Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

খাঁচার পাখি ।। অরিন্দম নন্দী



ঘটনা ১

মৌলির বাড়িতে কলেজ ফিরতা পিয়ালি এসেছে। মৌলি আজ কলেজ যায়নি। ব্যালকনিতে এসেই পিয়ালির চোখ আটকে গেল নতুন খাঁচাটার দিকে। ওমা কি সুন্দর পাখিগুলো! কি কিউট রে মৌলি! মৌলি বলল, হুঁ, ওগুলো বদ্রীকা। কালই ছোটকা হাট থেকে কিনে এনে আমাকে গিফট করেছে।

ঘটনা ২

চন্দ্রকান্তবাবু বহুদিনের পুরনো ভাড়াটে, ভাড়ার অর্থ এতই কম যে বাড়িওয়ালা রায় সাহেব আর ভাড়া আদায় করতে লোক পাঠান না। চন্দ্রকান্তবাবু নিজেই তিন মাস অন্তর টাকাটা এসে দিয়ে যান রায় সাহেবের বাড়িতে। সেই ফাঁকে চলে নানান আলোচনা। চন্দ্রকান্তবাবু যখন রায় সাহেবের সাক্ষাৎ পেলেন, তখন রায় সাহেবের দোতালার টানা বারান্দাতে বাড়ির নতুন আসা অতিথিকে নিজের হাতে খাওয়াচ্ছেন। চন্দ্রকান্তবাবু দেখলেন একটি বিশাল পাখি দাঁড়ের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, পায়ে তার শিকল পরানো। পাখিটিকে অপূর্ব দেখতে। তিনি মৃদু স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কোন পাখি রায় সাহেব? স্মিত হেসে রায় সাহেব বললেন, এ হল অস্ট্রেলিয়ান ম্যাকাও, বহুমূল্য পাখি? তাই যত্ন-আত্তিও বেশি।

ওপরের এই দুটি ঘটনায় প্রমাণ করে মানুষ পাখি পোষে শুধুমাত্র নিজের শখ মেটাতে। পাখিটিকে যখন ইচ্ছে দেখতে পাওয়া যাবে, তাই খাঁচায় ভরে রেখে দেয়। কিন্তু বলতে পারো তোমরা, নিজের সামান্য সখটুকু মেটানোর জন্য কেন অন্য একটি প্রাণীকে চিরকালের জন্য বন্দী হয়ে থাকতে হবে? কেন তাদের সারাজীবন কাটাতে হবে ছোট্ট খাঁচার ছোট্ট পরিসরে?

পাখি হল এমন একটি জীব যার বৈশিষ্ট্য হল উড়ে বেড়ানো। ডানা মেলে তারা উড়ে বেড়ায়। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ তাদের সেই উড়ে বেড়ানোটাকে চিরতরে বন্ধ করে দিয়ে খাঁচায় ভরে রেখে দেয়, শুধুমাত্র তাদের ভালো লাগবে বলে। একে কি বিকৃত মানসিকতা বলা উচিত নয়?

কেউ কেউ আবার যুক্তি দেন, তারা তো খেতে পাচ্ছে। যদিও এগুলিকে যুক্তি না বলে অজুহাতই বলা ভালো। প্রকৃতি স্বনির্ভর পাখিগুলি স্বাধীনভাবে প্রকৃতির বুকে অবস্থান করলেও খেতে পেত, না হলে তো কোনো পাখিই বাঁচত না। পক্ষীকুলের অস্তিত্বই থাকত না।

কারোর-কারোর কথা, পাখিগুলোকে খাঁচা থেকে ছেড়ে দিলে ওরা খুব কষ্ট পাবে, অন্য পাখিরা মেরে ফেলবে। আসলে পাখিগুলোকে দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখলে ওদের ডানায় পক্ষাঘাত হয়ে যায়। তখন ওড়ার ক্ষমতা প্রায় থাকে না। ওদের এই অবস্থার জন্য যারা পাখি পোষে তারাই তো দায়ী। কিন্তু ছেড়ে দিলে প্রথম-প্রথম ওরা উড়তে পারবে না ঠিকই, কিন্তু ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে একসময় ঠিকই উড়তে পারবে। অন্য যেকোন প্রাণীদের থেকে আত্মরক্ষা করা ওদের কাছে কঠিন হবে না। কেউ ওদের মেরে ফেলবে না। বরঞ্চ খাঁচায় বন্দী করে রেখে এই শ্রেণির মানুষই ওদের শেষ করে দিচ্ছে। পাখিটি মরে গেলে এই মানুষগুলির সব ভালোবাসা শেষ হয়ে যায়। মৃতদেহটি ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। ওই খাঁচায় আরেকটি নতুন পাখির জায়গা হয়। এইভাবেই চলছে দিনের পর দিন চিত্ত-বিনোদনের নৃশংস খেলা।

