![]() |
'যদি করো চালাকি
বুঝবে তার জ্বালা কী !'
যখন থেকে দেবপ্রিয়া পড়তে শিখেছে,
এক অদ্ভুত নেশা তাকে
ধরিয়ে দিয়েছে তার দাদু। ছড়া দেখলেই সে তা লিখে রাখে একটা নোটবইতে। প্রতিদিন সে
সংগ্রহ করে আশ্চর্য সব ছড়া। কোথায় পায়? সে সব ছড়া ছড়িয়ে থাকে
এখানে-ওখানে। কখনো খবরের কাগজে, কখনো দেয়াললিখনে, কখনো চলমান অটো
বাস-ট্রাক-রিক্সার পেছনে। ভারী আশ্চর্য অবাক করা সব পদ্য। এসব ছড়ায় জড়িয়ে থাকে
সমাজের চলমান অবস্থা। ফুটে ওঠে দার্শনিক উপদেশ। এ-এক মজার নেশা। গতকাল স্কুলে
যাবার সময় একটা ট্রাকের পেছনে লেখা ছিল চালাকির সাথে জ্বালা কী মিলিয়ে এই ছোট্ট
দুটো লাইন। দেবপ্রিয়ার খুব ভালো লেগেছে। সঙ্গে-সঙ্গে তা মনের মধ্যে গেঁথে
গিয়েছে। স্কুল বাসে টুকে নেবার সুযোগ পায়নি। বাড়িতে এসেই পোশাক বদলাবার আগে
দাদুকে জড়িয়ে সে গেয়ে ওঠে-
'স্কুলের ব্যাগটা বড্ড
ভারী
আমি কি তা বইতে পারি।'
দাদু বলেন, এটা তো পুরনো কালেকশন, অনেকদিন আগেই
লেখা হয়ে গেছে, আজ কিছু পাওনি?
দেবপ্রিয়া বলে, দাঁড়াও, নোট বইটা নিয়ে আসি।
দাদু বাধা দেন- আগে বাথরুমে যাও। হাত-পা সাবান দিয়ে ধুয়ে এসো। বাইরের ধুলো
ঘরে আনতে নেই।
দেবপ্রিয়া আরও অস্থির হয়। অনেক কষ্টে মনে রেখেছি এতক্ষণ, আরও দেরি করলে
ভুলে যাব।
দাদু বোঝাবার চেষ্টা করেন, ভুলবে না। যদি ভুলে যাও তো ধরে নেব, ছড়াটা তেমন ভালো
ছিল না। যে সব ছড়া খুব সুন্দর- গভীর কোনো কথা বলে, তা কেউ ভুলতে পারে না।
দেবপ্রিয়া অবাক হয়ে যায়, দাদু, কি বলছ তুমি! ছড়া কি
মানুষ যে কথা বলবে?
দাদু বোঝায়, সবাই মানুষ। সবাই জীবন্ত। সবাই কথা বলতে পারে।
ওই চাঁদ, এই বাড়ি, এইসব ছড়া, সবাই কথা বলতে
পারে।
দেবপ্রিয়া বাথরুমে যায়। দাদু তার জন্যে খাবার নিয়ে অপেক্ষা করে। এ সংসারে
এখন শুধু ওই ছোট্ট মেয়েটি এবং তার থেকেও ছোট্ট দাদুটি। দেবপ্রিয়ার মা-বাবা
দুজনেই অফিসে। ফিরতে-ফিরতে রাত আটটা, সাড়ে আটটা। এখন সবে পাঁচটা বাজে। প্রতিদিন এই
তিন ঘন্টা দুজনের কাছেই সবচেয়ে আনন্দের সময়। বকা-ঝকা নেই, নিষেধ নেই, লেখাপড়া নেই।
শুধু গল্প আর কথা, কথা আর গান, গান আর ছড়া। দেবপ্রিয়া
তার বন্ধুদের খুব গর্ব করে বলে জানিস তো, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হচ্ছে
দাদু। দাদুর বয়স ৬২ বছর। তোরা যদি তার সঙ্গে দশ মিনিট কথা বলিস, ৬২ পৃষ্ঠার একটা
বই পড়া হয়ে যাবে।
দেবপ্রিয়া ডাল-ভাত এবং আলুভাজা সব খেতে ভালোবাসে। এর সঙ্গে দু-একদিন ডিম
সেদ্ধ থাকলে তো কথাই নেই। সে নিজে-নিজেই খায়। সবথেকে বিস্ময়কর ঘটনা, দেবপ্রিয়াদোর
বাড়িতে টিভি নেই। এটা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না। অনেকে বিদ্রূপ করে, বাড়ি আছে জানলা
