দারুণ! দারুণ! চমৎকার! আহা কি দেখলাম! পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখার পর ঠিক এইরকম বাক্যই বারবার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে জ্যোতির্বিজ্ঞানী সহ প্রকৃতিপ্রেমী মানুষজনের। অনেকে বলেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক লীলা। সূর্যগ্রহণ এক চিরসুন্দর প্রাকৃতিক ঘটনা। রাহু-কেতু সূর্যকে ঘিরে ফেলার কোনো অবাস্তব ঘটনা নয়। ২০০৯ সালের ২২শে জুলাই ভারতের বেশ কিছু অঞ্চল এবং বাংলাদেশ, মায়ানমার, ভুটান চীন ও জাপানের কিছু অঞ্চল থেকেও দেখা গেল শতাব্দীর দীর্ঘতম পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ। পাটনার আকাশে শেষ মুহূর্তে কালো মেঘ এসে হাজির হলেও বারাণসী ও রায়গঞ্জের বহু মানুষ অবলোকন করলেন অপার্থিব নয়নাভিরাম বেলি'স বিড, ডায়মন্ড রিং, করোনা। যা সারাজীবন তাদের স্মৃতি হয়ে থাকবে।
সূর্যগ্রহণ কেন হয়-
সূর্যের চারিদিকে ঘোরার সময় যখন পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে একই সরলরেখায় চাঁদের অবস্থান ঘটে, তখন হয় আমাবস্যা। আর কোনো কোনো অমাবস্যায় ঘটে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ।
প্রাচীনকালে গ্রহণ কীভাবে লেখা হত-
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন চিনে ৪০০০বছর আগে ও মিশার ৪৫০০বছর আগে সূর্যগ্রহণ হয়েছিল। মেসোপটেমিয়াতেও প্রাচীন গ্রহণের সন্ধান মিলেছে। তখন কাগজ আবিষ্কার হয়নি। মিশরীয়রা পোড়া মাটির ওপর ও চিনের লোকেরা পশুর হাড়, কচ্ছপের পিঠ ও ষাঁড়ের সিং-এর ওপর গ্রহণের কথা লিখে রাখত। এসকল নিদর্শনগুলি বর্তমানে উদ্ধার হয়েছে।
জেনে রাখ-
১. খালি চোখে সূর্যের যে অংশ দেখা যায় তাকে বলা হয়- ফোটোস্ফিয়ার।
২. চাঁদ সূর্যের থেকে ৪০০গুন ছোটো।
৩. সূর্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ যে গ্যাসটি রয়েছে সেটি হল হাইড্রোজেন।
৪. সূর্যের কেন্দ্রস্থলের তাপমাত্রা হল ১৩,৬০০,০০০ কেলভিন।
৫. সূর্যের ব্যাস ১৩,৯২,০০০কিলোমিটার। চাঁদের ব্যাস ৩৪৭৬কিলোমিটার।
৬. সূর্যের আলো পৃথিবীতে আসতে সময় নেয় ৮.৩১ সেকেন্ড।
৭. টেলিস্কোপ দিয়ে সূর্যগ্রহণ প্রথম অবলোকন করা হয় ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সে।
৮. সূর্যের খণ্ডগ্রাস গ্রহণ ২৩০ থেকে ২৪০ মাইল এলাকা জুড়ে দেখা গেলেও পূর্ণগ্রাস দেখা যায় ১৭০ থেকে ১৮০ মাইল এলাকায়।
৯. চন্দ্রগ্রহণ দেখা যায় পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক অংশ থেকে। সূর্যগ্রহণ দেখতে
পায় পৃথিবীর ৪০০ ভাগের এক ভাগ অংশের
লোক।
১০. কোনো একটি জায়গায় পূর্ণ সূর্যগ্রহণ একবার দেখা গেলে সেখানে পুনরায় সূর্য গ্রহণের দেখা মেলে ৩৬০ বছর পর।
দেশ-বিদেশের নানা গল্প-
