Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

নেমন্তন্নের চিঠি ।। দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়


মিতালী নিমন্ত্রণ পত্র লিখতে বসল। প্রথমে একটা বিয়ের কার্ড থেকে টুকে লিখল, 'পত্র দ্বারা নিমন্ত্রণের ত্রুটি মার্জনীয়'। এই লাইনটার মানে সে মায়ের কাছ থেকে জেনেছিল মুনিমামার বিয়ের কার্ডটা পড়তে গিয়ে। সামনা-সামনি গিয়ে নিমন্ত্রণ করতে যদি না পারা যায় তাই জন্যে নাকি এমনধারা লিখতে হয়। মিতালীও তো সামনে গিয়ে নিমন্ত্রণ করতে পারেনি। কাছাকাছি যেতেই পাড় থেকে জলে উড়ে গিয়েছিল পাখি সব। সেই রোববার, শীতের দুপুরে, সাঁতরাগাছি ঝিলের ধারে। মিতালী খুব মন দিয়ে চিঠিটা লিখতে লাগল, আমাদের বাড়ির পিছনের দিঘিজোড়াও মন্দ নয়। আকারে বেশ বড়ো। জলে ঢেউ আছে। পাড়ে তাল, শিমুল, শিরিষ গাছের সারি। ওড়ার জন্য খোলা জায়গা অনেকখানি। যদি ওধারের ধানক্ষেত আর হোগলা বন ধরা যায় তাহলে তো ওড়াউড়ি করে ফুরোতে পারবে না। হাঁফিয়ে গেলে আমাদের জাম গাছটায় কিংবা গোবুদের কাঁঠাল গাছটায় বিশ্রাম নিতে পার। অনেকরকম পাখিই সেখানে বসে, তাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে যাবে। আর কী বলব তোমাদের।

বসন্তকাল তো এসেই গেল, শিমুল এবার লালে লাল হয়ে যাবে। আর সূর্য ডোবার সময় আকাশটা ওই রঙ নিয়ে হোলি খেলতে শুরু করবে। চটপট চলে এসো দলবেঁধে। সবার ঠিকানা তো জানিনা। তাই তোমাদের অন্য দেশের বন্ধুদেরও খবরটা দিও। বোলো, সবার নেমন্তন্ন জোড়াদিঘিতে। হওয়ার কথা নয়, তবু যদি ঠিকানা নিয়ে কোনো অসুবিধা হয় তবে উলুবেড়িয়ার যে কোনো পাখিকে জিজ্ঞাসা করো- দেখিয়ে দেবে। ভালো থেকো।-ইতি তোমাদের বন্ধু মিতালী।

মিতালী এবার কাগজটা ভাঁজ করে খামে ঢোকাল। তার ওপর ধরে ধরে লিখল- বালিহাঁস ও অন্যান্য পরিযায়ী, সাইবেরিয়া, রাশিয়া। তারপর ভাবল পিনকোড কী লিখব? পাখিদের আস্তানা কি পোস্টঅফিসের লোকেরা জানবে না? সব তো বইয়েতেও লেখা থাকে। সে এতটুকু মেয়ে, সে-ই পড়েছে চিলকা, ভরতপুর, রসিকবিল, উত্তরভারতের আরও কত সব পক্ষীনিবাসগুলোর কথা। পোস্ট অফিসের লোকেরা নিশ্চয়ই জানবে ঠিকানা। মিতালী নিশ্চিত হয়ে ডাকটিকিট মেরে চিঠিটা পোস্ট করে দিল।

