Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

পুতুল খেলার ইতিকথা ।। কৌশিক রায়


ছোট্ট শ্রেয়ার বয়স আজ পাঁচ বছরে পড়ল। সকাল থেকেই তাই শ্রেয়ার জন্মদিন পালন করার জন্য খুব তোড়জোড় শুরু হয়েছে। শ্রেয়ার বড়ো মামা এসে শ্রেয়াকে একটা গিফ্ট-এর প্যাকেট দিলেন। শ্রেয়া উপহারের ঝকমকে মোড়ক খোলা মাত্র বেরিয়ে এল একটা সুন্দর ফ্রক পরা ডল পুতুল।

-ওমা! কি সুন্দর পুতুল বড়োমামা। শ্রেয়ার আনন্দ আর ধরে না।

-বাঃ তোমার আজ জন্মদিন না তাই তো তোমাকে এই বুনুর মতো একটা পুতুল দিলাম। হেসে বললেন বড়োমামা।

-আচ্ছা বড়োমামা, শ্রেয়া বলল- আমাদের জন্মেরও বহু আগে তো অনেক মানুষ ছিলেন। তাদের ছেলে মেয়েরা কি এই ধরনের পুতুল নিয়ে খেলতে?

-না না! মোটেই তা নয় শ্রেয়া মা। বিভিন্ন সময়ে নানা দেশে নানারকমের পুতুল তৈরি করা হয়েছে। আসলে মানুষ যেরকম জীবন-যাপন করে সেরকম জামা কাপড় পরে, খাবার খায়, গান-বাজনা করে, পড়াশোনা করে সেই সব জিনিস দেখেই কিন্তু কারিগররা পুতুল বানান। -বললেন বড়োমামা, আমাদের রাজ্যের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরের মাটির পুতুল যে এখনো বিখ্যাত এ কথাতো জানোই। হরপ্পা মহেঞ্জোদারো শহরের ধ্বংসাবশেষ থেকেও পাওয়া গেছে আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে তৈরি হওয়া পোড়া মাটির খেলনা, গরুর গাড়ি, কুকুর, রান্নার হাঁড়ি-কুড়ি, পাখি ইত্যাদি। আজ যেখানে উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ দুটির মধ্যে মেক্সিকো এল সালভাদোর, হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, বেলিজ, কোস্টারিকার মতো ছোটো দেশগুলো আছে, সেখানে যিশুখ্রীস্টের জন্মের বহু হাজার বছর আগে আজটেব, ইনকা আর মায়া উপজাতির বুদ্ধিমান মানুষ গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল সভ্যতা। সেই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গেছে গ্রানাইট আর ব্যাসল্ট পাথর, জেড পাথর আর প্রবাল এবং চিনামাটি বা পার্সেলিনের তৈরি অনেক সুন্দর খেলনা পুতুল। হোয়াংহো আর ইয়াংসিকিয়াং নদী তীরে গড়ে ওঠা চৈনিক সভ্যতা, টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তটে গড়ে ওঠা মেসোপটেমীয় (ইরাকীয়) সভ্যতা, গ্রিক সভ্যতা আর তিবের নদীর তীরে গড়ে ওঠা রোম সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে মিলেছে বিভিন্ন ধাতু, গালা আর পোড়ামাটির তৈরি খেলনা। ইত্যাদি দেশের অন্তর্গত ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির গরম লাভা স্রোতে একসময় চাপা পড়ে যাওয়া কম্পেই আর হারকিউলেনিয়াম নগরী দুটি ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা খেলনাগুলো দেখে ঐতিহাসিক আর পুরাতত্ত্ববিদেরা জানতে পেরেছেন- ওই নগরী দুটির জীবনযাত্রা কেমন ছিল।

শ্রেয়াকে তার বড়োমামা পুতুলদের সম্পর্কে আরও অনেক কথা নিশ্চয়ই বলেছিলেন। তবে, আমাদের বোধহয় একটু জেনে রাখা ভালো আমাদের জন্মভূমি ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে কত রকমের পুতুল তৈরি করা হয়। ওইসব পুতুলদের দেখলেই বুঝতে পারবে আমাদের এই বিশাল ভারতমাতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে স্বদেশী কবি অতুলপ্রসাদ সেন কেন বলেছিলেন, ''নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান।''

