![]() |
প্রতি বছর নভেম্বর মাসের ২৬ তারিখে যেখানেই থাকি না কেন এই হোটেলে এসে আমি উঠবই এবং এই ৭০৯ ঘরটাই আমার চাই। পর পর তিন বছর এই ঘরটা পেতে আমাকে একটু বেগ পেতে হয়েছে। তিনবছরই এসে দেখি ওই ঘর আমার আগেই অন্য কেউ নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ওই ঘরটির মায়া যে আমি কিছুতেই ছাড়তে পারি না। সারা বছর আমি দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াই। কিন্তু নভেম্বরের ২৬ তারিখ এলেই আমায় আসতেই হয়। দুর্নিবার এর আকর্ষণ। আমি প্রথম দু'বছর ঘরটা অন্য লোক নিয়েছে দেখে আর কিছু বলিনি। প্রথমবার দেখি ঘরটা নিয়েছে সদ্য বিবাহিত এক স্বামী-স্ত্রী। তাদের ডিস্টার্ব করা যুক্তিযুক্ত মনে করিনি। দ্বিতীয় বছর এসে দেখলাম একটি ছেলে ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। সঙ্গে তার বৃদ্ধ বাবা। ২৮ তারিখে ইন্টারভিউ সুতরাং তাদেরও আমি ডিস্টার্ব করিনি। কিন্তু তৃতীয়বার এসে দেখলাম এক ব্যবসায়ী ভদ্রলোক ঘরটি নিয়েছেন। এবার আমি আর থাকতে পারলাম না। ওই ভদ্রলোককে বেশি কিছু করতে হল না। দরজাটা খুলে একটু ভয় দেখাতেই ভদ্রলোক পড়ি কি মরি করে নিচের রিসেপসনে দৌড়লেন। তিনি ওই ঘরে থাকবেন না। রিসেপসন থেকে লোক পাঠিয়ে ঘরটা চেক করা হল। লোক আসছে দেখে আমি সরে পড়লাম। কেউ কোথাও নেই।
হোটেলের লোক বলল, আপনি মিছিমিছি ভয় পাচ্ছেন মশায়। কেউ কোথাও নেই। ভদ্রলোক তা শুনলেন না। তিনি গোঁ ধরে বসে রইলেন, তাঁকে ওই ঘর বদলে অন্য ঘর না দিলে তিনি রাত্রিরটা লাউন্চে বসে কাটাবেন সেও ভালো। তবু ওই ঘরে তিনি থাকবেন না। তাঁকে অবশেষে অন্যতলায় ঘর দেওয়া হল। ঘরটি বন্ধই রাখা হল সেই রাতে। আমি ঘর খুলে সেই রাতটা তোফা ঘুম দিলাম। তারপরের বছরও ২৬ তারিখে এসে দেখি সেবারও ওই ঘরে এক মন্ত্রী এসে রয়েছেন।
আমি গিয়ে সটান তাঁকে বললাম, ও মশাই ঘরটা ছাড়ুন।
মন্ত্রী ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। আমাকে দেখে বললেন আপনি কে? আমার ঘরে কী করে ঢুকলেন? আমার সিকিউরিটি কোথায় গেল?
