Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

কুমীরগড়ের সেই রাজা ।। দিলীপকুমার মিস্ত্রী



আজ থেকে অনেক বছর আগের কথা। উত্তরে কুমীরগড় নামে একটি খুব সুন্দর দেশ ছিল। দেশটিতে ছিল একটি অতীব সুন্দর নদী। নদীটি বৃত্তাকারে কুমীরগড়কে ঘিরে রেখেছিল। সেই নদীটিতে, ছিল অসংখ‍্য বিশাল বিশাল কুমীর। শোনা যায়, ওই কুমীরের জন‍্যই নাকি দেশটির নাম হয়েছিল কুমীরগড়।

সে যাই হোক, কুমীরগড়ের রাজা ছিলেন বিক্রম মান। তার ছিল দুই রানি। প্রথমা রানি প্রতিবেশী রাজ‍্য শীতলগড়ের রাজকন্যা মৃত্তিকা। সে ছিল যেমন সুন্দরী তেমনই বুদ্ধিমতী। দ্বিতীয় বিবাহটি রাজাকে ঘোর অনিচ্ছায় বিমাতার চাপে পড়ে করতে হয়েছিল। সে ছিল আরেক প্রতিবেশী রাজ‍্য বক্রভূমির রাজকন্যা চঞ্চলা। সে আবার রাজ-বিমাতার দূর সম্পর্কে এক ভাইয়ের মেয়ে।

রাজা বিক্রম মান ছিলেন অত‍্যন্ত দয়ালু, প্রজাবৎসল এবং ধার্মিক। পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ, বীর যোদ্ধা। তাই প্রতিবেশী দেশের রাজারা সবাই তাঁকে যথেষ্ট সমীহ করত। কিন্তু তার মনে কোনও শান্তি ছিল না। কারণ তার প্রথমা স্ত্রী বারবার কন‍্যা সন্তান জন্ম দিত। আর সেই কন্যা সন্তানদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে নদীতে কুমীরের মুখে ফেলে আসা হোতো। এই কাজটি সম্পন্ন করত রাজার বিমাতা নিজে। রাজার প্রথম বিবাহের পরপরই রাজ-জ‍্যোতিষী নাকি তার কাছে ভবিষ‍্যৎবাণী করেছিল, কুমীরগড়ের জীবিত  এক রাজকন্যার জন্য প্রজাদের কপালে অশেষ দুঃখ-কষ্ট নেমে আসবে। অতএব, প্রজাবৎসল রাজা বিক্রম মান বুকের উপর পাথর চাপা রেখে মাতৃ-আজ্ঞা পালন করে যাচ্ছিল। এদিকে দ্বিতীয় রানির যে কোনোদিন সন্তানাদি হবে না, সেকথা রাজবদ‍্যি জানিয়ে দিয়েছিল রাজার দ্বিতীয় বিবাহের পরপর।

বড়ো রানির সাত-সাতটি কন‍্যা-সন্তানকে কুমীরের মুখে ফেলে আসার পর রাজা মনস্থির করল, সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে হিমালয়ে চলে যাবে। কিন্তু বড়ো রানি, রাজ-পারিষদ এবং প্রজাদের পীড়াপীড়িতে তা শেষ পর্যন্ত স্থগিত রাখতে হল তাকে।

এদিকে বড়ো রানি আবার সন্তান প্রসব আসন্ন। রাজার মনটা তাই একদম ভালো নেই। কিন্তু রানি তাকে বারবার বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি, এবার আমাদের পুত্র সন্তান আসছে। ভোরের স্বপ্ন, তা কখনও মিথ্যে হতে পারে না। রাজন, তোমার-আমার সমস্ত দুঃখ-যন্ত্রণা এবার ঘুচবেই ঘুচবে।

কয়েকদিন পরের ঘটনা। সকাল থেকে ঝেঁপে বৃষ্টি নেমেছে। সন্ধের পর বৃষ্টির বেগ আরও বেড়ে গেল। তার সঙ্গে মুহুর্মুহু বাজ পড়ছে। ভয়ে রাজ‍্যবাসী ঘর বন্ধ করে শঙ্খ বাজাচ্ছে, উলুধ্বনি দিচ্ছে,ঠাকুরের নাম জপ করছে। ঠিক এমন মুহূর্তেই রানির প্রসব বেদনা উঠল।

