Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

শশীবাবুর আশীর্বাদ ।। পৌলমী ঘোষ

 

টিকলুর আজকে মন একদম ভালো নেই। চোখের কোলে জলের ফোঁটা জমে রয়েছে। কতবার ও মাকে বুঝিয়েছে, বাবার কাছে কান্নাকাটি করেছে, কিন্তু কিছুতেই তারা টিকলু সমস্যাটাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বাবা-মায়ের ধারণা সে ইচ্ছে করেই অংকে বারবার খারাপ ফল করছে। কিন্তু এখন কি হবে? বাড়ি গিয়ে টিকলু মাকে কিভাবে বলবে, যে ও অংকে এবার ফেল করেছে। বাবাকেই বা কি জবাব দেবে? কাল থেকে মাঠে যাওয়া, আঁকার স্কুলে যাওয়া, কার্টুন দেখা সব বন্ধ হয়ে গেলে চলবে কিভাবে? নাহ্ মাথা আর কাজ করছে না টিকলুর।

''রত্নজিৎ-রত্নজিৎ''। কে যেন ডাকছে তার ভালো নাম ধরে। কাঁধে আলতো স্পর্শ পেয়ে পিছন ফিরল টিকলু। 'নে-নে ওঠ। বাড়ি যেতে হবে তো।' রিক্সা কাকুর ডাকে টিকলুর খেয়াল হল, ছুটির পর কতক্ষণ যে মাঠে ধুলোর মধ্যে বসেছিল, মনেও ছিল না।

মা একটা কথাও বললেন না। টিকলু জানে রেগে গেলে মা এমনটাই করে। বাবা অঙ্কের খাতা তাকিয়েও দেখেননি, শুধু শেষ পাতায় সই করে দিয়েছেন। কিছুতেই ঘুম আসতে চাইছে না, বাবা-মার জন্য কেমন কষ্ট হল টিকলুর। ঐকিক নিয়ম, সিঁড়ি ভাঙা সরল, ল.সা.গু, গ.সা.গু জীবনটাকে যেন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। রাত একটার ঘন্টা বাজল। চোখ দুটোকে চেপে বন্ধ করে ঘুমোতে চেষ্টা করল টিকলু। হঠাৎ! ঘটনাটা হঠাৎই ঘটে গেল। অস্পষ্ট স্বরে কেউ যেন টিকলুর ভালো নাম ধরে ডাকছে! মাথাটা আস্তে-আস্তে শান্ত-ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, আর দুনিয়ার ঘুম এসে ভিড় করছে চোখে। তারপর আর কিছুই ওর মনে নেই।

'সকলে অংক খাতা পেন বার করে বসো'। স্যার খুব রাগী, ক্লাসে আজ অংক ভুল করলেই ভীষণ শাস্তি পেতে হবে। টিকলুর মনে-মনে অস্বস্তি হতে থাকে। হঠাৎই আবার অষ্পষ্ট সুরে কেউ যেন ডাকল, 'রত্ন-জি-ই-ত-ত'। এপাশ-ওপাশ ঘাড় ঘুরিয়ে টিকলু বোঝার চেষ্টা করল, কিন্তু সব বন্ধুরা তো অংক করতেই ব্যস্ত। সুতরাং কিছু না ভেবে আবার অংকে মন দেয় টিকলু। 'খুব ভালো সব ঠিক হয়েছে রত্নজিৎ চেষ্টা করলে সব হয়।' টিকলু মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। আজকে কি করে সবকটা অংক ঠিক হয়ে গেল!

বাবা টিকলুকে সারা সন্ধে আজ অংক কষালেন। ম্যাজিক হয়ে যাচ্ছে খাতার মধ্যে। টিকলু এত দ্রুত কোনোদিনই অংক কষতে পারে না। সিঁড়ি ভাঙা সরল ধাপে ধাপে নেমে পিকলুর হাতে পরাজিত হল। ল.সা.গু-গ.সা.গু নিমেষে শেষ। পিতা-পুত্রের বয়সের সমষ্টি নিয়ে একটা কঠিন অংক আছে। বাবা যতবারই টিকলু অংকটা কষতে দিতেন, পুত্রের বয়স বেশি আর পিতার বয়স কম হয়ে যেত। কিন্তু আজকে দাদু-ঠাম্মি-মা সবাই অবাক! টিকলু অংকটা সঠিক করে দেখিয়ে দিল।

