![]() |
অর্জন ছেলেটা খুব ভালো। ওর মতো ভালো ছেলে আর একটাও হয় না। সত্যি-সত্যিই অর্জন ভীষণ শান্তশিষ্ট। অর্জনকে যেই দেখে সেই বলে। তবে ইদানীং অর্জনের মা বলেন, হ্যাঁ ও বাইরের লোকের কাছে শান্তশিষ্ট। একবার আমাদের ঘরে এসে দেখে যাও ও কেমন শান্ত! তখন দেখলে বুঝতে পারবে ও রীতিমতো লেজ বিশিষ্ট।
তবু অর্জন শান্ত। আজ পর্যন্ত স্কুল থেকে কখনও কোনো অভিযোগ আসেনি। ওর প্রায় সব বন্ধুদেরই কোনো না কোনো দিন পেরেন্টস কল হয়েছে। স্কুলের স্যার-ম্যামরাও অর্জনকে পছন্দ করে। অর্জনরা যে ফ্ল্যাটে এসেছে, সেখানে অর্জনের বয়সি আরও চারজন আছে। তারা সবাই এক-একটি বিচ্ছু। এ যদি কথায়-কথায় ঢিল ছোঁড়ে তো আর একজন সিঁড়ি দিয়ে সারাদিন নামছে আর উঠছে। আর একজনের তো প্রিয় বদমাইশি হল যার-তার ঘরে বেল বাজিয়ে ফুরুৎ করে পালিয়ে যাওয়া। না এখানেও অর্জনের নামে কোনো রিপোর্ট হয়নি। তবু যদি অর্জনের মায়ের কাছে বলতে যাও, অর্জন ছেলেটা খুব ভালো, অর্জনের মা কিছুতেই সে কথা মানবেন না।
অর্জনের মা বলেন, হ্যাঁ ও বাইরে কোনো দুষ্টুমি করে না, তবে ঘরে ও মোটেই বাইরের মতো শান্ত শিষ্ট থাকে না। ওর দুষ্টুমি আর দস্যিপনা একটু অন্যরকম।
কী রকম?
তুমি যদি অর্জনের মায়ের কাছে প্রশ্ন করো, তাহলে তোমাকে অন্তত দশটি লিস্ট হাতে-হাতে দিয়ে দেবে। লিস্ট পেয়ে তুমি হতভম্ব হয়ে যাবে। যেমন অর্জন ফ্রিজ থেকে বরফ বের করে হুটহাট খায়। আর তারপরেই বিচ্ছিরি এক কাণ্ড বাধায়। হাতের সামনে কাঁচি পেলেই রাজ্যের কাগজ কাটে, কাগজ কাটতে-কাটতে অনেক সময় বিছানার চাদরও কেটেছে। এসব কথা অর্জনকে জিজ্ঞেস করলে যতই ও না না করুক- এসব কাণ্ড ও হামেশাই করে। আর করতেই থাকে। বিশেষত ছুটির দিনের নির্জন দুপুরবেলায় সে এসব করে। তখন তার বাবা-মা অফিসে।
অর্জনকে যদি বলো, তোমাকে তো ভালো ছেলে বলেই মনে হয়, তাহলে তুমি এসব করো কেন?
তোমার কথা শুনে অর্জন মিটিমিটি করে হাসবে। ওর দুচোখে বিস্তর মজা ঝিলিক দিয়ে উঠবে। এ মজা হল গোপন দুষ্টুমির মজা। এই গোপন দুষ্টুমি ক'দিন আগে পর্যন্ত ছিল না, তখন অর্জন ঘরে-বাইরে দু'জায়গাতেই বেশ ভালো ছেলে শান্তশিষ্ট হয়েই থাকত।
তবে অর্জন এমন পাল্টে গেল কেন?
পাল্টে যাওয়ার কারণ আছে। তবে কারণটা তেমন কেউ জানে না। জানতেও চায়নি কখনও। আর সে কারণটা অর্জনও ঠিক ঠিক জানে না। যেটুকু জানে তা অনুমান করে। আন্দাজ করে নির্জন দুপুরবেলা তাদের ফ্ল্যাটে আরো কিছু কিছু ঘটনা ঘটে। এটা কেউ জানে না। জানে একমাত্র অর্জন।
নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর অর্জনের মা হস্তশিল্পমেলা থেকে দুটো বিশাল সাইজের পোড়ামাটির ঘোড়া নিয়ে এসেছে। ইদানিং অর্জনের বারবার মনে হয় ওই ঘোড়াগুলো নির্জন দুপুরে কেউ যখন ফ্ল্যাটে থাকে না, তখন ঘুরে বেড়ায়। টগবগ টগবগ করে ঘুরে বেড়ায়।
একদিন বন্ধ ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অর্জন ঘোড়ার ক্ষুরের টগবগ টগবগ আওয়াজ শুনেছিল। ঘোড়ার ক্ষুরে কার্পেটের সুতো লেগে থাকতে দেখেছিল।
অর্জন বুঝেছিল ফ্ল্যাট ফাঁকা হলেই মাটির ঘোড়া দুটো জ্যান্ত হয়ে ওঠে!
