Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ভালুক ছানার একতারা ।। বলরাম বসাক


 

একটা নদীর নাম চঞ্চলা। আরেকটা নদীর নাম অঞ্জনা। দুটো নদী দু-দিক থেকে এসে যেখানটায় মিলেছে, সেখানে ছোটো ছোটো ঢেউয়ের নাচ রিম ঝিম রিম ঝিম। জায়গাটার নাম তাই বোধহয় ঘুঙুর-তটী। চারিদিকে বিশাল বিশাল গাছ। ডালপালায় পাতা মুকুলে ঝুর ঝুর ঝুম ঝুম তাল। ডালের ওপর বৃক্ষরাজির আলো-ছায়া কাঁপে। তার মধ্যে এদিক-ওদিক দোলে মৃদু মৃদু একটা ছোট্ট ডিঙি। ডিঙিতে বসে এক কালো ভালুকের ছানা। তার পাশে একটা একতারা। ভালুকছানা একতারার তারে আলতো করে থাবার নখে আঁচড় মারে। আওয়াজ হয় টং টং। আওয়াজটা দুই নদীর ঢেউয়ের নাচের রিমি ঝিম আর গাছপালাদের ঝুর ঝুর ঝুম ঝুম তানের সঙ্গে দিব্যি মিলে যায়।

চারদিক নির্জন। কেউ আসে না সেখানে ভালুকের ভয়ে।

ডিঙ্গি নৌকোটায় শোয়ান একতারাটা কী করে এল? কী করে পেল ভালুকছানা? আসলে ডিঙ্গি নৌকাটায় চড়ে বসে ছিল এক বাউল একতারা হাতে। ডিঙির মাঝি নৌকটা পারের খুঁটিতে কাছিতে বেঁধে রেখে গিয়েছিল কোথায় যেন। বাউল তখন একতারায় টং-টং আওয়াজ করে বোধহয় মনে মনে গান বাঁধছিল। এমন সময় দেখল ভালুকছানা, কালো কুচকুচে গায়ের রং, চোখ দুটো লালচে, নৌকায় উঠে পড়েছে। খুব ছোটখাটো নয় ভালুকছানাটা, বেশ একটু বড়োসড়ো, তাকে দেখে বাউল একতারা ফেলে ডিঙি থেকে মারল ঝাঁপ জলে। এততো ভয় পেয়ে গেছিল। সাঁতার কেটে উঠল চঞ্চলা নদীর পারে। সেখান থেকে ছুটে গিয়ে অঞ্জনা নদীতে আবার ঝাঁপ মারল। সাঁতার কেটে কেটে চলে গেল অঞ্জনা নদীর ওপারে। আর ফিরে এল না।

ওদিকে মাঝিও আর ফিরে আসেনি।

ভালুকছানা ডিঙিতে দাঁড়িয়ে মুখ তুলে শুধু দেখেই গেল। তার দুটো চোখ যেন কপালে উঠে যাওয়া বড়ো বড়ো আর স্থির। তার মানে ভালুকছানা অবাক হয়ে বাউলের পালানো দেখেছিল।

ভালো ছিল এই কালো ভালুকছানা। রোজ সকালে আসে নদীর পারে, ঘুঙুর তটীর ধারে নড়া-চড়া দোল খাওয়া ডিঙির ওপর। শোয়ান একতারার তারে থাবার নখে বাজায় টং টং। সবসময় বাজায় না। মাঝে-মাঝে বাজায়। ভালুকছানা রাত্তিরে চলে যায় মা-বাবার কাছে। খুব কাছেই বুনো আনারসের ঝোপ-ঝাড়ের পাশে কাঁঠাল বনে। ওর বাবা ইয়াবড়া রাক্ষুসে ভালুক আর মা তার চাইতে একটু খাটো ইয়া মোটা-সোটা ভালুকী। এছাড়া আছে ভালুক ছানার কাকু, জেঠু, কাকি, জেঠি কাঁঠাল বনে ছড়ানো। বাপরে, ওদের ভয়ে কেউ আসে না ওই জঙ্গলে, না কাঁঠাল পাড়তে, না আনারস কাটতে। ভালুকছানা কিন্তু খুউব শান্তশিষ্ট, বাবা, কাকু, কাকি, জেঠু, জেঠিদের মতো রাগী নয়। ভালুকছানা একটু ভাবুক-ভাবুক।