পাখিটির ওপর মায়া পড়ে গেছে, বলে অনেকে দাবি করে। একসঙ্গে থাকতে-থাকতে যে কোনো কিছুর ওপরই মায়া পড়ে যায় আমাদের, আর পাখি তো জীবন্ত প্রাণী। কিন্তু যারা খাঁচায় পাখি পোষে তারা একবারও ভাবে না পাখিটি কী দুর্বিষহ ভাবে জীবন কাটাচ্ছে।

কিছু মানুষ বলে, অনেকেই তো বাড়িতে কুকুর, বিড়াল, গরু, ছাগল কত কি পোষে, পাখি পুষলেই দোষের? তাদের বোঝা দরকার, গরু, ছাগল এরা গৃহপালিত প্রাণী। মানুষের সঙ্গ গ্রহণ করতে পারে। মানুষের সঙ্গেই গৃহে বাস করতে পারে। বিশেষ করে দেখা গেছে কুকুর তার মালিকের সঙ্গ ছাড়া থাকতে চায় না। তাছাড়া তারা গৃহে স্বাধীনভাবেই বিচরণ করে। বিড়াল সেভাবে গৃহপালিত না হলেও বসবাসের যোগ্য আস্তানা এবং নিরাপত্তার কারণে মানুষের সঙ্গে স্বচ্ছন্দে বসবাস করতে পারে। কিন্তু পাখি পারে না।

যারা পাখি পোষে তারা বুঝতে পেরেও বোধহয় বুঝতে চায় না, পাখি পুষে তারা অন্যায় করছে। পাখি পোষা তাদের কাছে যেন নেশার মতন হয়ে গেছে। বাজার থেকে অর্থ ব্যয় করে পাখি কিনে কিছুতেই পাখিগুলোকে ছেড়ে দিতে চায় না। এইসব মানুষ কখনোই পশুপ্রেমী হতে পারে না। আমাদের রাজ্যে বহু সরোবর বা ঝিল আছে যেখানে শীতকালে বহুদূর দেশ থেকে নানা প্রজাতির পাখি এসে ভীড় করে। এইসব মানুষকে জিজ্ঞাসা করে দেখো তারা হয়তো কখনোই পাখি দেখতে এসব জায়গায় যায় না। অথচ কিছু টাকার বিনিময়ে বাজার থেকে নিরীহ একটি প্রাণীকে কিনে এনে বারান্দার খাঁচায় ঝুলিয়ে রেখে পাখিপ্রেমী হিসেবে সমাজে বড়াই করে।

বন্যপ্রাণী আইন অনুযায়ী আমাদের দেশে পাখি কেনা-বেচা এবং পাখি পোষা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সুতরাং আইনের চোখে এই শ্রেণির মানুষরা অপরাধী। অবশ্য কিছু-কিছু বিশেষ প্রজাতির জন্য লাইসেন্স দেওয়া হয়। অপরাধ করেও এই মানুষরা পার পেয়ে যায়। কারণ আইনের ওই ধারাকে কঠোরভাবে বলবৎ করার উদ্যোগ সরকার পক্ষ নেয় না বললেই চলে।

