Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

মৌটুসীর পরিবার ।। সুভাষ সুন্দর মুখোপাধ্যায়



তোচো ও তানা দুই ভাই বোন। তোচো বড়ো, তানা ছোটো। তোচো দুষ্টু হলেও পড়াশোনায় ভালো। খেলাধুলাতেও ভালো। ভালো দাবা খেলে, আবার পাড়ার সব বন্ধু মিলে যখন গোল্লাছুট খেলে, তখন ওকে কেউ ছুঁতে পারে না।

বাবা-মা তো তোচোর দুষ্টমিতে অতিষ্ঠ। কখনো ফড়িং-এর পিছনে দৌড়চ্ছে, তো কখনো আবার কারো সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ফিরছে।

তানা খুব শান্ত মেয়ে। ও পড়াশোনা করে, একা-একা রান্নাবাটি খেলে, কোনোদিন ওর পুতুলের বিয়ে তো কোনোদিন জন্মদিন।

ওদের বাড়ির চারপাশটা খুব সুন্দর। নানান ধরনের গাছপালায় ভর্তি। ওদের বাবা-মা গাছপালা খুব ভালোবাসে। জবা, টগর, গাঁদা, গোলাপ, শিউলি, রঙ্গন, কাঞ্চন প্রভৃতি ফুলের গাছ তো আছেই। সাথে আছে কাঁঠাল, সুপারি, আম গাছও।

তানা-বাবা-মা মিলে গাছেদের যত্ন করে। কেউ গাছের পাতা-ফুল ছিঁড়লে তানার রাগ হয়। তানা অবশ্য ওর পুতুলের খাবার তৈরীর জন্য মাঝেমধ্যে পাতা ছেঁড়ে। কোনোদিন গাঁদা ফুলের চচ্চড়ি, কাঞ্চন ফুলের ভাজা আবার কখনো আম গাছের পাতার বিরিয়ানি তৈরি করে।

ওদের যেখানে পড়ার ঘর তার ঠিক সামনেই আছে সাদা টগর গাছটা। ঠাকুমা লাগিয়েছিল। অনেক পুরনো, মোটা কাণ্ড। তানা আর ওর মা সকালে ঝুড়ি ভরে টগর ফুল তোলে।

তোচোর এসব পছন্দ না। সে ফুলের করে ছিঁড়ে ফেলে, পাতা ছেঁড়ে, গাছের ডালপালা ভাঙে। কত গাছ যে ও নষ্ট করেছে তার হিসেব নেই। এ জন্য বাবার কাছে কম বকাও খায়নি।

ওদের বাগানে অনেক পাখির আনাগোনা, পুঁচকে টুনটুনি, কিচিরমিচির শালিক, হোঁতকা ছাতারে, চালাক মৌটুসী, টুকটুকে হলদে বেনে বৌ, বকর বকর চড়াই সবাই ওদের বাগানে বেড়াতে আসে।

কয়েকদিন ধরে তানা লক্ষ্য করছে একটা সুন্দর পাখি প্রায়ই টগর গাছটায় আসছে। তানা বাবার কাছে জেনে নিয়েছে ওটা মৌটুসী। এ-ডাল ও-ডাল ঘুরছে, চলে যাচ্ছে, আবার আসছে। কয়েকদিন পর বোঝা গেল মৌটুসীটা বাসা বানানোর জন্য এই টগর গাছটাকেই বেছে নিয়েছে। তানা লক্ষ্য করল, মৌটুসী অনেক খেটেখুটে ওর বাসা সম্পূর্ণ করেছে। বাসা দেখে মনেই হবে না ওটা পাখির বাসা। মনে হবে কি যেন একটা ঝুলছে।

বাসা বানিয়েছে শুকনো নোংরা ঝুল, গাছের আঁশ বা তন্তু দিয়ে। বাইরেটা নোংরা, কিন্তু ভিতরটা গোছানো, ওদের গেটে আবার টুপি পরানো আছে।

মৌটুসীর বাসাটা প্রায়ই পাহারা দিত তানা। কাউকেই বলেনি। দাদাকেও না। তার চিন্তা পাড়ার কালোকে নিয়ে। কালো হলো একটা কুচকুচে কালো বিড়াল।

কয়েকদিন পর তানা লক্ষ্য করল বাসার ভেতর থেকে চিঁ-চিঁ শব্দ আসছে। মানে মৌটুসী'র বাচ্চা হয়েছে। আনন্দে তানার মন নেচে উঠল।

বাচ্চাটা বড়ো হবে, মা বাচ্চাকে খাওয়াবে, গান শুনিয়ে ঘুম পাড়াবে। তারপর একটু বড়ো হলেই মা-বাবা বাচ্চাকে উড়িয়ে নিয়ে কত দূরে চলে যাবে! তখন কি আর মৌটুসী এই বাসা চিনতে পারবে! আমাদের এই টগর গাছটাকে মনে থাকবে! এসব ভেবে তানার মন উদ্বেল হয়ে উঠল।

হঠাৎ বাজ তানার মাথায়। বাবা নাকি টগর গাছটা কেটে ফেলবে, অনেক পুরনো গাছ তোডালপালা-পাতায় এলাকা নোংরা হয়ে থাকে, ওখানে বাবা পলাশ গাছ লাগাবে।

তানা তখন কি করবে? বাবাকে বারণ করবে? বাবাকে বললেই যদি তোচো টের পেয়ে যায়! পুঁচকে বাচ্চাটার কথা তো ভাবতে হবে! আর ক-টা দিন গেলেই না হয় গাছটা কাটুক।

