ভয় পাই না। গুনুমামা একেবারে অন্য মানুষ। এখানে পাড়ার সব ছোটোরা তাঁর বন্ধু হয়ে যায়। খেলার জন্য মামা ফুটবল এনে দেয়। কখনও আমাদের সঙ্গে নিয়ে হৈহৈ করে বেরিয়ে পড়ে বেড়াতে বা পিকনিক করতে। কিন্তু পড়ার সময় তার নিয়ম আমাদের মেনে চলতে হয়। পড়ার সময় পড়তে বসতে হবে বা ছুটির দুপুরে ঘুম না পেলেও বিছানায় চুপটি করে শুয়ে থাকতে হবে। না হলে গুনুমামা রেগে যাবে।

তখন ভরদুপুর। আরতি এসে বলল, দাদা, ঘুড়ি ওড়াতে যাবি?

আমি বললাম, গুনুমামা কোথায়?

-ঘুমোচ্ছে।

পা টিপে-টিপে গুনুমামার শোয়ার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে শুনতে পেলাম গুনুমামার নাক ডাকার শব্দ। অমনি ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।

বিশাল ফাঁকা মাঠের পরে বড়ো দিঘি আর তার পাশে এইয়্যা উঁচু বটগাছ। মোটা সুতোয় আটকানো লেজওয়ালা ভোমরা ঘুড়ি উড়িয়ে দিলাম আকাশে। লাটাই আমার হাতে, পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরতি। কিছুক্ষণ পর আকাশ হঠাৎ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এক ফোঁটা, দু-ফোঁটা বৃষ্টি পড়াও শুরু হল। পাড়ার আরো ছোটোরা দিঘির পারে জড়ো হতে শুরু করেছে খেলার জন্য।

এমন সময় গুনুমামার গলা শোনা গেল, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তোমরা তাড়াতাড়ি ঘুড়ি নিচে নামিয়ে আনো।

পেছন ফিরে দেখলাম মামা দৌড়তে-দৌড়তে আমাদের দিকে আসছে। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, না ঘুমিয়ে দুপুরে ঘুড়ি ওড়াচ্ছি বলে নিশ্চয়ই রেগে গেছে। ঘুড়ি নামিয়ে নিলাম। বৃষ্টিও জোরে নামল, আমি আর আরতি বটগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ালাম।

ধমকের সুরে বলল, এক্ষুনি বিপদ হতে পারত।

আরতি বলল, কীসের বিপদ গুনুমামা, ঘুড়ি ওড়ালে বিপদ হয়?

গুনুমামা গম্ভীর গলায় বলল, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নামে এক ব্যক্তি ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে বিপদে পড়েছিল।

গুনুমামাকে আসতে দেখে মাঠের আর সবাই এসে জড়ো হল সেই বটগাছের তলায়। গুনুমামা বলল, ঘুড়ি ওড়াতে তোদের মতো অনেকেই ভালোবাসে। কিন্তু বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন ঘুড়ি উড়িয়ে ছিলেন এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু সে গল্প পরে হবে। এখন সবাই বাড়ি চল, এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়ানো যাবে না, ভিজে যাবি, তাছাড়া বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে।

বিকেলের দিকে বৃষ্টি কমতে সবাই আমাদের বাড়িতে হাজির। গুনুমামার গল্প শোনার জন্য।

মামা বলল, আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে দেখে ফ্রাঙ্কলিন ভাবলেন, ওই বিদ্যুৎকে যদি ধরে আনা যেত তাহলে খুব মজা হত। কিন্তু পৃথিবী থেকে আকাশ অনেক দূরে। সেখানে পৌঁছনো সম্ভব নয়। বিদ্যুৎ ঢেউ খেলে যায় মেঘের গায়ে। ঘুড়ি ওড়ালে ঘুড়িটা মেঘের কাছাকাছি চলে যেতে পারে। বিদ্যুৎ চমকায় সাধারণত যখন বৃষ্টি পড়ে। কাগজের ঘুড়ি বৃষ্টিতে ভিজে গেলে উড়বে না। তাই সিল্কের কাপড় দিয়ে বানালেন ঘুড়ি। ঘুড়ির সুতো যাতে বৃষ্টিতে ভিজে দূরে উড়ে না চলে যায় তাই সুতোর শেষ প্রান্তে লোহার চাবির সঙ্গে বেঁধে হাতে ধরা ছিল তাঁর।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকালো। ঘুড়ি উড়ে মেঘের সবচেয়ে কাছাকাছি হওয়ায় বিদ্যুৎ ঘুড়ি হয়ে ভেজা সুতোর মাধ্যমে ফ্রাঙ্কলিনের হাতে রাখা লোহার চাবিতে এসে গেল। বিদ্যুতের ছোঁয়ায় ফ্রাঙ্কলিন অল্প সময়ের জন্য জ্ঞান হারালেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরলে তিনি আবিষ্কারের আনন্দে লাফাতে থাকলেন। তিনিই প্রথম প্রমাণ করলেন, কোনো মাধ্যমের সাহায্যে আকাশের বিদ্যুৎ পৃথিবীতে ধরে আনা যায়।

আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে খুব জোরে। চারিদিকে ঝমঝম শব্দে ব্যাঙের গ্যাঙর-গ্যাঙর ডাক শোনা যাচ্ছে। আমরা বারান্দায় বসে গল্প শুনছিলাম। একটা সোনাব্যাঙ লাফ দিয়ে বারান্দায় চলে এসেছে। চন্দন হঠাৎ একটা ঢিল ছুঁড়ে ব্যাঙটাকে মারতে গেল।

গুনুমামা তাড়াতাড়ি বলল, উঁহু! ওকে মেরো না। জানো, ব্যাঙ আমাদের পৃথিবীর চেহারাটাই পাল্টে দিয়েছে।

গুনুমামার কথা শুনে আমরা সবাই তো অবাক। নবনীতা বলল, মামা সেটা কীরকম বলো না?

গুনুমামা বলল, অনেক বছর আগের ঘটনা। বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন পরীক্ষা করে প্রমাণ করেছেন যে, ভিজে ঘুড়ির সাহায্যে আকাশের বিদ্যুৎকে পৃথিবী পর্যন্ত আনা যায়। কিন্তু বিদ্যুৎকে কীভাবে ধরে রাখা যায় তা আবিষ্কার হয়নি।

ইতালির বলোনা শহরে লুইজি গ্যালভানি নামে একজন অধ্যাপক বাস করতেন। তাঁর বউ লুসিয়া প্রায়ই অসুখে ভুগতেন। তিনি ভালোবাসেন ব্যাঙের সুপ খেতে। রান্নাবান্না গ্যালভানিকেই করতে হত। তিনি একদিন ব্যাঙের সুপ রান্না করে লুসিয়াকে খেতে দেবেন বলে ব্যাঙের চামড়া ছাড়িয়ে টেবিলের ওপর রেখে, হঠাৎ অন্য কোনো কাজে বাইরে চলে যান। টেবিলের ওপর বিদ্যুৎ সম্বন্ধে পরীক্ষার জন্য নানাধরনের যন্ত্রপাতি রাখা ছিল। লুসিয়া সেই ব্যাঙ ছুরি দিয়ে কাটতে গিয়ে দেখলেন মরা ব্যাঙের পা-দুটো নড়ছে। লুসিয়ার কাছে মরা ব্যাঙের পা-নড়ার কথা শুনে গ্যালভানি আশ্চর্য হলেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে দিলেন। ছাল ছাড়িয়ে মরা ব্যাঙকে নুন জলে ভিজিয়ে তামার তারে বেঁধে ঝুলিয়ে দিলেন। তলায় রাখলেন লোহার মোটা রড। সেই মরা ব্যাঙের গায়ে স্পর্শ করালেই মরা ব্যাঙ ছিটকে যেত।

গ্যালভানি তখন হয়তো বুঝতে পারেননি যে তিনি কি আবিষ্কার করেছেন, তাঁর এই আবিষ্কারের ফলে সারা পৃথিবীর রূপটাই পাল্টে যাবে। এরপরে গ্যালভানি বিভিন্ন স্কুল-কলেজে, পথে-ঘাটে মরা ব্যাঙের নাচ দেখিয়ে দর্শকদের অবাক করতেন। কিন্তু তাঁর এই আবিষ্কারকে কেউ তেমন গুরুত্ব দিতেন না। অনেকে মনে করতেন তিনি হয়তো পাগল। তাই মরা ব্যাঙের নাচ দেখিয়ে আনন্দ পান। লুসি মারা গেলেন। ধীরে-ধীরে গ্যালভানিরও বয়স অনেক হল। একদিন তাঁকেও পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হল।

গ্যালভানির মৃত্যুর বেশ কয়েক বছর পরে আবিষ্কার হল ঘর্ষণজাত তড়িৎ। প্রমাণ হল ভেজা ব্যাঙের পা ও তামার তার একত্রে তড়িৎ কোষ গঠন করেছিল বলে মরা ব্যাঙও কাঁপত এবং প্রথম তড়িৎ কোষ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন গ্যালভানি। বিদ্যুৎকে ধরে রেখে আলো জালানো থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি পরিচালনায় এমনকি মহাকাশে পাড়ি দিতে হলেও বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। অর্থাৎ বিদ্যুৎ এমন একটি বস্তু যা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে অপরিহার্য। আর সেই স্থায়ী বিদ্যুৎ কোষ গঠনের আবিষ্কর্তা মরা ব্যাঙ নাচানো এক অধ্যাপক লুইজি গ্যালভানি। তাঁর আবিষ্কার সূচনা করল নতুন এক যুগের।

আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে তখনও। ব্যাঙটা তখনও বসে আছে ডাঙায়। ভাবছি আবিষ্কার বুঝি হঠাৎই হয়। আবিষ্কারক বুঝতে পারেন আবিষ্কারের পরে।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮

Topic : Top positive environmental story, short stories about nature, Memorable environmental story,  Best story of the environment, Most Exciting Environmental Stories, পরিবেশের গল্প


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