ডিঙিতে বসে ভালুকছানা আকাশে তাকায় মাঝে-মাঝে। ঠাণ্ডা হাওয়া খায় হাঁ করে। যেন আইসক্রিম খাচ্ছে। একদিন দেখে বিকেলবেলা, আকাশে সোনালি মেঘ-মায়ের আর রূপোলি মেঘ-মায়ের জোড়া কোলে কালো মেঘ শিশুর দুষ্টুমি ভরা নড়াচড়া। তখুনি কালো ভালুকছানা নড়েচড়ে উঠল। সেও তো কালো মেঘ-ছানাটিরই মতো। শুধু তার মা, কাকিরা সোনালি নয়, রূপোলি নয়, ঘোর কালো-কালো। কী যেন মনে হল কালো ভালুকছানার, সঙ্গে সঙ্গে সে একতারা বাজাল টং টং টং টং।

আর ঠিক তখনই একটা আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটতে দেখল ভালুকছানা। চঞ্চলা নদী থেকে উঠে এল সোনালি মা আর অঞ্জনা নদী থেকে রূপোলি মা। দুজনে এসে কালো ভালুকছানার মাথা বুলিয়ে দিল। পেট বুলিয়ে দিল।

কালো ভালুকছানা তখন বলল, উ-উ-উ।

'রাত হয়ে যাবে একটু পরে, যা বাড়ি যা।' বলল চঞ্চলা মা।

'যা কাঁঠালতলায় যা। আজ সাবধানে থাকিস।' বলল অঞ্জনা মা।

সেদিন সেই কালো মেঘ-শিশু আকাশে যে ছিল সোনালি মা-মেঘ আর রূপোলি মা-মেঘেদের কোলে। সেই কালো মেঘ-শিশু সন্ধেবেলা কী বিশাল বড়ো দামাল কালো মেঘ-দৈত্য হয়ে গেল। এদিক-ওদিক ফুঁ দিয়ে-দিয়ে ঝড় শুরু করল। সারা আকাশ ঢাকা পড়ল সেই দানব মেঘের বিরাট বিরাট শরীরে। ইয়াবড়া মুখ এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে পাঁচ-ছটা চোখ থেকে বিদ্যুৎ ছুটিয়ে গমগম-গুমুর-গুম কটা-কটা ফটা-ফটা দাঁত কিড়মিড় কড়-কড়াৎ আওয়াজ করে গর্জন করতে লাগল।

মায়ের বুকে মাথা গুঁজে ভালুকছানা চোখ বুজল। ওর মনে পড়ে গেল অঞ্জনা নদীর রুপোলি মা বলেছিল, 'আজ সাবধানে থাকিস।' কী ঝড়, কী ঝাপটা, গাছগুলো যেন ভেঙে পড়তে চায়।

পরদিন সক্কালবেলা। ভালুকছানা ঘুম থেকে উঠে কাঁঠালতলা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে চমকে উঠল। থমকে দাঁড়াল। চারিদিকে কত গাছ ভেঙে পড়েছে। বন-জঙ্গলের সমতলের ওপর কত পাতা, ডালপালা ছড়ানো-ছিটানো। কী ঝড়-বৃষ্টিই না হয়ে গেছে গতকাল রাতে। হাঁটতে গিয়ে বাধা পড়ছে পায়ে ভাঙাচোরা লতাপাতার জন্যে।

ঘুঙুর তটীর নদীর-পারে ভালুক ছানা বেজায় থতোমতো খেল। ওপারে গাছগুলোর কত যে ডাল ভেঙে পড়েছে এদিক-ওদিক নদী-জলে। যেখানে ডিঙিনৌকোটা থাকার কথা- সেখানে ওটা নেই। কাছি ছিঁড়ে পড়ে আছে খুঁটিতে, যেটা বাঁধা ছিল। তবে কি নৌকোটা ডুবে গেল! নেই যখন কোত্থাও, তো ডুবে গেছে। নৌকোর ভেতরে যে একতারাটা ছিল, তাহলে সেটাও ডুবে গেছে।