পোড়ামাটি বা টেরাকোটা, কাঠ, ঘাস বাঁশের টুকরো নলখাগড়া, শোলা, থার্মোকল আর শক্ত কাগজ দিয়ে নানা রকমের পুতুল তৈরি করেন ভারতের অনেক কারিগর। রাজস্থানের অন্তর্গত যোধপুর জেলার নাগৌর গ্রামের কুমোররা ভারতের লোককথা আর পুরাণের নানা চরিত্রের চেহারা, পশু-পাখি আর মানুষের আদলে মাটির পুতুল বানিয়ে থাকেন। আজকাল আবার মাটির মোটরবাইক, বাস, এরোপ্লেন আর অটোরিকশাও বানাচ্ছেন তারা।

উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্ণৌ শহরে থাকেন একদল কুমোর। ওঁরা এখন শুধু পোড়ামাটি দিয়ে রং করে ফল আর শাক-সবজির মডেল তৈরি করেন। এছাড়া তাঁদের হাতের সুন্দর শিল্পের ছোঁয়াতে গড়ে ওঠে মানুষ আর পশু পাখির ছোট্ট বা মিনিয়েচার পুতুল। নিজেদেরকে এই কুমোরেরা গর্ব করে বলে থাকেন, খিলোনেওয়ালো। তোমরা যদি কখনো তাদের কাছে যাও তাহলে বুঝতেই পারবে না, আসল আর নকল ফল কোনগুলো। ওই কুমোরদের তৈরি মাটির ফলকে আসল ভেবে খেতে গিয়ে বেজায় ঠকেছেন অনেকেই।

উত্তরপ্রদেশের বেনারসে কাঠের তৈরি লাট্টু আর খেলনার রান্নাঘরের জিনিসপত্র খুবই নামকরা। বিদ্যুৎচালিত লেদ মেশিনের সাহায্যে কাঠ খোদাই করে ওইসব খেলনা বানান লক্ষ্ণৌ-এর কারিগররা। কর্ণাটক রাজ্যের চেন্নাপত্তন, রাজস্থানের অন্তর্গত উদয়পুর, গুজরাটের মাহাভা আর মধ্যপ্রদেশের বিধানিঘাট গ্রামের অসংখ্য ঘরে কাঠের উপর রং করা খেলনা তৈরি করা হয়। রাজস্থানের বাক্সি গ্রামের টুকরোর ওপর রং করে আর পাতলা কাঠের সাহায্যে সৈনিক মা ও ছেলে পশুপাখি, দেবদেবীর পুতুল বানানো হয়। অন্ধ্রপ্রদেশের কোন্দাপল্লী গ্রামের কারিগররা কাঠের তক্তার ওপর সুন্দর রংয়ের কাজ করে ফুটিয়ে তোলেন হাট-বাজার, পঞ্চায়েত সভা-সমিতির দৃশ্যকে। এছাড়া জেলে আর সার্কাসের কসরৎ দেখানো মানুষ বা অ্যাক্রোব্যাট-এর পুতুলও বানিয়ে এই গ্রামের মানুষেরা নাম করেছেন।

মহারাষ্ট্রের সাওয়ান্তওয়াদি গ্রামের কারিগররা আবার বিখ্যাত হয়ে ছেন কাঠের টুকরোর ওপর রং করে বিভিন্ন ফল আর শাক-সবজির মডেল বানিয়ে। ওড়িশার অন্তর্গত ময়ূরভঞ্জ, কেওনঝড়, ভুবনেশ্বর রৌঢ়কেল্লার বিভিন্ন গ্রামেও এই ধরনের কাঠের পুতুল বানানো হয়। স্থানীয় স্কুলগুলোতে প্রায়ই কর্মশিক্ষার পড়ার জন্য ওইসব পুতুল কেনা হয়।

