![]() |
আমাদের মাথার ওপর ছাতার মতো মস্ত বড়ো যে নীলা আকাশ, সেই নীল আকাশে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় সব মেঘেরা। ওই নীল আকাশেই মেঘেদের বাড়ি। অত বড়ো বাড়িতে মাত্র দু-জন থাকে। একজন সাদা মেঘ, আর অন্যজন হল কালো মেঘ।
সাদা মেঘের মন সব সময় খুশিতে ভরা। নীল আকাশের ভেলায় চেপে নানা দেশে ঘুরে বেড়ায়। এই উড়ে বেড়ানোর সময় মেঘপরিদের সঙ্গে সাদা মেঘের দেখা হয়। মেঘপরিরা সাদা মেঘকে 'মেঘদাদা' বলে ডাকে। মেঘদাদার সঙ্গে দেখা হলে মেঘপরিরা কত গল্প করে। আবার সাত-রঙা রামধনু সঙ্গে দেখা হলে তার ডানায় ভর দিয়ে সাদা মেঘ এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি দেয়।
আর কালো মেঘ? তাকে দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়? সূয্যিমামার কাছে গেলে সূয্যিমামা দুঃখে আর পৃথিবীর বুকে আলো ছড়ায় না। চাঁদের কাছে গেলেও চাঁদ নীল আকাশের বুকে লুকিয়ে পড়ে। আর অত রঙের বাহার নিয়ে যে রামধনু সেও কালো মেঘকে দেখলে নীল আকাশের বুকে লুকোচুরি খেলে। কালো মেঘের সঙ্গে মেঘপরিরাও কথা বলে না। তাই কালোমেঘের মনে খুব দুঃখ। সে মনে মনে ভাবে আমাদের দেখে সবার ওরকম মুখ লুকানোর কি আছে! আমি কি এতটাই দেখতে খারাপ!
আর এদিকে নীল আকাশে সাদা মেঘের কি আদর। তাকে দেখলেই সবাই কাছে এসে কথা বলে তার কুশল সংবাদ নেয়। কিন্তু কালো মেঘকে আসতে দেখলেই সাদা মেঘ মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। শরৎকালের সাদা মেঘ আকাশের বুকে একটু নিশ্চিন্তে ঘুরতে পারে। সেই সময়ে কালো মেঘকে আকাশে খুব একটা দেখা যায় না। এই সময়ে আকাশ জুড়ে সাদা মেঘেরই দাপট।
একবার হঠাৎ করে শরৎকালে দুর্গাপুজোর দু-দিন আগে কালো মেঘ এসে হাজির হল নীল আকাশের বুকে।
কালো মেঘকে দেখেই সাদা মেঘ মনে মনে ভাবল, এবার হঠাৎ কালো মেঘ এল কেন? এই সময় তো ওর এখানে আসার কথা নয়! এই সময়টাতো আমি একাই সারা আকাশ জুড়ে ঘুরে বেড়াব। কালোমেঘের নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। ও নিশ্চয়ই আমার ফর্সা রংটা কালো করে দিতে চায় যাতে ওর মতো আমাকে দেখলেও সবাই মুখ লুকিয়ে ফেলে। তার থেকে বরং এখান থেকে এক্ষুনি পালিয়ে যাই। যেই ভাবা সেই কাজ। সাদামেঘ ভেলায় চেপে দে ছুট।
সাদা মেঘের এরকম ব্যবহার দেখে কালো মেঘের খুব মন খারাপ হয়ে গেল। এমন মন খারাপ যে সে কেঁদেই ফেলল। আর সেই কান্না আর থামে না, চলল টানা সাতদিন। দুর্গাপুজোর সময় চারিদিকে একেবারে জল থৈ-থৈ। দুর্গাপুজোর মণ্ডপ ভিজে এক শেষ। দুর্গা প্রতিমাও গেল ভিজে। লক্ষ্মীর পেঁচা ভিজে আমগাছের ডালে চুপ করে বসে রইল। গণেশের ইঁদুর শুকনো জায়গার খোঁজে তিন্নিদের বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকে গেল। কার্তিকের ময়ূর বৃষ্টিতে পেখম তুলে নাচতে শুরু করল।
