![]() |
কারণ, গল্প করার মতো কিছু থাকলে তবেই তো গল্প বলা যায় একটা। তাই পুঁচকে মেয়েটা যে কোন গ্রাম থেকে কবে কখন মায়ের কোলে কোলে শহরে এসে পড়েছিল, কেউ তেমন খেয়ালই করেনি কোনোদিন!
আর খেয়াল করবেই বা কে?
এতো আর পুজার মামাবাড়ির গ্রাম নয়।
কোতলপুরের লেগোর সাঁতরাদের বাড়ি বললে সব্বাই না হোক, কিছু কিছু লোক তো চিনবে।
তবে বাবার বাড়ি না হোক, লেগো গ্রামেই পূজার মামাবাড়ি।
আসলে বাবাকে তো কখনও দেখেনি পূজা। কোন ছোটো থেকেই তাই মামাবাড়িতে মানুষ হচ্ছিল মেয়েটা। মানে হাঁটতে-ছুটতে শিখছিল। তার মধ্যেই কিনা ঝগড়া বাধল মায়ের সঙ্গে।
একে তো মামাবাড়ী দারুণ গরিব। তার ওপর বাবা না থাকলে যেমন হয়।
কেউ আজকাল সহজে আর দায়িত্ব নিতে চায় না কারো।
তার ওপর পুঁচকে একটা মেয়ে। দেখতে দেখতে ডাগর হয়ে যাবে। তখন বাধবে একশো রকম ঝামেলা।
দাদু-দিদা কিছু না বললেও মামারা প্রায় রোজই একবার করে খটাখটি করত মায়ের সঙ্গে।
পূজা অবশ্য তখনও ভর্তি হয়নি কোনো ইসকুলে।
আর ভর্তিই বা হবে কি! ওকে দেখলেই সব্বাই কেমন আহা-উহু করে! সবার শুধু সেই এককথা। আহারে! ওর বাবা নেই জানিস!
শুনতে শুনতে এক এক সময় পূজারও কেমন মনে মনে রাগ হত বাবার ওপর।
সবার আড়ালে হয়তো মামাবাড়ির ভোমরা তালের গাছটায় মাথা ঠেকিয়ে বলত-
-কেন? তুমি নেই কেন! ও বাবা-বাবা-
তাল গাছটাও বোধ হয় বোকা মেয়েটার কাণ্ড দেখে থম মেরে থাকত সে সময়। আহারে! পূজা যে বাবাকে কোনোদিন দেখেইনি। কেমন যে দেখতে ছিল মানুষটা- ঠিক কার মতন, শুধু মা কেন, মামাবাড়িরও কেউ কোনোদিন কিছু বলেনি পূজাকে।
অথচ মাঝে-মাঝেই বাবার জন্য মনটা কেমন হু-হু করে পূজার।
কান্না পায়। তবু কখনো কাঁদতে পারে না সবার সামনে। তাহলেই মা কেমন মুখ ঝামটা
দিয়ে উঠবে। বলবে, সব্বার কি বাবা
থাকে নাকি?
কিন্তু কি আশ্চর্য! মাকে কখনোই একথা বোঝাতে পারে না পূজা। যে, এইতো মামাবাড়ির এত বড়ো একটা গ্রাম লেগো। কত রকম পাড়া। কত রকম বাড়ি। সব বাড়িতেই বাবা আছে কেমন। ছেলে-মেয়েরা বাবার সঙ্গে চড়কের মেলায় যায়। বাবা কত কী কিনে দেয় মেয়েকে। শেষকালে কেমন কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে আসে।
তবু মায়ের মুখে যেন কোনো দুঃখ নেই।
মাঝে মাঝে রাতেরবেলা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে হয়তো বলে ওঠে- আমি তোর মা, আমিই তোর বাবা।
এমন কথা অবশ্য মামাবাড়ির গোটা সাঁতরা পাড়ায় কেউ কখোনো শুনেছে কিনা কে জানে!
মাঝে মাঝে কেমন যেন আনমনা দেখায় পূজাকে।
সেই ছোটো থেকে- এখনও।
অবশ্য কেউ বাবার নাম জিজ্ঞেস করে না সহজে।
জিজ্ঞেস করলেও হয়তো বাবার বদলে মায়ের নামটাই বেরিয়ে যেত মুখ ফসকে।
-ছায়া সাঁতরা!