খবর পেয়ে ধাইমাকে সঙ্গে করে ছুটে এল রাজ-বিমাতা। তাদের চেষ্টায় নিরাপদেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হল। কিন্তু রানির শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে পড়ল। সে তার সন্তানকে একটিবার চোখের দেখা দেখেই জ্ঞান হারাল।

রাজার কাছে খবর পৌঁছোল, রানির অবস্থা সংকটজনক এবং সে এবারও কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। তা শুনে, দুঃখে শোকে কাতর রাজামশাই কন‍্যা সন্তানকে একটিবার দেখতে পর্যন্ত গেল না। সে রাজবৈদ‍্যকে পাঠাল রানিকে দ্রুত সুস্থ করে তুলতে। আর তার বিমাতা রাত হওয়ার আগেই লোকজন সঙ্গে নিয়ে, সেই কন‍্যা সন্তানটিকে নদীতে ফেলতে বেরিয়ে পড়ল।

কয়েকদিন পর, বড়ো রানি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল। তারপর, একদিন রাজামশাই মনের দুঃখে বড়ো রানিকে সঙ্গে নিয়ে, রাত শেষ হওয়ার আগেই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, ওই কুমীর নদীতেই তারা প্রাণ বিসর্জন দেবে। যে রাক্ষুসে কুমীর নদী তাদের সমস্ত সন্তানদের খেয়েছে, তার কাছেই তারা নিজেদের সঁপে দেবে। এমন যন্ত্রণাময়, ব‍্যর্থ জীবন তারা যে আর বইতে পারছে না।

ভোর হয় হয়। গাছে-গাছে দু-চারটি পাখি মৃদু স্বরে ডাকছে। বৃষ্টিও থেমে গেছে। মেঘমুক্ত আকাশ একেবারেই পরিষ্কার। রাজা-রানি নদীর তীরে পৌঁছে গিয়েছে। তারা নদীর জলে ঝাঁপ দিতে নিজেদের প্রস্তুত করে নিয়েছে। দুজনে একসঙ্গে জলে ঝাঁপ দিতে যাবে, ঠিক তখনই ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। তারা দেখল, মাঝ নদী থেকে সাতটি বিশাল বিশাল ভয়ংকর কুমীরের পিঠে চেপে আসছে সাতটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে। তাদের বয়স দুই থেকে পনেরো। সবচেয়ে বড়ো মেয়েটির কোলে একটি ফুটফুটে শিশু। তাকে সদ‍্যজাত বলেই মনে হচ্ছে।

রাজা-রানি দুচোখে যেন স্বপ্ন দেখছে। তারা আর জলে নামল না। সাতটি কুমীরই এগিয়ে এল তাদের কাছে, রাজকন‍্যাদের পিঠে নিয়ে। তারা রাজার কাছে এসে তাকে প্রণাম করল। তারপর, কুমীরদের দলপতি বলতে লাগল, রাজামশাই, এই সাতটি কন‍্যাই রানিমার গর্ভজাত সন্তান। আর অষ্টমটি, তার একমাত্র পুত্র সন্তান। যে কয়েকদিন আগে  পৃথিবীতে এসেছে। আপনার বিমাতা চক্রান্ত করে আপনার সন্তানদের হত্যা করতে চেয়েছিল। সে তার নিজের ভাইপোকে ভবিষ্যতে রাজ সিংহাসনে বসাবে বলেই এমন চেষ্টা করে চলেছে। আর আপনার রাজজ‍্যোতিষী প্রচুর অর্থের বিনিময়ে, বিমাতার প্ররোচনায় আপনাকে মিথ্যে কথা বলে বিভ্রান্ত করেছে। আমাদের কুমীরগড়ের আদর্শ রাজাকে রক্ষা করার দায় আমাদেরও রয়েছে। তাই তো আপনার প্রতিটি সন্তানকে আমরা এতকাল সযতনে লালন করেছি। আজ আপনার হাতে তাদের তুলে দিয়ে আমরা দায়মুক্ত হলাম। সত্যি, আজ আমাদের খুব আনন্দের দিন।