সাত-পাঁচ ভেবে তানা ওর বাবাকে সব বলল। বাবা বলল, ঠিক আছে।

কিন্তু তোচো সব শুনে ফেলল। ও ঠিক করল, কালকেই বাচ্চাটাকে ধরে ডানাটাকে টানটান করে মেলে সুতো দিয়ে বাঁধবে, তারপর উড়িয়ে দেবে। যেই উড়বে অমনি ঘুড়ির লাটাইয়ের মতো সুতো ছেড়ে আবার গুটিয়ে নেবে। বাচ্চাটা যত চিঁচিঁ করে ডাকবে, ও ততই আনন্দ পাবে।

তানা চমকে উঠল, মুখ শুকিয়ে গেল, কি সর্বনাশ! তানা ঠিক করল এসব কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। মৌটুসী আমাদের অতিথি, ওর বাচ্চা আমাদের প্রিয় জন, বাচ্চাটার জন্ম আমাদের বাগানে, ওকে বড়ো হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকতে দিতে হবে। এসব ভেবে তানা মা-বাবাকে সব খুলে বলল।

মৌটুসীর বাচ্চাটাকে ধরার জন্য হাতে সুতো, দড়ি, লাঠি নিয়ে এগোচ্ছে। আরেকটু গেলেই পৌঁছে যাবে সাদা ফুলে ফুলে ভর্তি টগর গাছের কাছে। তোচো এগোচ্ছে! এক-পা দু-পা এমন সময় বাবা প্রায় লাফ দিয়ে ধরে ফেলল তোচোকে। আসলে বাবা-মা তানা সবাই খুব তক্কে-তক্কে ছিল। তোচো ওদিকে গেলেই ধরে ফেলবে।

তোচো তো অবাক!

পাছে ওখানে চিৎকার-চেঁচামেচিতে মৌটুসীর বাচ্চা ভয় পায়। তাই বাবা তোচোকে ধরে নিয়ে সোজা ঘরে। বাবা জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাচ্ছিলি?

তোচো বলল, পাখির বাচ্চা ধরব বলে।

এবার বাবা-মা শান্তভাবে তোচোকে বুঝিয়ে বলল, যে এটা ঠিক হচ্ছিল না। আশ্চর্য! তোচো তার ভুল বুঝতে পারল।

মা মৌটুসীও যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

তানার বেশ সুবিধে হল পাহারাদার বাড়ল। এখন দুইভাইবোন মিলে পাহারা দেয়। একদিন কালো বেড়াল আক্রমণ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু তোচো আর তানা মিলে তাকে এমন তাড়া করল যে সে ভুলেও আর এদিক মাড়াবে না। মা মৌটুসী তার বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করল, কিরে ভয় করছে?

বাচ্চাটা চিঁ চিঁ করে জানালো, হ্যাঁ মা ভয় করছে।

মা মৌটুসী তখন তাকে বলল, আর কটা দিন সবুর কর, উড়তে শিখে যাবি। তখন কালো বেড়াল তাড়া করলেও আর ভয় থাকবে না। অন্য কোথাও উড়ে চলে যাব সবাই মিলে।

একথা শুনেই ওরা দুইভাই-বোন মা মৌটুসীকে বলল, তোমাদের কোনো ভয় নেই, আমরা তোমাদের বাসা পাহারা দিই, খেয়াল রাখি, যাতে কেউ কোনো ক্ষতি করতে না করতে পারে।

অবাক হয়ে মৌটুসী ওদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালো। বলল, তোমাদের কি বলে যে ধন্যবাদ জানাব।

তানা কিছু বলার আগেই তোচো বলল, আমি আর তোমাদের বাসা ভাঙব না, বাচ্চাও ধরব না।

এর কয়েকটা দিন পর খুব ভোরে সূয্যিমামা সবে উঠব উঠব, সকালে হালকা ঠাণ্ডা হাওয়া, বাগান থেকে নানা ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে, ফুলে ভর্তি রঙ্গন গাছটা মাথা নাড়ছে, বোগেনভেলিয়াগুলো সেজে রঙিন। তোতা-তানা মা-বাবাকে জড়িয়ে শুয়ে ঘুমে মগ্ন। এমন সময় জানলায় দেখল মা মৌটুসী ও বাবা মৌটুসী ওদের ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে বারান্দার গ্রিলের উপর বসে আছে।

মৌটুসীর ডাকে তোচো-তানার ঘুম ভেঙে গেল। কী আনন্দ ওদের। ছোট্ট বাচ্চাটা উড়তে শিখে গেছে।

মা মোটুসী বলল, তোচো ভাইটি, তানা বোনটি তোমাদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই, তোমাদের কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি। আমরা আজকেই অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। তোমরা ভালো থেকো।

একথা শুনেই দুষ্টু তোচোর দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল, কাঁদতে লাগল তানাও। চিঁ চিঁ করে কাঁদছে ছোট্ট বাচ্চা মৌটুসীও।

ওরা দুইভাইবোনে বলল, তোমরা আবার এসো, তোমাদের জন্য আমাদের ভীষণ মন খারাপ করবে।

হুস করে উড়ে গেল ছোট্ট বাচ্চাটাকে নিয়ে বাবা-মা মৌটুসী।

তোচো-তানার বাবা-মা জেগে দেখল ওদের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। ওরা বাবা-মাকে বলল মৌটুসীদের কথা। তানা বলল, বাবা কালকেই টগর গাছটা কেটে ফেলো।

ওদের বাবা-মা ওদেরকে খু-উ-ব আদর করে বুকে জড়িয়ে ধরে আবার শুয়ে পড়ল।

আবার যখন ঘুম ভাঙল তখন সকাল হয়ে সূয্যিমামা লাল টুকটুক।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ফেব্রুয়ারি ২০১৩

Topic : The Story of Environment in Bengali

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