এর কদিন পরেই দুপুরবেলা আলপনা মাসি অন্য ঘরে ঘুমাচ্ছে। অর্জনও ঘুমিয়ে পড়েছিলে এ ঘরে। হঠাৎ তার মনে হল সে যেন কোনো জঙ্গলের মধ্যে শুয়ে আছে। জঙ্গলের ভেতর বিশাল বড়ো একটা গাছ, সেই গাছে বেশ মোটা একটা ডাল, সেই ডালের ওপর সে শুয়ে। হঠাৎ অর্জনের ভয় হল যদি সে ডাল থেকে নিচে পড়ে যায়! অর্জন ভয়ে আঁতকে উঠে ঘুম ভেঙে উঠে পড়ল। ঘুম ভেঙে সে বুঝল, না সে কোনো জঙ্গলের ভেতর গাছের ডালে শুয়ে নেই, সে ঘরের বিছানাতে শুয়ে আছে। অর্জন হাসছিল। সে স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু তখনই সে দেখল তার মাথার কাছে একটা গাছের পাতা।
অর্জন অবাক! খাটের উপর গাছের পাতা এল কোথা থেকে!
মা বাড়ি ফিরতে অর্জন গাছের পাতাটা দেখাল। মা বললেন, হাওয়ায় উড়ে এসেছে।
অর্জনের মনে হল, মা ঠিক বলছে না। কোনো ঝড় হলে কথা ছিল। কোনো ঝড় হল না, জোরে হাওয়া দিল না, অথচ থার্ড ফ্লোরে ফ্ল্যাটে এমনি এমনি একটা গাছের পাতা উড়ে এল!
কোন গাছের পাতা এটা?
অর্জনের মা ঠিক বলতে পারল না? তবে আলপনা মাসি বলল, এটা তো কাঁঠাল পাতা গো ছোটোবাবু।
অর্জন বলল, কাঁঠাল পাতায় কি হয়?
আলপনা মাসি বলল, কাঁঠাল পাতা ছাগলে ভালো খায়।
আর?
বাবা বললেন, কাঁঠাল কাঠের খুব সুন্দর ফার্নিচার হয়। খাট হয়, আলমারি হয়।
অর্জন বলল, আমাদের ঘরের কোনো ফার্নিচার কি কাঁঠাল কাঠের?
অর্জনের মা বলল, হতেই পারে। সেগুন বলে কি কাঠ দেয় তার কি কোনো ঠিক আছে!
তখনই অর্জনের মনে হল, নির্জন দুপুরে ওদের ফ্ল্যাটে নিশ্চয়ই কোনো কাঁঠাল কাঠের ফার্নিচার কাঁঠাল গাছ হয়ে গিয়েছিল। অর্জুনের ঘুম ভাঙতে তাড়াতাড়ি করে গাছটা ফার্নিচার হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়ার সময় একটা পাতা কোনোভাবে রয়ে গেছে।
তাহলে কি দুপুরবেলায় পোড়ামাটির ঘোড়া জ্যান্ত হয়, ফার্নিচারের কাঠ গাছ হয়ে যায়? আশ্চর্য!
অর্জন বুঝল, নির্জন দুপুরবেলা বুঝি এমনটিই হয়। পোড়ামাটির ঘোড়া যদি জ্যান্ত হয়ে টগবগ করে ফ্ল্যাটের ভেতর ঘুরে বেড়ায়। কাঠের শক্ত ফার্নিচার পাতা ভরা গাছ হয়ে যায়। তাহলে অর্জনের আর দোষ কি, সেও তো গরমের ছুটির নির্জন দুপুরে একটু নিজের মতো হয়ে উঠতে পারে। সত্যি-সত্যি কি দোষ দেওয়া যায়?
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা ।। শরৎ ১৪১৮
Topic : Best Mystery-thriller story in Bengali, Short suspense story for children's রহস্য-রোমাঞ্চ গল্প, Best children's story, wonderful children's story,
0 মন্তব্যসমূহ