রাজা কুমীর দলপতির কথা শুনে আনন্দে কাঁদতে লাগল। রানির দুচোখেও যেন এক চঞ্চলা নদী বয়ে চলেছে। রাজা এগিয়ে গিয়ে কুমীর দলপতিকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বলল, তোমরা সবাই আমার পরম হিতৈষী, প্রাণের বন্ধু। তোমাদের আমি সারা জীবন মনে রাখব। এখন তোমাদের সকলকে আমার সঙ্গে রাজদরবারে একটিবারের জন্য যেতেই হবে। তোমাদের একটু সেবা না করতে পারলে আমি যে  কিছুতেই শান্তি পাব না বন্ধু। তোমরা আমাকে এইটুকু দয়া করো।  চল বন্ধু, চল।

সাত কন‍্যা আর এক পুত্রকে সঙ্গে করে রাজা-রানি রাজপ্রাসাদে ফিরল। তাই দেখে শুধু রাজপ্রাসাদ নয়, রাজ‍্যজুড়ে শুরু হয়ে গেল আনন্দ-নৃত্য, উৎসব। রাজা কুমীর বন্ধুদের আদর-যত্নে আহার করিয়ে বিদায় জানাল। তারপর রাজ-জ‍্যোতিষীকে দরবারে ডেকে সকলের সামনে তিরস্কার করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিল। আর বিমাতাকে, আজীবন ভরণপোষণের ব‍্যবস্থা সহ পাল্কি করে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। যাবার সময় রাজা তাকে বলল, তুমি বিমাতা হলেও তো মাতা। তাই অপরাধ যত বড়োই হোক, মাতাকে কারাগারে বন্দী করা কী সন্তানের কাছে শোভা পায়? সন্তানের কাছ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রাখাই তো অনেক বড়ো শাস্তি। তোমাকে আমি সেই শাস্তিই দিলাম।

সেই সঙ্গে রাজা ঘোষণা করল, এখন থেকে এই রাজ সিংহাসনে সে আর কখনও বসবে না। সিংহাসনে বসবে রাজকন্যারা পালা করে। তারা প্রত‍্যেকে তিন বছরের জন্য সিংহাসনে বসবে। আজই প্রথমে বসবে বড়ো রাজকুমারী। ছোটো রাজকুমারীর সিংহাসন সামলানোর পর্ব যখন শেষ হবে, ততদিনে রাজকুমার সাবালক হয়ে উঠবে। আর সেই দিন থেকে, এই রাজকুমারই হবে কুমীরগড়ের স্থায়ী রাজা। ততদিন পর্যন্ত, আমি রাজকুমারীদের পাশে একজন সাধারণ পরামর্শদাতা হিসেবেই থাকব। ঠিক আর দশজন রাজ-পারিষদবর্গের মতো।

রাজার এমন ঘোষণা শুনে রাজ-পারিষদগণ স্তম্ভিত হল। কিন্তু তারা সকলেই ভীষণ-ভীষণ খুশি রাজার মহত্ত্বের কারণে। তারা সবাই রাজার নামে ধন‍্য-ধন‍্য করতে লাগল। খুশি হল সমস্ত প্রজারাও।

এরপর, কুমীরগড়ে প্রজাদের সুখ-শান্তি আগের চেয়ে যেন আরও অনেক-অনেক বেড়ে গেল। কারণ রাজা এখন রাজসিংহাসন, রাজপ্রাসাদ ছেড়ে, প্রজাদের সুখ-দুঃখের খবরা-খবর নিতে তাদের দোরে-দোরে হাজির হচ্ছে। তাই কুমীরগড়ের সুখ‍্যাতি দ্রুত দশ রাজ‍্যে ছড়িয়ে পড়ল বেল ফুলের সুগন্ধির মতো।

Topic : Story of Fairy tale in Bengali, রূপকথার গল্প, Best Story of Fairy tale, Best Story of Fairy tale, short Story of Fairy tale for children's,  short Story of Fairy tale for kid's, Kings and Queen's story

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