নেই! দাদু তাঁর প্রতিবেশীদের এই সব কটাক্ষ বেশ হাসি মুখে হজম করেন। তাঁর সোজা কথা, ঘরের মধ্যে একটা
টিভি থাকা আর একটা অ্যাটম বোমা থাকা একই কথা। ওই বোকা বাক্সটার বিষাক্ত গ্যাস
আমাদের অনামি তিন প্রজন্মের মস্তিষ্ক অকেজো করে চলেছে। আমাদের সময় কেড়ে নিচ্ছে, আমাদের বোধবুদ্ধি
স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে, আশ্চর্য এক নোংরা পৃথিবীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
দাদুর কথায় এ বাড়িতে টিভি নেই। হয়তো কিছুদিন বাদে গিনিস রেকর্ড বইতে
দেবপ্রিয়াদের নাম উঠবে। সবথেকে আদিম এবং অবিশ্বাস্য সংসার, যেখানে আজ
পর্যন্ত একটা টিভি নেই।
দেবপ্রিয়া খাচ্ছে আর বলছে, দাদু খাতা পেন্সিল নিয়ে প্রস্তুত।
'যদি করো চালাকি
বুঝবে তার জ্বালা কি!'
দাদু ছড়াটা খুব মজার না?
দাদু বলেন, কোথায় পেলি?
-ট্রাকের পেছনে।
-মানেটা বুঝেছিস?
-হ্যাঁ।
-কি বুঝেছিস?
এক দেশে এক ঘর। সেই ঘরে দুই বোন ছিল। যমজ বোন। একজনের নাম চালাকি, অন্যজনের নাম
জ্বালা কী। বড়ো বোন চালাকি, বয়সে ৩০ সেকেন্ড বড়ো।
দেবপ্রিয়ার কথা শুনে দাদুর চোখে-মুখে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে। তিনি টের পান, চালাকি করলে যে
ভবিষ্যতে কষ্ট পেতে হয়, এই কথাটা ওই শিশুচিত্তে বেশ গভীর ভাবে গেঁথে
গিয়েছে। ট্রাকের পেছনে এইরকম দার্শনিক বাণী প্রায়ই দেখা যায়। অনেক গভীর কথা
গ্রাম্য পদ্যে এবং ইয়ার্কির মধ্যে দিয়ে বলা হয়। দেবপ্রিয়ার নোটবুকে এমন অনেক
সংগ্রহ আছে।
'দেখবি আর জ্বলবি
লুচির মত ফুলবি।'
দেবপ্রিয়া অল্প পড়ে। স্কুলের পড়া খুব তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারে। সে দাদুর
সঙ্গে গল্প করে সারাক্ষণ। দাদুর সঙ্গে দ্বৈতকন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গায়। সে সব গানের
কঠিন-কঠিন কথা সে কিছুই বুঝতে পারেনা। কিন্তু প্রাণ দিয়ে গেয়ে যায়। শুনে-শুনে
এখন মুখস্থ হয়ে গেছে গানগুলি। কমপক্ষে পঞ্চাশটা গান সে গাইতে পারে। সুযোগ পেলে
একাই গেয়ে দেবে। হয়তো সে সব গানের সুর তাল ঠিক থাকবে না, তবু তার কথাগুলি
বেজে উঠবে স্পষ্টভাবে।
মাস তিনেক আগে শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়ে একটা ট্রাকের শরীরে আশ্চর্য সুন্দর
অলংকরণ দেখে মুগ্ধ হয়েছিল দেবপ্রিয়া। এইসব শিল্পীদের কেউ চেনে না। এইসব কবিদের
কোনো পরিচয় নেই। সেখানে অদ্ভুত দুটো লাইন ছিল যার অর্থ দেবপ্রিয়া কিছুতেই বুঝতে
পারে নি। রহস্য-রহস্য গন্ধ ছিল সেই ছড়াটায়-
'মাথা ভরা টাক দিলি মা,
আকার দিলি না।'
বাড়ি ফিরেই সে দাদুকে প্রশ্ন করে,
এ কথার মানে কী?
-পরে বলব।
-এখন নয় কেন?