আমি বললাম, হয়তো জাহান্নামে, যেখান থেকে আপনি এসেছেন। এখন আপনি এ ঘর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে কাটুন।
মন্ত্রী এবার চেঁচিয়ে উঠে বললেন, কে আপনি? জানেন আমি কে? আমি পশ্চিমবঙ্গের একজন মন্ত্রী।
আপনি পশ্চিমবঙ্গ কেন ভারতের মন্ত্রী হতে পারেন কিন্তু আজ ২৬/ ১১, এ ঘরটা আমার।
ভদ্রলোক বললেন, আমি এখুনি ফোন করছি রিসেপসনে। এই বলে ফোন হাতে নিতে গেলেই আমি ফোনটা শূন্যে তুলে দিয়ে খিক খিক করে হাসতে থাকলাম।
ভদ্রলোক এবার ছুটে তাঁর সিকিওরিটিকে যেই ডাকতে যাবেন অমনি আমি তাঁকে দুহাতে মাটিতে ফেলে একটা ঘুষি মারতেই মন্ত্রী মশাই অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে রইলেন। আমি সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বিছানায় সটান শুয়ে পড়লাম।
এরপর পরপর আরও দু'বছর ২৬/ ১১ তারিখে অমন উটকো লোককে আমার এই ৭০৯ নম্বর ঘরে থাকতে দেখে তাদের এমন উচিত শিক্ষা দিলাম যে তারা দুজনেই গোঁ-গোঁ করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল।
এই লোকগুলিই রটিয়ে দিল এই ৭০৯ নম্বর ঘরে নাকি ভূত আছে। পরপর চারবার এইরকম কাণ্ড হওয়ায় হোটেল মালিক নিজেরাই ঠিক করল ২৬/ ১১ তারিখে ওই ঘরটা বন্ধ থাকবে। আজ আট বছর ধরে ঘরটা বন্ধ থাকছে। আর আমি এই তারিখে এসে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে আলো জ্বালিয়ে স্নান করছি। ফ্রিজে রাখা আপেল, আঙ্গুর আর কোলড্রিঙ্কস মজা করে খাচ্ছি। হঠাৎ আলো জ্বলা দেখে সিকিওরিটির লোক আসছে ঘরে কে আছে দেখতে। আমি লোক ঢোকামাত্র আলো নিভিয়ে দিচ্ছি। তারা চলে যাচ্ছে। তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়ছি।
এবার মানে ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর ৭০৯ নম্বর ঘরে সন্ধ্বেবেলা ঢুকে দেখি একটি বাইশ-তেইশ বছরের ছেলে এসে গেঞ্জি আর পাজামা পরে টিভি দেখছে।
আমি ঘরে ঢুকতেই ছেলেটি ভূত দেখার মতো করে চমকে উঠল।
কে? কে আপনি?
আ-পনি কে?
আমি যেই হন না কেন আজকের জন্য এই ঘর আমার।
তার মানে? এ ঘর তো আমার নামে বুক করা। এই দেখুন আমার কাছে ঘরের চাবি। আপনি যখন ঘর বুক করেন তখন আপনাকে কেউ কিছু বলেনি।
হ্যাঁ বলেছিল। একটি মাত্র ঘর খালি আছে সেটা ৭০৯। কিন্তু সেটা আজ কাউকে দেওয়া যাবে না। আজ ২৬/ ১১। প্রতিবছর এই ঘরটি ভুতুড়ে ঘর হয়ে যায়। যারা ওই ঘরে যায় তারা এ পর্যন্ত সবাই ভয় পেয়ে চলে আসে। তারপরই দেখা যায় ঘরে আলো জ্বলছে। কেউ ঘরে আছে বলে মনে হয়। ঘরের ভেতর মিনি ফ্রিজে রাখা সব কোল্ড ড্রিঙ্কের বোতল, চকলেট, আপেল সব সাবাড় হয়ে যায়। অথচ ঘরে গিয়ে দেখা যায় কেউ কোথাও নেই। এইসব আষাঢ়ে গল্প আর কি!
আমি বলি আমি ওসব আজগুবি ভূতের গল্প মানি না। আমি যুক্তিবাদী ক্লাবের সদস্য। ভূত শয়তান দৈত্য দানো বলে কিছু নেই। আমি তাই জোর করে বলেছিলাম আমি এই ঘরেই থাকব। অনেক বলায় তাঁরা শেষ পর্যন্ত এই ঘরের চাবিটা দিলেন। তবে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেন আমার কিছু হলে হোটেল কর্তৃপক্ষ দায়ী নন।
ব্যাস, আপনি অমনি সব জেনে শুনে আজ ২৬/ ১১ তে এই ঘরে চলে এলেন?
আপনিও বা এইঘরে কেন এসেছেন? আর ঢুকলেনই বা কি করে?
সে কৈফিয়ৎ আপনাকে দেব না। আপনি কি জানেন না এই ১৬/ ১১-তে এই হোটেলে সন্ত্রাসবাদীরা হামলা চালিয়ে দুশোর ওপর লোককে মেরে ফেলেছিল?
