Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ।। বিধান সাহা


প্রতিটি বাঙালির শৈশব শুরু হয় 'বর্ণপরিচয়' গ্রন্থের মধ্য দিয়ে। এই গ্রন্থটি লিখেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এই গ্রন্থে সুবোধ বালক গোপাল ও অশান্ত বালক রাখালের পরিচয় রয়েছে। রাখাল স্বভাবে যেমন দুরন্ত তেমনি পড়াশোনাতেও তার মন নেই। সে বই হারায়, বিদ্যালয়ে দেরি করে যায়। গ্রন্থটির রচয়িতা ঈশ্বরচন্দ্র ছেলেবেলায় দুরন্ত রাখালের মতোই ছিলেন, কিন্তু পড়াশোনায় তিনি গোপালের স্বভাব পেয়েছিলেন। স্বভাবে রাখাল হলেও পড়াশোনাতে তিনি গোপালের পরিচয় দিয়েছেন।

মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে ১৮২০ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ঈশ্বরচন্দ্র। পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়ের নাম ভগবতী দেবী। জন্মঘটনাটি ঈশ্বরচন্দ্র তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। পিতা ঠাকুরদাস কোমরগঞ্জে হাটে গিয়েছিলেন। পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ নাতি হওয়ার শুভসংবাদ ঠাকুরদাসকে পথে দেখা হতে বললেন, ''একটি এঁড়ে বাছুর হয়েছে''। ঠাকুরদাস বাড়িতে এসে গোয়ালের দিকে যাচ্ছিলেন। রামজয় হেসে বললেন, ''ওদিকে নয়, এদিকে এসো'' জন্মঘরে শিশু ঈশ্বরচন্দ্রকে দেখিয়েছিলেন।

ঠাকুরদাস ও ভগবতীর সাত ছেলে ও তিন মেয়ে। প্রথম সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র। গ্রামে ঠাকুরদাস একটি পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেখানে শিক্ষক ছিলেন কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। ঈশ্বরচন্দ্র পাঁচ বছর পর্যন্ত বিদ্যার্জন করেন। তিন বছরের মধ্যে তিনি পাঠশালার পাঠ শেষ করেন।

নয় বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র পিতার সঙ্গে কলকাতায় পাড়ি দেন। পথ চলতে-চলতে মাইলস্টোন দেখে পিতাকে জিজ্ঞাসা করে, ইংরেজি সংখ্যা চিনে ফেলেন। আসলে ঈশ্বরচন্দ্র ছিলেন মনোযোগী এবং প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী। সহজে বুঝে নেবার ও মনে রাখার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর।

ঈশ্বরচন্দ্র নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছেন, ''ছেলেবেলায় আমিও দুষ্টু ছিলাম। পাড়ার লোকের যাবতীয় ফল (চুরি করিতাম) চুপিচুপি খাইতাম। কেহ কাপড় শুকাইতে দিয়াছে দেখিলে তাহার উপর বাহ্য করিয়া আসিতাম। লোকে আমার জ্বালায় অস্থির হইত।'' গ্রামের পাঠশালায় পড়তে যাবার সময় প্রতিবেশী মথুর মণ্ডলের স্ত্রীকে রাগিয়ে দেবার জন্য যে সমস্ত উপদ্রব করতেন, মনে হয় বর্ণপরিচয়ের অশান্ত রাখালও করত না।

ঈশ্বরচন্দ্রের শরীর ছিল খর্ব, শীর্ণ, কিন্তু মাথাটা প্রকাণ্ড। বিদ্যালয়ের ছেলেরা তাঁকে ''যশুরে কৈ'' বলার পরিবর্তে ''কসুরে জৈ'' বলে খ্যাপাত। তিনি তখন সামান্য তোতলা ছিলেন। ছেলেরা রাগিয়ে দিলে রাগে আর কথা বলতে পারতেন না।

ছাত্রজীবনে ঈশ্বরচন্দ্রকে প্রচুর কষ্ট করতে হয়েছে। নিজেকে রান্না করতে হত। সকালবেলা গঙ্গা স্নান সেরে আসার পথে বাজার করে ফিরতেন। মশলা বাটা, তরকারি ও মাছ কাটা, চার-পাঁচজনের রান্না করা, সকলের শেষে খাওয়া, বাসন মাজা তাঁর রোজকার কাজ। কোনোকোনো দিন শুধু নুন দিয়ে ভাত মেখে খেতে হয়েছে। রান্না করতে-করতে ও বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে তিনি পাঠ অনুশীলন করতেন।

মাত্র নয় বছর বয়সে কলকাতায় এসে ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে ভর্তি হন। এত দারিদ্র, এত কষ্ট থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রতিবারই প্রথম স্থান অধিকার করতেন। পড়াশুনোর কৃতিত্বের জন্য বৃত্তি পেতেন। সেই অর্থও তিনি সহপাঠীদের জন্য খরচ করতেন। নিজের জামাকাপড়ও গরীবদের দান করে দিতেন।

পিতা ঈশ্বরচন্দ্রকে কঠোর শাসনের মধ্যে রাখতেন। সারাদিন ঈশ্বরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হত। ক্লান্তি বশতঃ ঘুমিয়ে পড়লে পিতা নির্মমভাবে মারধোর করতেন। একবার চেলা কাঠ দিয়ে পেটালেন। মারের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ঈশ্বর প্রতিবেশীর বাড়িতে আশ্রয় নেন। ঈশ্বরের আর্তনাদ শুনে পিতার আশ্রয়দাতা সিংহ পরিবার অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন।

পিতা যা করতে বলতেন, ঈশ্বরচন্দ্র তার উল্টো কাজ করতেন। এটা ঈশ্বরচন্দ্রের স্বভাব বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত জেদী, একরোখা। পিতা যেদিন বলতেন যে স্নান করতে হবে, সেদিন ঈশ্বর বলতেন যে স্নান করবেন না। মারধর করেও ঈশ্বরকে স্নান করাতে পারতেন না।

সারাদিন প্রচুর পরিশ্রমের পরে রাত দশটার সময় শুয়ে পড়তেন ঈশ্বরচন্দ্র। রাত দুই প্রহরের সময় তাঁকে জাগিয়ে দেওয়ার কথা বলে রাখতেন পিতাকে।  আর্মানি গির্জার ঘড়িতে ১২টার ঘন্টা বাজলেই পিতা ঈশ্বরচন্দ্রকে জাগাতেন। সারারাত গ্যাসের আলোয় জেগে পড়া করতেন ঈশ্বরচন্দ্র।

দুরন্ত, জেদী অথচ প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র মাত্র কুড়ি বছর বয়সে হিন্দু ল. কমিটির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি লাভ করেন। সেই থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সমগ্র বাঙালির কাছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে বিখ্যাত হয়ে উঠলেন।

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । বৈশাখ ১৪১৬ (এপ্রিল ২০০৯)

Topic : Biography of Ishwar Chandra Vidyasagar

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