-ওটার মানে তোমার কাছে এখন অস্পষ্ট থাকাই ভালো। শুধু জেনে রাখো, খুবই বুদ্ধিদীপ্ত
ধাঁধা-মানেটা তুমি নিজেই বুঝতে পারবে একটু বড়ো হলে।
-আমি কবে বড় হব?
-যেদিন থেকে কমপ্ল্যান খাওয়া বন্ধ করবে।
দেবপ্রিয়া দাদুর নোটবইতে এরই মধ্যে প্রায় ২৬৭টা ছড়া লেখা হয়ে গেছে। দাদু
বলেছেন, ৫০০ হলে ছাপাবার চেষ্টা করবেন। সঙ্গে থাকবে
ড্রইং এবং ফটোগ্রাফ। বইটা বেশ জমজমাট হবে সন্দেহ নেই। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের ছড়া
প্রচুর ছাপা হয়। গতকালই (২৫ আগস্ট ২০১১) ছাপা হয়েছে।
'সরষে বাড়িতে বাটা
এখন বেগার খাটা।'
'মাছ হোক বা সবজি
ডুবিয়ে খান কবজি।'
একটু পুরনো কিন্তু অবিস্মরনীয় সেই ছড়া
'BATA
মানেই হাঁটা।'
ভোট এলে দেয়ালে-দেয়ালে ফুটে ওঠে নানা রকম ছড়া। রাজনৈতিক স্লোগান ছড়া দিয়ে
প্রচার করা হয়। সে সব তো ছড়া নয়, ছড়রা বুলেট যেন।
জনতার মুখে-মুখে ফেরে-
'হয় এবার
নয় NEVER' কিংবা
'চুপচাপ
ফুলে ছাপ'
ছড়ার প্রতি সাধারণ মানুষের প্রাণের টান চিরকালের। সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই
গদ্যের থেকে পদ্যের প্রতি মানুষের মোহ বেশি, ছন্দ-ধ্বনি-বাদ্য-সংগীত
কাব্য ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ বেশি। এসব কথা মনে রেখেই গত বছর দেবপ্রিয়ার জন্মদিনে
দাদু নিজের হাতে আমন্ত্রণপত্র লিখলেন।
'পুটিমনির জন্মদিন
দলে-দলে যোগ দিন।'
ভালো কথা, দেবপ্রিয়ার ভালো নাম যে পুটি সে কথাটাই তো বলা
হয়নি। হ্যাঁ, ভালো নাম পুটি-খারাপ নাম দেবপ্রিয়া খুবই আদর
করে কাছের মানুষ যে নামে ডাকে সেটাই ভালো নাম। আর যেটা কাগজে-কলমে লেখা থাকে সেটা
সাধারণ নাম।
গতকাল দেবপ্রিয়া এসেছিল। তার অনুরোধেই এ লেখা ছাপা হচ্ছে। সে বলেছে, এবার পুজো থেকে
তার বন্ধুরাও যেন নোটবইতে ছড়া সংগ্রহ শুরু করে। তার বন্ধু মানে 'চিরকালের
ছেলেবেলা' পত্রিকার লেখক-পাঠক সব্বাই। ছড়াগুলির সঙ্গে
তারিখ এবং উৎস জুড়ে দিলে ভালো হয়। সবথেকে ভালো হয়, ভালো-ভালো
ছড়াগুলি এই আমাদের 'চিরকালের ছেলেবেলা' পত্রিকায়
পাঠিয়ে দিলে। এইসব জীবন্ত এবং চলমান লোককাব্য লিখে না রাখলে হারিয়ে যাবে। পুটির
দাদু বলেন-
'ছোট্ট মেয়ে পুটি
সুয্যি উঠি উঠি
এই যে সব ছড়া
নয় তা মন গড়া
লোকের মুখে মুখে
বলেছে বন্ধুকে
জমিয়ে রাখো ছড়ানো সব ছড়া
ভবিষ্যতে চক্ষু ছানাবড়া
'ছেলেবেলায়' ছড়া পাঠাও একটি
কিংবা দুটি।'
-ইতি তোমার পুটি
অলংকরণ-অমর লাহা
প্রকাশিত-চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ১৪১৮
Topic : Children's funny story in Bengali,
Best funny story for Children, ছোটোদের মজার গল্প, ছড়া সংগ্রহের গল্প, The story of the Bengali rhyme collection
0 মন্তব্যসমূহ