এরপর মিতালীর দিন পার হয়ে সপ্তাহ কাটতে লাগল। সে জোড়াদিঘিতে আর বাড়ির ডাকবাক্সে নজর রাখল প্রতিদিন। অবশেষে সপ্তাখানেক পর হঠাৎ জানালার নিচে একটা ছোট্ট চিরকুট আবিষ্কার করে আনন্দে লাফিয়ে উঠল মিতালী। দোতলার জানলা দিয়ে কি করে ওটা ভেতরে এল কে জানে। মিতালী খুলে পড়ে তো অবাক! তাতে লেখা, ক্যাঁক-ক্যাঁক, প্যাঁক-প্যাঁক, প্যাঁকাং! ট্যাঁ-ট্যাঁ, টো-টো ট্যাঁকাং! কিচ-কিচ, মিচ-মিচ, ক্যাচোর। কুক-কুম, বুক-কুম, ম্যাচোর! মনে হচ্ছে কোনো পাখিকে দিয়েই পাঠিয়েছে। বাপরে কী হিজিবিজি কাটার মতো লেখা। অবশ্য পাখিরা আর ঠোঁট দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে লিখবেই বা কী করে? যাকগে, পড়া তো যাচ্ছে। কিন্তু কি বলতে চেয়েছে? মিতালী বোঝার চেষ্টা করে। প্রথম লাইনটায়- নিমন্ত্রণ পেয়ে ক্যাঁক-ক্যাঁক প্যাঁক-প্যাঁক করে আনন্দ করেছে বলেছে। নাকি দিঘির পাঁক শ্যাওলার কথা বলেছে? কি মুশকিল! দ্বিতীয় লাইনটা বোঝা যাচ্ছে, লিখেছে খুব টো -টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কী যে মজা পাখিদের! কিন্তু ট্যাকাং? ট্যাকাং মানে কী? ট্যাঁক ফাঁকা হয়ে গেল গেছে ঘুরে ঘুরে? পাখিদেরও কি পয়সা লাগে? কে জানে বাবা! মিতালী পরের লাইনে এসে আরও আটকে যায়। কি বলছে? কিসমিস খাবে? রান্নার চাইছে? বুক মানে তো বই। তার মানে বইয়ে পড়েছে ম্যাচোর? ও তাহলে জোড়াদিঘির মাছচোরদের কথা বইয়ে পড়েছে!

মিতালী এমনটা বুঝে নিয়ে কাজে লেগে পড়ল। প্রথমে মায়ের থেকে আবদার করে কিসমিস আদায় করল। এরপর বাজারের ঢেঁকুর হোটেলের রাঁধুনিকে ধরল। বলল, পাখিরা এলে কুক হিসাবে তাকেই ডাকবে রান্না খাবার দিতে। পুলিশ-কাকুর কাছে গিয়ে মাছচোরদের ব্যাপারে পাখিদের আপত্তি আছে এমনটা নালিশ করল। বলল, সেই রাশিয়া পর্যন্ত রটে গেছে খবরটা, এলাকার বদনাম! শেষে দিঘির মালিক মল্লিকদাদুকে অনুরোধ করল পাঁক পরিষ্কার না করতে। বলল, পাখিরা নিশ্চয়ই বাঁধানো কৃত্তিম জলাশয় পছন্দ করে না।

কিন্তু এসব শুনে সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল। কেউ কেউ খুকি বাড়ি যাও বলে পাত্তা দিল না। বাড়িতে ফিরে তার বিপদ আরও বাড়ল। পোস্ট অফিসের ঘড়ুই পিয়ন ঘুরে ঘুরে সবাইকে বলে বেরিয়েছে মিতালীর নিমন্ত্রণপত্রের গল্প। দাদা হাসছে, টুকুন, বুকুন, খুড়তুতো দাদা-দিদি সবাই হাসছে। মিতালীর কান্না পেয়ে গেল। জানলার কাছে পাওয়া চিঠিটা পাখিদেরই, সে বিশ্বাস করে। মা এসে দাদাকে বকা দিয়ে সরিয়ে নিয়ে গেল, তাই না হলে সে ঝগড়া করে সেটা প্রমাণ করতই করত।

মিতালী ঠিক করল একা-একা নিজের মনে থাকবে। যারা তাকে বিশ্বাস করে না তাদের সঙ্গে কথা নেই। সে জোড়াদিঘির জলের ধারে মাছরাঙ্গা, পানকৌড়ি, বকদের লক্ষ্য করতে থাকল। পোস্ট না করে অন্য কোনো উপায়ে পাখিদের চিঠি পাঠানোর কথা ভাবল। একসময় বর্ষা পার হয়ে পুজো এল। পুজো মানে তো নতুন জামা, ঠাকুর দেখা, ঢাকের বোল, মজা আর আনন্দের উৎসব। রাগ-দুঃখ ভুলে আবার সবার সঙ্গে ভাব হয়ে গেল মিতালীর। এটা তো এক সঙ্গে হৈচৈ করারই সময়।

ঠাকুর বিসর্জনের পর বিজয়ার নাড়ু খাইয়ে দাদা বলল, আরে বোকা, পিয়নের কাছে তোর কীর্তি শুনে আমিই চিঠিটা লিখে জানলা দিয়ে ফেলেছিলাম। বিশ্বাস না হয় আমার বাঁ হাতের লেখা মিলিয়ে দ্যাখ।