পাঞ্জাবের অমৃতসরের শহরতলিতে বাস করেন একদল খেলনা তৈরির কারিগর। সারকাণ্ডা নামের এক ধরণের ঘাস দিয়ে তাঁরা বানিয়ে থাকেন বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের খেলনা। আবার বিহারের মধুবনীতে বসবাসকারী মহিলারা, সিককি নামক এক ধরণের স্থানীয় সোনালী রঙের ঘাসের রঙ মিশিয়ে বানিয়ে থাকেন বিভিন্ন দেবদেবী, মানুষ, গাছপালা, পশু-পাখি খেলনা। শোলা দিয়েও নানা ধরনের খেলনা তৈরি হয় অসম আর পশ্চিমবঙ্গে। কাগজকে দলা করে মণ্ড বানিয়ে তার সঙ্গে নানা রং মিশিয়ে বিভিন্ন 'পাপিয়ের মাশে' পুতুল তৈরি করা হয় চেন্নাই আর ওড়িশার রঘুরাজপুরে। এই ধরনের পুতুলগুলোর মাথা খুব সুন্দরভাবে দোলানো যায়। আসলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ-এর টানের সামঞ্জস্য বজায় রাখতেই এই ধরণের পুতুল বানানো হয়। উত্তর প্রদেশের আগ্রাতেও এই ধরণের খেলনা বা 'পাপিয়ের মাশে' পায়রা আর তোতা পাখি তৈরি করা হয়। অনেক সময় পুতুলগুলোর সাহায্যে রবার আরে স্প্রিংয়ের টুকরো লাগানো হয়। এর ফলে বেশ নড়াচড়া, লাফালাফি করতে পারে পুতুলগুলো। মাটি আর কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি মাছের মডেলে সুতো ঝুলিয়ে বেশ মজা করে দোলানো যায় কিন্তু। এছাড়া কেন্দ্রাতিগ বলকে (সেন্ট্রিপিটাল ফোর্স) কাজে লাগিয়ে কাগজ আর তালপাতা দিয়ে নাচুনে পুতুলও বানানো হয় পশ্চিমবঙ্গ আর বারাণসীতে।

গরুর গাড়ির মতো দেখতে প্রচুর শুকিয়ে নেওয়া নাড়িভুঁড়ি, বেত বা কঞ্চি আর মাটির সরা কে নিয়ে একসময় বানানো হতো একটি বিশেষ ধরণের খেলনা। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, পুরুলিয়া, বীরভূম জেলাগুলিতে এক সময় এই খেলনাটির খুব প্রচলন ছিল। এছাড়া নল-খাগড়া ডাল, মাটির চাকা আর সাইকেলের বাতিল হওয়া টায়ার টিউব এর টুকরো দিয়ে ভারতের প্রায় সব জায়গাতেই বানানো হয় সাপ পুতুল। মাটির চাকা আর স্থিতিস্থাপক টায়ার-টিউবের অংশ থাকার জন্য অবিকল জ্যান্ত সাপের মতো নড়া চড়া করানো যায় এই খেলনাটিকে। আসলে জানো কি! এই সাপ খেলনার চলাফেরার পিছনে আছে সম্পূর্ণ বিজ্ঞান নির্ভর উপায়ে স্থিতিস্থাপক স্থিতি শক্তির প্রকাশ, ভরভেগ এবং ত্বরনের প্রভাব।

তোমাদের মতোই ছোট্ট, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা ভাই-বোনেরাও দারুণ সব পুতুল বানাতে পারে। এই কাজের জন্য তারা ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া জিনিস। যেমন ধরো- কাগজের টুকরো, দর্জির দোকানের কাপড়ের ফালি, বোতাম, গাছের পাতা, ফাঁকা দেশলাই বাক্স, ব্যবহৃত দেশলাই কাঠি, বোতলের ছিপি, দড়ির টুকরো আর ছোট্ট তালের পাতা দিয়ে বাঁশের টুকরো আর ফাঁপা বীজের মিশেল ঘটিয়ে এক ধরণের হাতপাখাও বানায় সেই শিশু খেলনা শিল্পীরা। তোমরা যদি কখনো কলকাতায় জহরলাল নেহেরু চিলড্রেনস মিউজিয়ামে যাও তাহলে দেখবে সেখানে ভারতের হরেকরকম আর নানা দেশের কত রকম পুতুল রাখা আছে। তাদের বন্ধু হতে একদমই তখন আর দেরি হবে না তোমাদের।

 

তথ্যসূত্র :

১. Jbnior Encyclopacdia Britannica

২. Toys and Tales- Sudarshan Khanna

৩. গ্রন্থাগারিক ও কর্মীবৃন্দ- মিলনি টাউন ক্লাব গ্রন্থাগার, গঙ্গারামপুর, দক্ষিণ দিনাজপুর

 

প্রকাশিত- ছেলেবেলা ।  শরৎ ১৪১৬

Topic : The story of puppetry

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