বালিশে ঘুষি মেরে দুবার লাফিয়ে টিকলু বাবাকে বলল, অংকে আর ভয় পাচ্ছি না বাবা। একইরকমভাবে মাস দুয়েক ভালো করেই কেটে গেল। টিকলুকে দেখে বন্ধুরা আর হাসাহাসি করে না। বাবা-মা সবাই টিকলুর পড়াশোনায় মনোযোগ দেখে দারুণ খুশি।

পাড়ার পরেশবাবু টিকলুর বাবার ছোটোবেলার বন্ধু। পরেশবাবুর ছেলে প্রশান্ত একই স্কুলে টিকলুর সহপাঠী। টিকলু অংকে দক্ষতা যেভাবে দিনদিন বাড়ছে, তাতে আনন্দের চেয়ে ভয় আমার বেশি হচ্ছে। পরেশবাবুর এহেন কথায় বিরক্ত হয়ে উঠলেন টিকলুর বাবা।

পরেশবাবুর বললেন- প্রায় বারোবছর আগের ঘটনা। টিকলুদের হরিপুর হাইস্কুলে এক বয়স্ক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন শশীভূষণ দত্ত। অঙ্কের মাস্টার। অতি সজ্জন মানুষ ছিলেন তিনি। বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে তার শান্তির সংসার। একমাত্র মেয়ে বিবাহিতা। সময় কাটত না বলে ছাত্র পড়াতেন। বলা ভালো অংক কষা তাঁর নেশা। কত দুঃস্থ ছাত্রকে বিনা পয়সায় অংক শিখিয়েছেন। একদিন রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মারা গেলেন। তারপর থেকে অনেকের মুখে মৃত শশীবাবুকে নিয়ে অনেক কথা শোনা গেছে। কেউ বলে, রেললাইনের ধারে এখনো তাঁকে দেখা যায়, আবার কেউ তাঁকে তাল গাছের ওপরে একটা পা ঝুলিয়ে বসে অংক করতে দেখেছে। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, সাদা ধুতি আর ফতুয়া পরে, আপন মনে তিনি অংক কষেন। আবার কেউ বলে, তার অতৃপ্ত আত্মা তাঁর ছাত্রদের ক্রমাগত লেখাপড়ায় সাহায্য করে চলেছে।

পরেশবাবুর কথায় ভয়ে কাঁটা হয়ে যান টিকলুর বাবা। পরেশবাবু আশ্বস্ত করে বলেন, এভাবে ভেঙ্গে পড়িস না। তুই টিকলুকে ঠাণ্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করে দেখ, যে ওর নাম ধরে কেউ ডাকে কিনাবিধ্বস্ত ক্লান্ত হয়ে টিকলুর বাবা সোজা চলে গেলেন ছেলের ঘরে? যা দেখলেন তাতে হতভম্ব হয়ে যাবারই কথা। টিকলুর অঙ্কের খাতা-বই খুলে নিজের মনে কথা বলছে, শুনলে মনে হবে ঠিক যেন ছাত্র-শিক্ষকের কথোপকথন। মুহূর্ত দেরি না করে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। আর বলতে থাকলেন- আপনি চলে যান মাস্টারমশাই। আইনস্টাইন ছেলে আমার চাই না। অংকে ফেল করুক।

টিকলু বিরক্তিতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বলল, অংকে ফেল করলে তুমি কি আমায় আর ভালবাসবে? বল না বাসবে?

টিকলু আজকাল কোনো কথা বলে না। সারাদিন বাইরের দিকে কি যেন খুঁজে চলে। বাবা-মা এক মুহূর্তের জন্য টিকলুকো একা ছাড়ে না। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো। শশী মাস্টারের সঙ্গে টিকলুর আর দেখা হয় না ঠিকই, তবুও টিকলু দিনের পর দিন দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছে অংকে। তবে কি শশী মাস্টারমশাই টিকলুকে সারা জীবনের জন্য ভালো রেজাল্ট করার আশীর্বাদ দিয়ে গেছেন! শোনা যায় হরিদেবপুর হাই স্কুলের যে সমস্ত ছাত্র অংকে কাঁচা, মৃত শশীবাবু বারবার ফিরে আসেন তাদের অংক শেখাতে।

 

অলংকরণ- রাহুল মজুমদার

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১৩






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