সারা পৃথিবী জুড়েই দেবতা-চাঁদ-সূর্য ও দৈত্য-দানবদের নিয়ে গ্রহণকে ব্যাখ্যা দেবার নানান গল্প ছড়িয়ে রয়েছে। সে যুগে স্বল্প জ্ঞানের উপর নির্ভর করে মানুষেরা যেসব মুখোরোচক গল্পগুলি প্রচলন করেছিলেন তার কয়েকটি তোমাদের জন্য তুলে দিলাম।
পুরাণের গল্প-
দেবতা ও অসুরদের মিলিত প্রচেষ্টায় সমুদ্রমন্থনে উঠল অমৃত। আমৃত ভাগাভাগির সময় রাহু নামক অসুর দেবতাদের ছদ্মবেশে সূর্য আর চাঁদের মাঝখানে অমৃত খেয়ে ফেলল। চাঁদ আর সূর্য চিনতে পেরে বিষ্ণুকে জানিয়ে দেয়। বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে অসুরের মুন্ডু কেটে দিলেন। সেই থেকে অসুরের মুণ্ডু হল রাহু আর দেহটা হল কেতু। দেহ বিহীন রাগের বশে সূর্য আর চাঁদকে মাঝেমধ্যেই গিলে ফেলে। যে হেতু অসুরের গলাটা কাটা তাই গিলে ফেললেও পুনরায় মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসে। গ্রহণ নিয়ে এমন গল্প আমাদের পুরাণে আছে।
টোডাদের গল্প-
তামিলনাড়ুর টোডা উপজাতিদের ধারণা চাঁদে একটা বেশ বড়ো খরগোশ আছে। এই খরগোশকে খাবার জন্য আকাশে ঘুরে বেড়ায় একটা বিশাল সাপ। এই সাপটা সুযোগ পেলেই খরগোশ শুদ্ধ চাঁদটাকে পেছন থেকে গিলে ফেলে। তবে গিলে ফেললেও অত বড়ো খরগোশকে খেতে পারে না, উগরে দেয়। এজন্য টোডোরা গ্রহণের সময় ক্যানেস্তারা বাজাতে থাকে, যাতে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়।
মুণ্ডা উপজাতি গল্প-
মুণ্ডা উপজাতিদের ধারণা আকাশে ধাঙকো নামে এক ধণী অসুর থাকে। ধাঙকোর প্রচুর সম্পত্তি। চাঁদ ও সূর্য বখাটে ছেলেদের মতো সর্বক্ষণ বেহিসেবি খরচ করতে ভালোবাসে। এই ধাঙকোর কাছ থেকেই ওরা টাকা ধার নেয় আর খরচ করে। ধাঙকো টাকা ধার দিলেও বেশ হিসেবি। সময় মতো টাকা শোধ না দিলে সে ক্ষেপে যায়। তখন চাঁদ আর সূর্যকে কোমড়ে দড়ি বেঁধে টানতে টানতে নিয়ে এসে কারাগারে ঢুকিয়ে দেয়। ফলে আকাশ থেকে চাঁদ আর সূর্য অদৃশ্য হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার হয়।
তাই মুণ্ডারা মনে করে এই চাঁদ আর সূর্যের ঋণ তারা যদি পরিশোধ করে করে দেয় তাহলে ধাঙকো ওদের মুক্তি দেবে। তাই গ্রহণ শুরু হওয়া মাত্র মুণ্ডারা তাদের থালা-বাসন, খাবার-দাবার অন্যান্য জিনিসপত্র উঠোনের সামনে এনে হাজির করে। যাতে ধাঙকো খুশি হয়ে এগুলি গ্রহণ করে আর চাঁদ আর সূর্যকে ছেড়ে দেয়।
এস্কিমোদের গল্প-
মেরুপ্রদেশের এস্কিমোরা মনে করে মাঝেমধ্যেই সূর্য আর চাঁদের অসুখ করে। তাই কখনো কিছুক্ষণের জন্য আকাশে দেখা যায় না। অসুখ সেরে গেলে তবেই ওদের দেখা মেলে। আর অসুখের সময় ওদের শরীরের রোগ জীবাণু পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এস্কিমোরা গ্রহণের সময় খাবার দাবার ঢেকে রাখে বাসনপত্র সব উল্টে রাখে।
চিনের গল্প-
