Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

মুক্তচিন্তার আধুনিক মানুষ ।। পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

দারুণ মেধাবী। তখন তিনি নিতান্তই শিশু। ওই শিশু- ওই শৈশবেই তাঁর মেধার পরিচয় মেলে। সকলেই বিস্মিত, এইটুকু ছেলে, তাঁর এত বুদ্ধি।

বাবা মন দিলেন ছেলেকে গড়ার কাজে। বালক বয়সেই সংস্কৃত শিখতে সাহিত্যে তাঁকে পাঠালেন কাশীতে। কয়েক বছরের মধ্যে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে পণ্ডিত হয়ে উঠলেন। সংস্কৃতের পর ফারসি। ফারসি শিখতে তাঁকে পাঠানো হল পাটনায়। অল্পদিনের মধ্যেই ফরাসিতেও পাণ্ডিত্য অর্জন করলেন। তখন মাত্র চোদ্দ-পনের বছর বয়স, রীতিমতো পণ্ডিত হয়ে গ্রামে ফিরে এলেন তিনি। সেসময়ে সংস্কৃত আর ফারসি ভালো করে শিখলেই সমাজে উচ্চশিক্ষিত হিসাবে বাড়তি মর্যাদা পাওয়া যেত। ফারসি জানলে সরকারি চাকরিও হয়ে যেত। কৈশোরে তাঁর ইংরেজি শিক্ষা হয়নি। হয়েছে পরবর্তীকালে।

দেবদেবীর পুজোয় বিশ্বাস ছিল না। ছিলেন মুক্ত মনের মানুষ। তখন চারপাশে অশিক্ষার অন্ধকার। জাঁকিয়ে বসেছে কত কুসংস্কার! এসব তাঁকে খুব কষ্ট দিত। বেদনায় ভরে উঠত মন। একদিন এমন এক ঘটনা ঘটল যা তার বেদনা আরও বাড়িয়ে দিল। প্রতিজ্ঞা করলেন, যেভাবেই হোক এই কুপ্রথা বন্ধ করতে হবে। কি ঘটেছিল সেদিন, সে কথাই বলি।

দাদা জগমোহনের স্ত্রী অলকমনি তাকে ভীষণ ভালবাসতেন। মনে হত বৌদি নন, মা যেন! মায়ের মতো ভালোবাসায়, স্নেহ-সুধায় তাঁর জীবন ভরিয়ে দিয়েছিলেন। দাদা জগমোহন হঠাৎই মারা গেলেন। অলকমনি দেবী সতী হতে চাননি। কে আর মরতে চায়! সকলেই তো বাঁচতে চায়! তিনিও বাঁচতে চেয়েছিলেন। তাঁর বাঁচার আকুলতা অগ্রাহ্য করে ঢাকঢোল পিটিয়ে তোলা হয় চিতায়। শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে অসহায় এক নারীকে পুড়িয়ে মারার তোড়জোড় চলছে, সেই অসহায় নারীটি আর কেউ নন, তাঁর প্রিয় বৌদি। এই খবর পেয়েই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন। গিয়ে দেখলেন মানুষ পৈশাচিক উল্লাসে মত্ত। তিনি একা তাদের এই উল্লাস বন্ধ করবেন কিভাবে! বড়ো অসহায় লাগে, পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন চিতার পাশে। ভয়ঙ্কর এই দৃশ্য ছল-ছল চোখে দেখতে দেখতে সেদিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যেভাবেই হোক সতীদাহ প্রথা বন্ধ করবেন। তাঁর বৌদি অলকমণির মতো কতশত মেয়েকেই তো পুড়ে মরতে হয়। আর তাদের পুড়ে মরতে হবে না!

কে এই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, জানি, আলাদা করে তার নাম বলার প্রয়োজন নেই। তবুও বলি, তিনি রাজা রামমোহন রায়। হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায়ের জন্ম। পিতা রামকান্ত রায়, মাতা তারিণী দেবী।

রামমোহন ছিলেন মুক্ত চিন্তার আধুনিক মানুষ। প্রিন্স দ্বারকানাথ ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। লর্ড বেন্টিঙ্কের সঙ্গে রামমোহন মেয়ের পরিচয় করিয়ে দেন রামমোহন লর্ড বেন্টিঙ্ককে সতীদাহ কতখানি যুক্তিহীন, তা বোঝাতে পেরেছিলেন। ফলে আইন করে সতীদাহ বন্ধ করা সম্ভব হয়।

রাজা না হয়েও রাজার সম্মান পেয়েছিলেন রামমোহন। রাজার সঙ্গে দেখা করতে ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন তিনি। পাঠিয়েছিলেন দিল্লির বাদশাহ। রামমোহন সেখানে পেয়েছিলেন রাজার সম্মান। বিপুলভাবে সংবর্ধিত হয়েছিলেন তিনি। ফরাসি সম্রাট লুই ফিলিপও তাঁকে সংবর্ধনা জানিয়েছিলেন। নিজের দেশে গোঁড়া ব্রাহ্মণদের দ্বারা ধীকৃত ও নিন্দিত হয়েছেন। দেবতার নামে পুতুল পুজোয় তিনি অবিশ্বাসী, রদ করতে চান সতীদাহ- এসব অনেকেই মেনে নিতে পারেননি। নানা ভাবে অসম্মান করেছে। এমনকি রামমোহনকে খুন করারও হুমকি দেয়া হয়েছিল। কুৎসিত গান বেঁধে তাঁর বাড়ির সামনে সারাক্ষন গাওয়া হয়েছে। স্বদেশে তিরস্কৃত হলেও ওদেশে তিনি সত্যিই রাজার সম্মান পেয়েছিলেন।

আট দিনের জ্বরে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭শে সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে রামমোহন রায়ের মৃত্যু হয়। বাংলা গদ্য সাহিত্যেও স্মরণীয় অবদান রয়েছে। অনেকগুলি বই লিখেছিলেন তিনি। বাংলা ভাষায় লেখা তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় তিরিশটি।

 

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা। ১৫ই আগস্ট ২০১২

Topic : Biography of Rammohon Roy in Benglai


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