Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ছেলেবেলার ভূতের গল্প ।। প্রবীর জানা



আমরা তখন বেশ ছোটো ছিলাম। আমরা বলতে আমি, বোন আরতি ও কাকার ছেলে বুবুনের কথা বলছি। আমাদের ছিল যৌথ ফ্যামিলি। বাবা-কাকা-জেঠা আরো অনেকে একসঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন।

জানলার ফাঁক দিয়ে ভোরের আলো আমার বিছানায় পড়েছে। ভাবছি আর কিছু সময় শুয়ে থাকলে কেমন হয়, এমন সময় উঠোনের দিক থেকে মংগলু কাকার গলা শোনা গেল। মংগলু কাকা রোজ সকালে মাছ দিতে আসে। কালো পাথরের স্ট্যাচুর মতো মজবুত তার শরীর, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। থাকে জেলেপাড়ায়। উঠোনের কাছে এসে উঁকি দিয়ে দেখলাম তার বাঁশের খাঁচায় কোনো মাছ নেই। তাকে দেখে মনে হল, সে বেশ উত্তেজিত, তার চোখ দুটো জবা ফুলের মতো লাল।

বাবা উঠোনে এসে বললেন, মংগলু তোমার মুখে আর সারা শরীরে এমন দাগ কিসের ?

মংগলু কাকা বাবার কথা থামিয়ে বলল, কর্তা ঠিকই বলেছেন, এগুলো আঁচড়ের দাগ। হিংস্র, ঠিক যেন জানোয়ারের মতো, কিন্তু জানোয়ার নয়। কি বীভৎস তাদের চেহারা!

বাবা অবাক হয়ে বললেন, তাহলে!

আরতি ও বুবুন ঘুম থেকে উঠে চলে এসেছে উঠোনে। তারা মংগলু কাকার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে, সে কি বলছে শোনার জন্য।

মংগলু কাকা আবার বলতে শুরু করল, কাল ছিল অমাবস্যা। অন্যদিনের মতো কাল সন্ধ্যায় আমি ও বুধু খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। আকাশ বেশ গম্ভীর। সন্ধ্যা থেকে অল্প-অল্প বৃষ্টি পড়ছে। ভরা কোটাল। মাছ ধরার ডিঙিটা বাঁধা আছে মোটা দড়ি দিয়ে, তালপাটি খালের মোহনায় শ্যাওড়া গাছের সঙ্গে। আমাদের কাঁধে আছে ঘুনি জাল। খালের জলে জাল পাতা হয়ে গেছে। জোয়ারের স্রোত বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে ঝাঁকে-ঝাঁকে ইলিশ, ভেটকি, পার্সে, পমফ্রেট আরো কতরকম মাছ জালে আটকে যাচ্ছে। আমিও বুধু মনের আনন্দে জাল থেকে মাছ তুলে ডিঙিতে রাখছি।

ভাটা শুরু হল। জাল তুলে ডিঙিতে রাখলাম। বড়ো-বড়ো দুটো বাঁশের খাঁচা ভরে গেল মাছে। লগি ঠেলে ডিঙি তীরে এলে ভর্তি খাঁচা দুটো রাখলাম খালপাড়ে।

রাতের অস্পষ্ট অন্ধকারে মনে হল এক ঝাঁক লোক শ্যাওড়া গাছ থেকে নেমে আসছে। প্রথমে মনে হচ্ছিল হয়ত চোখের ভ্রম। ছায়ার মতো লোকগুলো আরো কাছে এলে তাদের দেখে ভয়ে আমি কাঁপতে লাগলাম। বুধু আমার একটা হাত যে জড়িয়ে ধরেছে তা কিছুতেই ছাড়ছে না। আমি মাটিতে ধপাস করে বসে পড়লাম। বুধু আমার বুকের  ওপর মাথা রেখে ন-নরণ ন-চরণ। আমি ঠিক মরার মতো শুয়ে পিটপিট করে তাকিয়ে দেখছি। নিজের মাথা ঘাড় থেকে নিজের হাতে নিয়ে একটা ছায়ামূর্তি আমার দিকে এগিয়ে এল বলতে-বলতে, খুব শীত করছে, গরম-গরম লাল চা খাব।

আমি কাঁপা গলায় বললাম, লাল চা! এখানে তো চায়ের দোকান নাই!

উত্তর ভেসে এল হাওয়ায়, তোর ঘাড় মটকে লাল চায়ের মতো গরম রক্ত খাব। বুধু তার ঠোঁট আমার কানের কাছে এনে অস্পষ্ট ভাষায় বলল, পিশাচ! পেত্নি।

একটা কঙ্কাল এসে বাঁশের খাঁচা থেকে মাছ বের করে খাচ্ছে আর বলছে, আঃ কী মিঠা! ভাবলাম মেছো ভূত। তা না হলে কাঁচা মাছ খাবে কেন!