মনটা খুব-খুউব খারাপ হয়ে গেল ভালুক ছানার। কী সুন্দর টং টং বাজত। দুই নদীর ঢেউগুলো রিমঝিম রিমঝিম নাচত। ওপরটায় চারিদিকের গাছপালার শাখা-প্রশাখা পাতা-মুকুলের ঝোপে এমন নড়াচড়া হত ঝুরু-ঝুরু ঝুম-ঝুম বাজত। কিন্তু,উ-উ-উ করে ওঠে ভালুকছানা, বলতে চাইছে নদীর পারে শুয়ে। এখন যে আর সে সব কিচ্ছু বাজবে না।

ভাবতে ভাবতে ভালুকছানা চোখ ভিজিয়ে ফেলেছিল। সকালের রোদ অনেকটা বাড়তেই, একটা ঘন ছায়া পেল গাছের গুঁড়ির। সেই ছায়ায় ঘাসের ওপর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ভালুকছানা নদীর পারে, মৃদু হালকা বাতাসে।

দুপুরবেলা ঘুম ভেঙে গেল ভালুকছানার। চমকে উঠল। গরগর আওয়াজ বের হল মুখ দিয়ে। সারা গা-মাথা শুদ্ধু জালে বাঁধা পড়েছে ভালুকছানা। জালটা কারা ছুঁড়ে দিয়েছে ঘুমন্ত ভালুকছানার ওপর। দেখল একটা বেশ বড়ো নয় কাছেই জলে ভাসছে। সেখান থেকে তিনজন লোক ভালুকছানাকে জালের ভেতর পুরে ফেলে নৌকোর দিকে টানছে,- হেঁইয়া হেঁইয়া বলে। জোরসে টেনে পার থেকে উঠিয়ে ফেলল ভালুকছানাকে। নৌকোর ওপর ফেলল। এতক্ষণ ভালুকছানা হকচকিয়ে গেছিল।

তার মানে এই তিনটে দুষ্টুলোক ভালুকছানাকে জালে ধরে বেঁধে নৌকোয় করে নিয়ে যেতে চাইছে। সঙ্গে সঙ্গে ভালুকছানা গায়ে যতটা জোর আছে, সবটা খাটিয়ে মারল লাফ। পড়ল জাল শুদ্ধ নদীর জলে।

সেখানটায় একটা ঝড়ে ভাঙে মোটা ডাল জলের ওপর উঁচিয়েছিল। সেই ডালের ফাটা জায়গায় জালের খানিকটা ঢুকে গিয়ে টানাটানিতে ছিঁড়ে গেল। ছেঁড়া অংশটা আরো বড়ো হয়ে গেল জলের মধ্যে ভালুকছানার দাপাদাপিতে। জালের ফোকর দিয়ে ভালুকছানা বেরিয়ে জাল মুক্ত হয়ে ডুবসাঁতার কাটল। ডুব সাঁতার দিয়ে চলে এল অঞ্জনা নদীতে। সেখানে সে জল থেকে মাথা তুলল শ্বাস-নিঃশ্বাসের। জন্য আর তখনই নৌকো থেকে সেই লোক তিনটে তাকে দেখে ফেলল। তাড়াতাড়ি লগি ঠেলে ঠেলে ওরা নৌকোটা নিয়ে অঞ্জনা নদীতে ছুটল। ভালুকছানাকে ফের ধরবে বলে। অঞ্জনা নদী তখন বড়ো বড়ো ঢেউ তুলে ভালুকছানার ওপর ফেলে ওকে ঢেকে ফেলল। জলঢাকা হয়ে ভালুকছানা ডুব সাঁতার কেটে চঞ্চলা নদীতে চলে এল। শ্বাস টানতে ফের জল থেকে মাথা তুলল।

দুষ্টু লোক তিনটে তখন নৌকোটাকে ঘুরিয়ে চঞ্চলা নদীর দিকে নিয়ে চলল। চঞ্চলা নদী তখুনি বড়ো বড়ো ঢেউ তুলে ভালুকছানাকে ঢেকে ফেলল। জলঢাকা ভালুকছানা ডুব সাঁতার কেটে অঞ্জনা নদীতে চলে এল। তখন নৌকোটাও অঞ্জনা নদীর দিকে চলল। অঞ্জনা নদী আবার বড়ো বড়ো ঢেউ দিয়ে ভালুকছানাকে ঢেকে ফেলল। ডুব সাঁতারে চঞ্চলা নদীতে চলে এল। নৌকোও তখন-