হ্যাঁ।
শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাবার মতোই মা একদিন পুঁচকে পূজাকে নিয়ে বাসে চেপে বসেছিল কোতুলপুরের।
সে সব কথা এখনও বোধহয় একটু একটু মনে পড়ে মেয়ের।
সঙ্গে ছিল পাড়ারই এক মামা।
বাসে উঠে বলেছিল, গাঁয়ে থাকলে তো না খেয়ে মরবি। তার চে চ ভাই, শহরের দিকে থাকবি। খাটলে দু-মুঠো খেতে পাবি।
তারপর কী হয়েছিল, না। সবটা এখন পুজারও আর মনে নেই।
শুধু মনে আছে, বাস থেকে নেমে তারকেশ্বরে এসে প্রথম ট্রেনে চেপেছিল পূজা। তবু যেন একটুও আনন্দ ছিল না মনে। আহারে! প্রথম কিনা ইলেকট্রিক রেল গাড়িতে চাপছে পূজা। সঙ্গে কিনা বাবা-ই নেই।
অথচ বাবার জন্য দুচোখ যেন উছলে উঠছিল কান্নায়। জানলা দিয়ে বাইরের দিকটায় চেয়েছিল পূজা। তাই মা, কী পাড়ার মামা- কেউই তখন দেখতে পায়নি পূজার চোখ দুটো।
মনে আছে, ট্রেন থেকে নেমেও হাঁটতে হয়েছিল অনেকটা। তারপরেই তো পড়ল টুপু মাসিদের বাড়ি।
দুপুর গড়িয়ে গিয়েছিল তখন। খিদেও পেয়েছিল খুব। তবু মুখ ফুটে কথাটা বলা যাচ্ছিল না কাউকেই।
শেষ পর্যন্ত টুপু মাসির বাবা, যাঁকে দাদু বলে প্রথম প্রণাম করেছিল পূজা। তিনিই তাড়াতাড়ি বললেন, আজ আর চান করার বেলা নেই। তাই আগে তিনজনেই কিছু খেয়ে দেয়ে নাও।
দিদা একটু এগিয়ে এসে বললে, এই মেয়েটার নাম কী?
পাড়ার মামা বোধহয় এবার এবাড়িটা আগে থেকে চিনতেন। তাই দিদা-দাদুকে একটা করে প্রণাম করে বললেন, এ হল পূজা। আর ওর মায়ের নাম ছায়া। এখন থেকে আপনারাই ওদের একটু দেখবেন এই আর কী।
দিদা বললেন, এই তো দেখছ বাবা, আমাদের দুখানা মাত্র ঘর। কষ্ট করে থাকতে হবে একটু। তবে আমারও ছেলে নেই। দুটো মেয়ে। বড়োটার বিয়ে হয়েছে। ছোটোটা অসুখে ভুগে এখনও সেই দুধের শিশু হয়ে আছে। নিজে নিজের কাজটাও করতে পারে না। তাই-
হ্যাঁ।
সেদিন থেকেই মনে আছে, দিদার ঘরের মেঝেতেই পূজা শুয়ে পড়ত মায়ের সঙ্গে।
দাদু বললেন, এটা হল উত্তরপাড়া। কাজের তো অভাব হবে না। শুধু একটু বিশ্বাসী হতে হবে লোকের কাছে। তাহলেই সব্বাই খুঁজবে।
বলতে কী, সত্যিই আর কাজের অভাব হল না পূজার মায়ের।
দিদা একদিন বললেন, এবার একটু বলে দেখ আদ্যাপীঠে। এই মেয়েটার যাতে একটা হিল্লে হয়।
তারপরেরটুকু তো এখন বেশ মনে আছে পূজার।
আদ্যাপীঠে তখনও আছেন বেলামা।
দাদুর ফোন পেয়েই বললেন, পাঠিয়ে দিন ওর মায়ের সঙ্গে। আমরা ওকে ভর্তি করে নিচ্ছি। আপনি ভাববেন না।
সেই যেন প্রথম বাবার একটু গায়ের গন্ধ পেল পূজা। হাওয়ায় হাওয়ায় যেন ভেসে এল বাবার গলা।
-এইতো আমি গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে আছি মা। আয়!তোকে আমি নিজে উত্তরপাড়ার খেয়া ঘাট থেকে পার করে আদ্যাপিঠে পৌঁছে দেব। মন খারাপ করিস না। ওখানে কিন্তু মন দিয়ে পড়বি। আমি কিন্তু সব খবর রাখব দূর থেকে।
পূজা যেন স্বপ্ন দেখছিল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে।
ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারলে, বাবা নেই কে বললে? এই তো আমার মা। বাবার মতোই বুকে আগলে নিয়ে যাচ্ছে আদ্যাপীঠে। সেখানেই এখন থাকা-খাওয়া আর পড়া।
এখনও বেশ সে সব দিনের কথা অনেকটাই মনে আছে পূজার।
একটা করে ঘর। আর চারটে করে চৌকি। চারজন করে মেয়ে থাকবে।
খাওয়া-দাওয়া নিরামিষ হলেও দিব্যি কেমন অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল ক-দিনে। ইসকুলটা ছিল আশ্রমের কাছাকাছি। মা যেত প্রতি রবিবার বিকেলে। তখনই মেয়ের জন্যে এটা-সেটা কিনে দিয়ে আসত মাঝে-মাঝে।
শুধু গরমে আর পুজোর ছুটির কদিন মায়ের সঙ্গে মামাবাড়ি লেগোয় ঘুরে আসতো। উত্তরপাড়ায় হয়তো দু-একদিন থাকত মায়ের কাছে।
তার মধ্যেই দাদু আবার সাবধান করতেন মাঝে-মাঝে। বলতেন, দিন দিন তো দেখছি বড্ড বড়ো হয়ে যাচ্ছিস। সাবধানে থাকবে কিন্তু। যা দিনকাল পড়েছে।
কথাটা মামাবাড়ির দিদাও যখন তখন বলত পূজাকে। শুনলে বড্ড রাগ হত পূজার। কেন রে বাবা, মেয়েরা বড়ো হলেই যত দোষ। কই ছেলেদের তো কেউ কিছু বলতে পারে না এমন। মুখ ফুটে অবশ্য এমন কথা পুজা কখনই বলতে পারেনি কাউকেই।
মা শুধু সাবধান করতো আড়ালে-আবডালে। মুখে মুখে খবরদার চোপা করবি না কারোর সঙ্গে। মনে রাখিস, তোর বাবা নেই।
এই 'বাবা নেই' শুনলে এখনও কেমন বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে পূজার। কেমন অসাড় হয়ে আসে হাত-পা। অথচ দেখতে দেখতে সেই পুজাও তো একদিন বড়ো হল বেশ।
বারো ক্লাস পাশ করল আদ্যাপীঠ থেকে। আর নাকি থাকা যাবে না আশ্রমে।
এবার উপায়?