সধবার মতো শাড়ি পরা এক মহিলা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, চিনতে পারিসনি আমাকে ? আমি খেঁদি। রঘু বাগদির বউ।

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, সে তো কবে মরে ভূত হয়ে গেছে সেবার বন্যার জলে ডুবে। কিন্তু নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে বললাম, আচ্ছা।

সে বলল, আগে ছিলাম রঘু বাগদির বাড়ির গিন্নি। এখন হয়ে গেছি শাঁখচুন্নি।

গোঁফ নেই কিন্তু লম্বা দাড়ি আছে। চেনা-চেনাও মনে হচ্ছে। ঠিক যেন আমাদের গ্রামের আক্তার মিঞার মতো। সে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে হাসছিল। বুঝলাম ঠিক ভেবেছি, আক্তার মিঞাই তো। পীরের কাছে দীক্ষা নিয়ে যে বিবাগী হয়েছিল জানি। তাকে দেখে মনে কিছুটা সাহস পেলাম। তার পাশে দাঁড়িয়ে খালি গা, মাথায় টাক, গলায় পৈতা, খড়ম পায়ে আমাদের পুরুত মশাই না! মনে আছে, ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে, ছাতা মাথায় হেঁটে গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে একদিন যাচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ বাজ পড়ল তাঁর ছাতার ওপর। মারা গেলেন তিনি। কিন্তু মারা যাওয়ার পরে এখানে এলেন কি করে!

আক্তার মিঞা চিৎকার করে বলতে লাগল, দেখতা কি হ্যায় ? খড়া রহা হাম দো, ব্রহ্মদত্যি আওর মামদো।

বুঝতে আর বাকি রইল না যে, ওরা মরে ভূত হয়ে আজ ব্রহ্মদত্যি আর মামদো। কী উত্তর দেব ভাবছি, এমন সময় পেত্নী আমার ঘাড় চেপে ধরে বলল, একবার বর্গীরা হুগলি নদী দিয়ে নৌকায় চেপে এই গ্রামে এসে লুটপাট করতে থাকে। বাধা দিলে তলোয়ার দিয়ে আমার গলা কেটে দেয়। সেদিন থেকে চেষ্টা করছি মাথাটা শরীরের সঙ্গে জোড়া লাগাতে। পারছি না, কিছুতেই পারছি না। তবে খেতে অসুবিধা হয় না আমার। এই যেমন এখন গরম-গরম লাল চায়ের মতো তোর রক্ত খাব।

খড়ম পায়ে ব্রহ্মদত্যি ছুটে এসে ঘুসি মেরে সরিয়ে দিল স্কন্ধকাটাকে। দূরে দাঁড়িয়ে খ্যাংরা, নুলো, মোটা ভূত, ঢ্যাঙা ভূত, বেঁটে ভূত, কালো ভূত, সাদা ভূত আরো কতরকম ভূত আনন্দে নাচছে ঘুসির আঘাতে স্কন্ধকাটাকে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতে দেখে।

ব্রহ্মদত্যি বলল, আজ শ্যাওড়া গাছে আমাদের মিটিং ছিল।

বুধু সাহস করে বলল, মিটিং!

ব্রহ্মদত্যির চোখ দুটো আগুনের গোলার মতো জ্বলছে। সে ঘড়ঘড় শব্দে বলল, মানুষেরা কি চালাক! তারা খুন, চুরি-ডাকাতি কত অপরাধ করে। প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার জন্য আমাদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়ে বলে ভুতুড়ে কাণ্ড। আমি যখন বেঁচে ছিলাম অফিসে গিয়ে বাড়ির ট্যাক্স দিলাম। কম্পিউটার নামক যন্ত্রে সব লিখে নিল। কিছুদিন পরে খবর পাঠাল, ভুতুড়ে কাণ্ড ঘটে গেছে। লেখা মুছে গেছে। এসব ঘোরতর অন্যায়। মানছি না, মানবো না।

জটলা করে দাঁড়িয়ে থাকা ভূতগুলো বলতে থাকল সুর করে, মানছি না, মানবো না। মানছি না, মানবো না। আমি ইনিয়ে-বিনিয়ে কেঁদে বলতে লাগলাম, পুরুত মশাই, অপরাধ নেবেন না। আমি এমন কথা কখনো বলিনি।

ব্রহ্মদত্যি গর্জে উঠল, পুরুত কিরে ? আমি ব্রহ্মদত্যি। সকলকে বলে দিবি, কেউ যেন আমাদের বদনাম না করে। এখন আমি ভূতের দলের সভাপতি। আকতার মিঞা অর্থাৎ মামদো সম্পাদক।

যদিও ছেলেবেলার ভূতের গল্প তবুও মনে আছে, আমি লক্ষ্য করিনি আরতি ও বুবুন ভয় পেয়ে কখন আমার দিকে সরে এসে মংগলু কাকার কথা শুনছিল।

বাবাকে সব সময় মনে হত খুব রাগী মানুষ। কিন্তু মংগলু কাকার মুখে ভূতের সব  ঘটনার কথা শুনে কেমন যেন মিইয়ে গেলেন।

মাকে দূর থেকে বলতে শোনা গেল, ভূতে ছোঁয়া মাছ না এনে ভালো করেছিস। মাছের সঙ্গে ভূত যদি চলে আসতো! রাম! রাম!

আমি, আরতি ও বুবুন নিঃশ্চুপ, কারো মুখে কথা নেই।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । জুলাই ২০১০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