![]() |
বাঘাকে দেখলেই বিল্লি একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে। দুজনের মধ্যে একদম ভাব নেই। সবসময়ই আড়ি।
বিল্লি মাঝে মাঝে ভাবে, আগের দিনগুলোই অনেক ভালো ছিল। গিন্নিমার কোলে কোলে ঘুরতাম। কর্তাবাবু আমার জন্য বাজার থেকে আলাদা করে মাছ আনতেন। মজা করে খেতাম। শীতের সময় গিন্নিমার লেপের নিচে ঢুকে যেতাম। কী মজা।
যবে থেকে বাঘা এবাড়িতে এল বিল্লির সবকিছুতেই সে ভাগ বসাতে লাগল। বিল্লির সব সুখ উড়ে গেল।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে বিল্লির দুচোখ জলে ঝাপসা হয়ে ওঠে।
গিন্নিমার মুখ চেয়ে এখনও যে এবাড়িতে পড়ে আছে। তা নাহলে কবে এবাড়ি ছেড়ে অন্য কোনো বাড়িতে চলে যেত।
এবাড়িতে বিল্লির আসাও ওই গিন্নিমারই জন্য। একবার গিন্নিমা তার দামি জামা-কাপড়গুলো ভাদর মাসের রোদে দিয়ে দেখল সবকিছু ইদুরে কেটেকুটে একেবারে ফর্দা-ফাঁই করে রেখেছে। ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিল্লিকে এবাড়িতে স্থান দিলেন গিন্নিমা।
আর আদর করে তার নাম রাখলেন, বিল্লি। সেই তখন থেকেই বিল্লি এবাড়ির একজন হয়ে উঠল। সারাদিন ভালোমন্দ খাওয়া। গদি-আঁটা বিছানায় আরাম করে ঘুমানো। আর রাতেরবেলা হলেই ইঁদুর খুঁজে বেড়ানো। একেবারে রুটিন মাফিক কাজ। কোনো হেরফের নেই।
জীবনটা বেশ সুখেই কাটছিল বিল্লির। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে। ভেবেছিল বাকি জীবনটা এমনি করেই তার কেটে যাবে। কিন্তু তা আর হল কই! বাদ সাধল বাড়িতে ডাকাত পড়ে।
সে বছর কত্তামশাই গিন্নিমার জন্য কিছু গয়না কিনেছিলেন। সেই গয়না পরে গিন্নিমা পাড়ারই এক বিয়ে বাড়িতে গিয়েছিলেন। তা দেখে অনেকের খুব চোখ টাটিয়ে ছিল। ব্যস! দু-দিনের মধ্যেই বাড়িতে ডাকাত পড়ল। আলমারির লকার ভেঙেই ডাকাতরা সব গয়না নিয়ে পালিয়ে গেল।
তারপরই কত্তাবাবু তার এক বন্ধুর বাড়ি থেকে একটা দামি কুকুর কিনে এনে পুষতে শুরু করে দিলেন। আদর করে কত্তাবাবু তার নাম রাখলেন, বাঘা।
বাড়িতে চোর-ডাকাত এলেই বাঘা বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের টুঁটি টিপে ধরবে। টু-শব্দটি করার সময় পর্যন্ত দেবে না।
আগে বিল্লি ছিল একা। এবার এলো বাঘা। বাঘা আর বিল্লি। এরা দুজনেই এবাড়ির একেবারে পাকা বাসিন্দা। বিল্লি রাতেরবেলায় ইঁদুর মারে, আর বাঘা চোর-ডাকাত ধরবে বলে পাহারা দেয়। কত্তা-গিন্নি পরামর্শ করে এই ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু তা আর হল কোথায়!
সবসময় ওদের দুজনের মধ্যে খিটিমিটি লেগেই আছে। বিল্লির আর বাঘার খিটিমিটি
মেটাতে গিয়ে কত্তা-গিন্নির মধ্যেও ঝগড়া লেগে যায় প্রায়ই।
বিল্লিকে ছাড়া যেমন গিন্নিমার চলে না, তেমনই কত্তাবাবুর হল বাঘা। কত্তাবাবুর খাওয়ার সময় বাঘাকে তার পাশে চাই। আর গিন্নিমার খাওয়ার সময় বিল্লি চুপটি করে পাশে বসে থাকে।
কিন্তু বাধ সাধল একদিন বিল্লি। বিল্লি এবাড়িতে প্রথম এসেছিল। তাই এবাড়িতে তার অধিকার সবচেয়ে বেশি। কোথা থেকে এক বাঘা এসেছে, সে কিনা বিল্লিকে টপকে যাবে! এই নিয়ে বিল্লি আর বাঘার মধ্যে সবসময় ঠাণ্ডা লড়াই চলছে।
একদিন বাড়িতে কি যেন এক অনুষ্ঠান ছিল। সেই উপলক্ষে ভালো-মন্দ সব রান্না হয়েছে। কত্তা খেতে বসেছেন। আর থালার চারপাশে বিভিন্ন বাটিতে মাছ, মাংস, চাটনি, দই, মিষ্টি সাজানো। বাটিগুলো থেকে দারুণ গন্ধ বেরুচ্ছে, আর সামনে বসে লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাঘা। কখন কত্তাবাবু তাকে এক পিস মাংস বাটি থেকে তুলে দেবেন। এ দৃশ্য দেখে বিল্লির ভীষণ রাগ হল। বিল্লি বাঘাকে বলল-
সবাই বলে ছি ছি
ও বলে, ও বলে ছি ছি!