দাদার কথায় মিতালীর কাছে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল। সে দুঃখ পাবে বলে মা, দাদাকে এতদিন আটকে দিয়েছিল। তাই দাদা আসল খবরটা বলেনি। মিতালী ঘরে এসে কিছুক্ষণ ফুঁপিয়ে কাঁদল। চিঠিটা বার করে জানালা দিয়ে ফেলে দিল। সে সত্যিই বোকা। অন্যরা চালাক।

পুজোর পরে মনখারাপের দিনগুলো পার হয়ে হেমন্তকাল শেষ হতে চলল। ওদিকে একটু হিম পড়ল, কী পড়লনা ঠাণ্ডা আসবে, দিঘির দিকে জানলা বন্ধ, কি ঝামেলা! বাড়ির লোকগুলো না বড়ো বেশি সাবধানী। সকালবেলার পরিবেশ, হাওয়া বাতাসের ছোঁয়া একটু আধটু না নিলে চলে। তাই মিতালী ব্রাশ করতে করতে ছাদে গিয়েছিল চুপি চুপি। হলুদ রঙের রোদ মেখে তরতাজা চারপাশ। মিতালী ঘুরে ফিরে দেখছিল। বাইরের রাস্তা দিয়ে দুধওয়ালা, কাগজওয়ালা সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। সামনের ইলেক্ট্রিকের তারে বসে কাকটা ক-ক থেকে গম্ভীর করে খ-খ ডাকতে শুরু করল। মিতালী চমকে তাকাল কাকটার দিকে। খ-খ মানে কি খবর? আরে কোত্থেকে আরেকটা কাক ঠোঁটে একটা কাগজ নিয়ে ছাদে বসল। একটু ঘুরঘুর করে মিতালীকে দেখে সেটা ফেলে দিয়ে উড়ে পালাল। মিতালী কাগজটা কুরিয়ে নিল। এটা তো সেই দাদার ফাজলামি করে লেখা চিঠিটা। যেটা সে জানালা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল মনের দুঃখে। এটা কি করে আবার ছাদে এল? মিতালী তবু একবার খুলে পড়তে থাকল। ক্যাঁক-ক্যাঁক, প্যাঁক-প্যাঁক। কি আশ্চর্য! চিঠির শব্দগুলো কানে শুনতে পেল সে। মিতালী ঘাড় তুলে আকাশে তাকাতেই হতবাক হয়ে গেল! একদল বালীহাঁস তার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে জোড়াদিঘির দিকে যাচ্ছে।

কয়েক দিন পর দিঘির পাড়ে অনেক লোক জমল। দিঘিতে কত রকমের পাখি এসেছে। যারা পাখি ভালোবাসে তারা রায়নোকুলার, ক্যামেরা আর পাখি চিনিয়ে দেবার বুকস অফ বার্ড নিয়ে দিঘির পাড়ে টো-টো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। খোদ্দের আছে দেখে ঢেঁকুর হোটেলের কুক কিসমিস দেওয়া খাবারের প্যাকেট বেচতে এল। আর টাকা পেয়ে ট্যাঁকে গুঁজতে লাগল। এসব যে হবে তা মিতালীর জানা, পাখিদের চিঠিতে স্পষ্ট করে লেখা ছিল। মিতালী মহানন্দে বাড়ির দিকে পা বাড়াল। আজ দাদাকে সে ছাড়বে না। দাদা কেন চিঠি নিয়ে মিথ্যে বলেছিল! বদমাশ ছেলে!

দিঘির মালিক মল্লিকদাদু জামায়াতের মধ্যে মিতালীকে দেখিয়ে বলছিলেন, এই মেয়েটা পাখি আসার কথা আগেই বলেছিল। আজকের বাচ্ছারা খুব ম্যাচিওর।

মিতালী প্রশংসাটা গায়ে মাখল না। কারণ সে জানে চিঠিতে ম্যাচোর লিখে পাখিরা আগেই তাকে ম্যাচিওরিটির সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছে।

 

অলংকরণ-অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা ।। জানুয়ারি ২০১৩

 

Topic : Story of environment in Bengali, Story of the migratory bird, Best stoey of children, পরিবেশের গল্প, পরিযায়ী পাখির গল্প

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