সে তো মশায় ১২
বছর আগের কথা। তারপর তো পুরো হোটেল আবার নতুন করে সাজানো হয়েছে। হোটেলের সামনে
কড়া পাহারা আছে।
আমি তো সেই থেকে এই ঘরে বসে আছি, আর যদি হামলাকারিরা আসে আমি একাই তাদের মোকাবেলা করব। আর পুলিশের অপেক্ষা করব না।
আপনি সেই থেকে এই ঘরে আছেন মানে?
হ্যাঁ সেই দিন থেকে। সেদিনটা ছিল ২৬/ ১১। আমি তার দুদিন আগে এই শহরের অফিসের কাজে এসেছিলাম। এই ঘরটাতে ছিলাম। ঘটনাটি আমার নিজের চোখে দেখা। হামলাকারিরা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে ওপরে উঠে এসেছিল। গোলমালের শব্দ পেয়ে আমি দরজা খুলে বেরুতেই একটা লোক আমাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়।
তারপর?
তারপর আর কি, মুহূর্তের মধ্যে পাঁচটা গুলি আমার পাঁজর ভেদ করে চলে যায়। আমি সঙ্গে-সঙ্গে মারা যাই।
ছেলেটি এবার হো-হো করে হেসে উঠল। আপনি আমায় ভয় দেখাতে এসেছেন?
আপনি কে বুঝতে পারছি। ভাববাদীদের কেউ হবেন। তারা আমাদের যুক্তিবাদীদের ভয় দেখানোর চেষ্টা করে, আমরা ভয় পাই না। যাক মশাই এখন কেটে পড়ুন। যে আপনাকে পাঠিয়েছে তাকে গিয়ে বলুন- ভুল জায়গায় পাঠিয়েছিলে।
এবার আমি বললাম, আপনি বিশ্বাস করছেন না সেই ভয়াবহ ঘটনার আমি একজন শিকার।
বিশ্বাস করব কোন যুক্তিতে? আপনি কি ভূত? যদি ভূত হন তাহলে এতদিন পরে এখানে কি করছেন?
আমি প্রতি বছর ২৬ /১১ তে এই হোটেলে ফিরে-ফিরে আসি। ফিরে আসি এই ঘরটায়। না এসে থাকতে পারি না। কিন্তু আসি পাহারা দিতে। যাতে আর কোনো হানাদার না আসতে পারে।
তাই আপনি বুঝি নিজেই হানা দিতে এসেছেন? আপনি যাবেন কিনা বলুন, নয়তো আমি কিন্তু হোটেলের সিকিওরিটিকে ডেকে আপনাকে গ্রেফতার করব।
আপনি এখান থেকে হঠুন। আপনি একজন জালিয়াত ভণ্ড। আমাকে ভয় দেখাতে এসেছেন। এই বলে লোকটি উত্তেজিত হয়ে আমাকে মারতে এল।
লোকটি কাছে আসতেই আমার যেন মনে হল খুব চেনা-চেনা মুখ। আরে! এতো জনাব আলী। শহরের একজন মাফিয়া ডন। সে এখানে কোন মতলবে এসেছে কে জানে?
আমি তাকে জড়িয়ে
ধরে মুহূর্তের মধ্যে খোলা জানলা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিলাম। ২৬/ ১১-তে আমি কারও
হম্বিতম্বি সহ্য করব না, তা সে মাফিয়া
ডন-ই হোক বা যেই হোক। তারপর আমি মিনিবার থেকে একটি কোকোকোলার ক্যান বার করে তৃপ্তি
করে খেতে লাগলাম। আজ রাত্তিরের পর ভোর হবার আগে আবার আমাকে বেরিয়ে পড়তে হবে। এক
বছর পর আমি আবার আসব। এই ২৬/১১ তে।
অলংকরণ-প্রণব হাজরা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা ।। মে ২০১৪
Topic : Ghost story in Bengali, ভূতের গল্প, ভৌতিক গল্প, Chhotoder bhooter golpo, children's ghost story, best ghost story for children's, short ghost story
0 মন্তব্যসমূহ