এসব দেখে তিন্নি ও মুন্নির খুব মন খারাপ হয়ে গেল। পুজোয় কতগুলো নতুন জামা
হয়েছে। সেগুলো এক-একদিন একটা পরে পুজো মণ্ডপে যাবে। বন্ধুদের সঙ্গে আনন্দ করবে।
সবকিছু একেবারে মাটি হয়ে গেল। এরকম অবস্থা দেখে কালো মেঘেরও মনটা খুব খারাপ হয়ে
গেল। মনে মনে ভাবল, এই সময় বৃষ্টি
নামিয়ে তিন্নি-মুন্নিদের মতো ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের পুজোর আনন্দটা শেষ করে
দেওয়া তার উচিত হয়নি। কিন্তু সাদা মেঘের ওইরকম ব্যবহারে তার মনে খুব দুঃখ
হয়েছিল।
একদিন কালো মেঘে ঠিক করল, যে আকাশদাদার কাছে সাদা মেঘের সম্বন্ধে নালিশ জানাবে সেই মতো এক দিন রোদে ছাতা মাথায় দিয়ে কালো মেঘ গিয়ে হাজির হল আকাশ দাদার কাছে। কালো মেঘের সব কথা শুনে আকাশদাদা সাদা মেঘকে ডেকে পাঠাল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাদা মেঘ এসে হাজির হল সেখানে।
সাদা মেঘের সঙ্গে কালো মেঘের চোখাচোখি হতেই সাদা মেঘ চোখ সরিয়ে নিল, যেন তাকে চেনেই না। সাদা মেঘের এরকম আচরণ দেখে কালো মেঘের খুব কষ্ট হল। কালোমেঘ মনে মনে ভাবল, আমাদের দুই মেঘের দেখা তবু সাদা মেঘ কোনো কথা বলল না, এত অহংকার।
এবার আকাশদাদা দুই মেঘকে নিয়ে বিচার করতে বসল।
আকাশদাদা বলল, আচ্ছা সাদা মেঘ তুমি নাকি কালো মেঘের সঙ্গে দেখা হলে খুব খারাপ ব্যবহার কর?
আকাশদাদার একথা শুনে সাদা মেঘ আমতা আমতা করে বলল, না সেরকম কিছু নয়।
সাদা মেঘের কথা শুনে কালোমেঘ রেগে গিয়ে বলল, কী আমাকে দেখলে মুখ বেঁকিয়ে তুমি চলে যাও না?
সাদা মেঘ বলল, যাব না, তোমার গায়ের ওই বিচ্ছিরি রং যদি আমার গায়ে লেগে যায় তাহলে কি হবে ভেবেছ। আর তাছাড়া আমি কারও রঙ একদম পছন্দ করি না।
ও এই কথা। আমার প্রতি তোমার এত ঘেন্না। তুমি তো জানো আমিই পৃথিবীর বুকে বৃষ্টি আনি আর বৃষ্টি আনি বলেই ফসল হয়। নদীতে জল উপচে পড়ে। পুকুর জলে ভরে ওঠে। আর তোমার জ্বালায় যখন মানুষ হাঁসফাঁস করে, তখন তারা আমার পথ চেয়ে বসে থাকে। মানুষ এতটাই ভালোবাসে আমাকে।
কালো মেঘের কথা শুনে সাদা মেঘ রেগে গিয়ে বলল, ভালোবাসে না ছাই। একটানা বৃষ্টি ঝরিয়ে চারিদিকে জল থৈ থৈ করে রাখো তুমি। তখন তো আমারই ডাক পড়ে। আর তাছাড়া গতবার পুজোর সময় বৃষ্টি ঝরিয়ে বাচ্চাগুলোর আনন্দটাই মাটি করে দিলে। এই কাজটা কি ঠিক করেছ?
কালোমেঘ একেবারে চুপ।
এবার আকাশদাদা বলল, শোনো আমার দেশে সাদা মেঘও যেমন থাকবে, কালো মেঘও তেমনই থাকবে। কারোর সঙ্গে কেউ ঝগড়া করবে না। কালো মেঘ যেমন বৃষ্টি আনে, সেটাও যেমন দরকার, সাদা মেঘ আবার ঝলমলে রোদ আনে সেটাও দরকার। তোমরা দু-জনে ভাই-ভাই।
আকাশদাদার কথা দুই মেঘেরই মনে ধরল। ওরা দুজনে হাত ধরাধরি করে নীল আকাশের বুকে উড়ে বেড়াতে লাগল।
অলংকরণ- রাহুল মজুমদার
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । এপ্রিল ২০১৪
0 মন্তব্যসমূহ