বসে বসে লেজ নাড়ে
আমাদের ঠাকুরঝি!
বিল্লি বাঘাকে হেয় করছে দেখে বাঘার খুব রাগ হল। রাগে সে গোঁ-গোঁ করতে লাগল। বাঘাও তো আর ছাড়বার পাত্র নয়। সেও পাল্টা জবাব দিল-
হিংসেতে তোর বুক জলে?
খেয়েনে ওষুধ
অম্বল হয়েছে বলে।
তারপর বাঘা আনন্দে দুবার ঘেউ-ঘেউ করে লেজ নাড়তে লাগল।
বিল্লি হল গিয়ে বাঘের
মাসি। সে কি চুপ করে থাকবার পাত্রী। সেও পাল্টা জবাব দিল বাঘাকে-
অনেক করেছিস ঘেউ ঘেউ
তোকে এখন পোছে না কেউ!
এই অপমান বাঘা আর সহ্য
করতে পারল না। দিল্লির এত বড়ো কথা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে সে বলল-
দিনরাত দুধ চুরি, মাছ
চুরি!
হ্যাংলামোতে নেই তোর কোনো জুড়ি।
তারপর বাঘা বলল, কি রকম
দিলাম উত্তরটা। দেখ কেমন লাগে! সবাইকে নিজের মতো ভাবা। বিল্লি দিনরাত ভালো-মন্দ খাচ্ছে, গদিতে বসে ঘুমোচ্ছে আর
মাঝেমধ্যে ইদুর দেখলে তার পিছু একটু ছুটছে। তারপর হেঁপো রোগীর মতো হাঁপাচ্ছে। তাতে এত অহংকার, আর আমি সারারাত জেগে সমস্ত বাড়ি ঘুরে
ঘুরে পাহারা দিই। শীত নেই, গ্রীষ্ম নেই, বর্ষা নেই- সব সময়ই একেবারে সজাগ। আমার মতো কাজ করে দেখ কেমন লাগে!
এসব কথা শুনে বিল্লি আবার
বাঘাকে ঠেস দিয়ে বলল-
ধুর-ধুর এটা আবার
কোনো কাজ নাকি!
আমার মতো ছুটতে
তোর এখনো অনেক বাকি।
না! বিল্লিকে আর সহ্য করা
যাচ্ছে না। সহ্যের সীমা ও পার করে দিয়েছে। বলতে বলতে বাঘা রাগে গরগর করতে লাগল।
অন্যদিকে বিল্লি চোখ
মিটমিট করে হাসছে।
বিল্লির হাসি দেখে বাঘা এবার
ঘেউ ঘেউ করতে করতে বিল্লির পিছনে ছুটতে লাগল। বিল্লি তো খুব চালাক। আগে থেকে আঁচ পেয়ে সেও দিল এক লম্বা দৌড়। বিল্লিও দৌড়ায়, তার পিছু পিছু বাঘাও দৌড়ায়। তারপর বিপদ দেখে বিল্লি একলাফে গিন্নিমার আলমারির উপরে
গিয়ে উঠে বসল। ব্যাস! বাঘা আর এত উঁচুতে উঠে বিল্লিকে ছুঁতে পর্যন্ত পারল না।
বাঘা রাগে ওই আলমারির সামনে গিয়ে জোরে-জোরে ঘৌউ ঘৌউ করতে লাগল। অবশেষে চিৎকার করতে করতে ক্লান্ত হয়ে বাঘা ওখান থেকে বিদায় নিল।
পরের দিন সকালে বাঘা আর বিল্লিকে কোথাও দেখতে পায় না। এঘর ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু কোথাও বিল্লি নেই। যতই দিনরাত খিটিমিটি হোক না কেন, তা হলেও তো বন্ধু। কতবারই তো কত ঝগড়া হয়েছে, আবার সব মিটমাট হয়ে গেছে। কিন্তু আজ যে কি হল বিল্লিকে সারা বাড়ি খুঁজে কোথাও দেখতে পেল না। তাই বাঘার খুব মন খারাপ।
বারান্দায় চুপ করে বসে আছে বাঘা। হঠাৎ দেখে বিল্লিকে হাতে ঝুলিয়ে কত্তাবাবু কোথায় জানি চলেছেন। আর বিড়বিড় করে বলছেন কত ভালো মন্দ খেতে দিতাম। কত ভালবাসতাম। তাও হতচ্ছাড়িটা রোজ রোজ রাতে চোরের মতো চুপি চুপি জানালা গলে বাইরে গিয়ে ছাইপাশ খেয়ে আসত। এবার একেবারে প্রাণ হারাল।
আর কত্তাবাবুর পিছনে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে গিন্নিমা এসে সদর দরজায় দাঁড়ালেন।
এসব দেখে বাঘার খুব দুঃখ হল। গতকাল কত কটু কথাই না সে বিল্লি কে বলেছে। তার জন্য সত্যিই সে খুব দুঃখ পেল। বাঘার দু-চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।
এতদিন দুজনে একসঙ্গে এক বাড়িতে থেকেছে, ঝগড়া করেছে। আবার ভাব হয়েছে। কিন্তু এখন থেকে বাঘা একেবারে একা।
অলংকরণ- শঙ্কর বসাক
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২০
Topic- Social story, animal story, pet story, Best story for Children in Bengali, , The story of the dog and the cat
0 মন্তব্যসমূহ