এইভাবে লুকোচুরি চলতে চলতে একসময় জলে ডোবা ভাঙা গাছের গুঁড়িতে জোর ঘা খেল নৌকোটা। কাত হয়ে পড়ল একদিকে। ছিটকে পড়ল লোক তিনটে তিন দিকে, অতি কষ্টে সাঁতার দিয়ে ওরা উঠে নৌকোটাকে- হেঁইয়ো হো, করে সিধে করল। নৌকোটা ফেটে গেছে একদিকে। সেখান দিয়ে জল ঢুকছিল। একজন ফাটা অংশে ন্যাকড়া গুঁজে গুঁজে নৌকোর ভেতরে জল ঢোকা বন্ধ করতে লাগল। অন্য দু'জন লগি ঠেলে নৌকাটাকে নিয়ে চলে গেল। পালিয়ে গেল।

ভালুকছানা খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে। ডুব সাঁতার কেটে-কেটে সে কিন্তু একটা জিনিসের  টের পেয়েছে। দুই নদীর মিলনস্থলে সবচে গভীর জায়গাটাতে, সেই ডিঙি নৌকোটা জলের অনেক তলে ডুবে আছে। ওটাকে তলা থেকে তোলা যায় যদি, কিন্তু কী করে তা হবে? ভালুকছানা যে বাবার মতো বড়ো নয়। তার গায়ে তো বাবার মতো জোর নেই। তাছাড়া ভালুকছানা যে এখন বেশ ক্লান্ত। তাহলে ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকোটা কেমন করে তোলা হবে? তোলা বোধহয় আর যাবে না। ভালুকছানা নদীর পারে ঘাসের ওপর কুঁই কুঁই করে কাঁদতে লাগল।

এবারে চঞ্চলা নদী থেকে সোনালি মা-চঞ্চলা, আর অঞ্জনা নদী থেকে রুপোলি-মা আঞ্জনা দুজনে জল থেকে ঝুপ করে উঠে পড়ল। দুদিক থেকে ছোটো ডিঙ্গি নৌকোটাকে জল থেকে তুলে ধরল। তারপর জলের উপর বসাল। নৌকোর ভেতরের জল এদিকে কাত করে ঢেলে ওদিকে কাত করে ঢলে ফেলে দিতে দিতে হঠাৎ শব্দ হল টং টং টং টং।

লাফিয়ে উঠল ভালুকছানা। দেখল নৌকোটা জলে ভাসছে। ভেতরে রয়েছে একতারা, যেটা আটকে আছে একটা তক্তার ফাটলে। চঞ্চলা মা নৌকোর কাছি টেনে ওটাকে পারের কাছে নিয়ে এল। অঞ্জনা মা নৌকোর ভেতরটা পরিষ্কার করতে লেগে গেল। জলের তলায় ডুবে ছিল তো, তাই অনেক হাবিজাবি ঢুকে গেছিল। চঞ্চলা মা নৌকাটাকে পারের খুঁটিতে বেঁধে রাখল। তারপর কালো ভালুকছানার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল। অঞ্জনা মা-ও নেমে এসে ওর পিঠে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। তারপর যে যার নদীর দিকে চলে গেল।

ফিরে পাওয়া ডিঙ্গি নৌকোটায় উঠে ভালুকছানা বাজাল একতারা টং-টং। দুই নদীর মিলনস্থলের জলের ঢেউগুলো নেচে উঠল রিম ঝিম রিম ঝিম। ওপরে গাছের ডালপালা তো তেমন নেই, ঝড়ে অনেক শাখা-প্রশাখা ভেঙে গেছে। দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। তাই কেবল শব্দ করতে পারছে হাওয়ার জোরে দুরু-দুরু দুম-দুম... একতারার সঙ্গে।


অলংকরণ- রাহুল মজুমদার

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২০

Topic : A kids and children's story of Fairy tale in Bengali, রূপকথার গল্প, Short story of Fairy tale, Bear's story, Tedy's story, Story of kids

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