কোনো পাখি দেখতে সুন্দর, কারোর মধুর আওয়াজ, কোনো-কোনো পাখি আবার শেখালে শেখে, নাম ধরেও ডাকে। শুধুমাত্র এই হল পাখিদের অপরাধ। যে কারণে তাদের ঠাঁই হয় চিরজীবনের জন্য খাঁচা নামক হাজতে। একমাত্র তখনই তাদের মুক্তি মিলবে যখন তারা মারা যাবে। একে কি সুস্থ মানসিকতা বলা যায়? মাছ যেমন জল ছাড়া বাঁচে না, পাখিরাও উড়তে না পেরে কতদিন বেঁচে থাকে? ডানায় পক্ষাঘাত নিয়ে কতদিন আর বাঁচা সম্ভব? তার আয়ু কমিয়ে দেওয়া হয় এভাবেই। এভাবেই প্রতিদিন-প্রতিনিয়ত মারা যায় লক্ষ-লক্ষ পাখি, আর মানুষ তৃপ্তি পায় তার বিনোদনের রসটুকু পেয়ে। মানুষ নিজে স্বাধীনচেতা-স্বাধীনপ্রিয়, অথচ কিছু মানুষ পাখিদের দেখতে ভালোবাসে বন্দী অবস্থায় রেখে। পাখিকে খাঁচায় রেখে তাকে তিলে-তিলে হত্যা করার চেয়ে খাঁচা থেকে মুক্ত করে চিরদিনের মতো তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার মধ্যে অনেক বেশি আনন্দ। এটা এইসব মানুষরা বুঝবে কবে? দিন বদলাচ্ছে, কম্পিউটার, টিভি, ইন্টারনেট, মোবাইল মানবজীবনে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। অথচ কিছু সংখ্যক মানুষের বিকৃত মানসিকতা, বর্বরতার পরিবর্তন করতে পারেনি।

ঘটনা ৩

আজ ময়না ঘুম থেকে উঠে নিজের চোখকে বিশ্বাসই করতে পারেনি। কিচির-মিচির শব্দে ঘুম ভাঙতেই ময়না দেখে খাঁচার বাইরে তার আদরের ছানা অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এই তো সেদিন ময়না তার ছানাকে নিয়ে পিপুল গাছের ডালে বাঁধা বাসার পাশের ডালটায় বসেছিল। কোথা থেকে কি হল কে জানে, সে ধরা পড়ল শিকারীর হাতে। তারপর কয়েক হাত ঘুরে এই খাঁচাটায়। খাঁচার মধ্যে ঠিকমতো ঘুরতেই পারে না সে। ময়নার ছানা খুঁজতে-খুঁজতে দেখতে পেয়েছে তার মাকে। কিন্তু ময়না ভেবেই পেল না কীভাবে সে তার ছানার কাছে যাবে। ঠোঁট দিয়ে খাঁচার তারগুলোকে বাঁকাতে চেষ্টা করল অনেক করে। দু'পা দিয়ে আঁকড়ে ধরল অন্য তারগুলোকে। কিন্তু না। তার সব চেষ্টাই যখন বৃথা হল, তখন ময়না হতোদ্যম হয়ে উল্টে দিল জলের বাটিটাকে। খাঁচার তারগুলোকে বাঁকাতে না পেরে তারস্বরে চেঁচাতে থাকল। আর কিবা করতে পারে সে? সে করুণ দৃষ্টিতে ছানার দিকে তাকিয়ে থাকল, ছানাও একদৃষ্টে দেখতে থাকল তার মাকে। আর কোনোদিনই কেউ-কারোর কাছে আসতে পারবে না। ময়না আর কোনোদিন গাছের এডাল-ওডাল করতে পারবে না, মুখে করে খাবার এনে খাওয়াতে পারবে না তার ছানাকে। ছানাও আর কোনোদিন মায়ের সঙ্গে খুনসুটি করতে পারবে না। ময়না দেখতে থাকল ছানাকে, মাকে খুঁজতে-খুঁজতে কী চেহারা হয়েছে তার। ঠিক এমন সময় একটি বাচ্চা ছেলে বারান্দায় এল, যেখানে ময়নার খাঁচাটা ঝুলছিল। সেই বাচ্চা ছেলেটি ছানার দিকে হুস্-হুস্ বলে তেড়ে আসতেই ভয় পেয়ে ছানা উড়ে গিয়ে বসল সামনের গাছের ডালটায়। সে একমনে তার মাকে দেখেই চলেছে। ময়নাও এবার চোখ বুজে ফেলল।

বলতে পারো বন্ধুরা, যত দুঃখ-হাসি, মান-অভিমান, ভালোবাসা এসবেতে কী মানুষেরই একচেটিয়া অধিকার? জন্তু-জানোয়ার, পাখি, এদের কি এসব নেই? তারা কি ভালোবাসে না? সন্তানের প্রতি তাদের কি মমতা নেই? ময়নাদের চোখে কি জল পড়ে না? ওদের বুকে কি কান্না নেই?

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬

Topic : The life story of captive birds in Bengali, বন্দী পাখির কথা

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