উত্তরপাড়ার দাদু হঠাৎ রেগে উঠলেন ওর মায়ের ওপর। বললেন, আমরা কিন্তু আর এ বাড়িতে রাখতে পারব না তোর অত বড়ো মেয়েকে। তুই বরং ওকে মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দে। মামারা এবার বিয়েটা দিয়ে দিক কোথাও।
অসহায় মা যেন তখন পাথর হয়ে গেল শুনে।
দিদা শুধু ঠাণ্ডা মাথায় যেন একটু থামাতে চাইলেন দাদুকে। বললেন, মামারাও তো বড্ড গরিব। সেখানে গিয়ে কী করবে? তারচে কষ্ট করে এখন এবাড়িতেই থাক। বড়ো হয়েছে মেয়েটা। বাবা নেই বলে কোথায় গিয়ে থাকবে যেখানে-সেখানে।
দাদু তবু থামে না। বলেন, আমার নিজের বাড়িতেই একটা চিররুগ্না অসহায় মেয়ে। আমাদের অবর্তমানে তাকে কে দেখবে তার ঠিক নেই। তার ওপর এসব আদিখ্যেতা-
এই পর্যন্ত পূজাকে নিয়ে গল্পের কোনো 'গ' ছিল না কোথাও।
তবু তো কতরকম কল্পনা। কত রকম আশা, ভরসার স্বপ্ন।
যদি সত্যি সত্যি কোনোদিন একটা ছোট্ট গল্প হয়ে যায় পূজাকে নিয়ে। যদি আদ্যাপীঠের
মা মুখ তুলে চান।
দাদুর আড়ালে বিড় বিড় করেন দিদা। কেউ অবশ্য শুনতে পায় না এসব। মেঝেতে তখন পূজা আর তিন-চার বাড়িতে কাজ সেড়ে আসা ওর মা বেঘোরে ঘুমোয়।
রাত যেন শেষ হতে চায় না সহজে।
কখন যে সকাল হবে কে জানে।
ঘুম ভাঙতে বোধহয় সেদিন একটু দেরি হয়েছিল দাদুর।
তারমধ্যেই কিনা মধ্যমগ্রামের বাসুদেববাবুর ফোন।
-অবনীদা, বিকেলে আমি একবার যাচ্ছি। থাকবেন তো?
দিদা বললেন, এতদিন বাদে উনি হঠাৎ?
দাদু বললেন, কী জানি, কী দরকার।
হ্যাঁ। সেদিন বাসুদেববাবুও যেন একটা আস্ত গল্প পকেটে নিয়ে ঢুকলেন বাড়িতে। গল্পটাও এমন কিছু বড়ো নয়। খুব ছোট্ট গল্প।
একটা ছেলে বাসুদেববাবুর। সুমিত। নিজের ব্যবসা। তার জন্যই ওঁর পূজাকে চাই।
দিদা বললেন, কিন্তু পুজা যে এখন পড়বে বলছে।
-বেশ তো। পড়ুক না।
বাসুদেববাবুর মুচকি একটু হেসে বললেন, কাল থেকে আর অবনীদার নয়, পূজার সব দায়িত্ব আমার। আমি ওকে কলকাতার হোস্টেলে রেখে পড়াব। তারপর বিয়ে।
কথাটা শুনেই চোখ ভিজে এল দাদুর। তবু বললেন, এটাও যে একটা চমৎকার গল্প হয়ে গেল হে। ছোট্ট একটা গল্প।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা ।। মে ২০১৪
Topic : Story of Feeling, The Best Story of Childrens, The story of a girl's life, অনুভবের গল্প
0 মন্তব্যসমূহ