চিনা ভাষায় গ্রহণকে বলা হয় 'CHIH' - মানে খেয়ে নেওয়া। চিনাদের ধারণা প্রচুর শক্তিধর কিম্ভুত সাপের মতো প্রকাণ্ড এক ড্রাগন তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়। আর সুযোগ পেলেই দলবল নিয়ে সূর্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। আর ড্রাগনের নাক দিয়ে বিষাক্ত নিঃশ্বাস বের হয়ে বাতাসে মেশে। তাই চিনারা গ্রহণের সময়ের খাবার দাবার ফেলে দেয়।
যুদ্ধের সময় ড্রাগণ সূর্যকে গিলে ফেললেই পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসে। পৃথিবীতে অমঙ্গল দেখা দেবে এই আশঙ্কায় চিনারা গ্রহণের সময় ঢাক-ঢোল-কাঁসি ইত্যাদি বাজাতে শুরু করে। ফলে ভয় পেয়ে ড্রাগন পালিয়ে যায়। ড্রাগনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আবার আলোকিত হয়ে আকাশে দেখা দেয় সূর্য।
চিন সম্রাট চুঃ কাং এই বিপদ থেকে দেশকে রক্ষা করতে 'হি' আর 'হো' নামের দুই রাজ্যজ্যোতিষীকে রাজদরবারে নিযুক্ত করেছিলেন' কিন্তু খ্রীস্টপূর্ব ২১৩৭ সালের ২২শে অক্টোবর চিন দেশে যে গ্রহণ হয় তা আগে থেকে বলতে না পারায় সম্রাটের আদেশে দুই রাজজ্যোতিষীর মুণ্ডু কাটা হয়েছিল।
নরওয়ের গল্প-
নরওয়েতেও গ্রহণ নিয়ে রোমাঞ্চকর গল্প আছে। দৈত্যযোদ্ধা ঈমিরকে বধ করে দেবতারা দৈত্যের শরীরকে আকাশের একটা বিশাল ফাঁকে গুঁজে দিয়ে পৃথিবীর সৃষ্টি করেন। দেবতাদের গড়া সুন্দর পৃথিবীকে ধ্বংস করার জন্য 'হাটি' (বিদ্বেষ) ও 'স্কোল' (ঘৃণা) নামের দুই ভয়ানক দৈত্য নেকড়ে বাঘের আকার ধারণ করে আকাশে ছুটে বেড়ায় এবং সুযোগ পেলে চন্দ্র-সূর্যের ঘাড়ে চড়ে গিলতে আসে। তখন স্বর্গের দেবতারা এবং মর্তের মানুষ এরা একসঙ্গে চিৎকার-কোলাহল করতে শুরু করে। সেই কোলাহলে বাঘরূপী দৈত্য দুটি থমকে গেলে চাঁদ আর সূর্য ছুটে পালিয়ে আসে।
সারা পৃথিবী জুড়ে গ্রহণ নিয়ে এই ধরনের বহু যুক্তিহীন গালগল্প প্রচলিত আছে। যেগুলি শুনতে ভালো লাগলেও কোন বৈজ্ঞানিক ধারণা নেই।
বিজ্ঞান নাকি কুসংস্কার, কাকে মানব-
অবশ্যই বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক যুক্তিনিষ্ঠ মতবাদেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
গ্রহণের মতো প্রাকৃতিক ঘটনাকে কুসংস্কারের গল্প দিয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া অন্যায়।
চন্দ্রগ্রহণ সূর্যগ্রহণের সময় নানা রকম রোগ জীবাণু ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া পৃথিবীতে
নেমে আসে- এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল এবং যুক্তিহীন। গ্রহণের সময় চাঁদ বা সূর্য আড়াল
হয়ে অন্ধকার নেমে আসার জন্য খাওয়া-দাওয়া বন্ধ রাখতে হয় তাহলে তো প্রতি রাতেই
সূর্যকে দেখা যায় না, অন্ধকার থাকে,
তখন তো আমরা
খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করি না! আর খাবার তুলসী পাতা বা কুলেরর কাঁটা দিয়ে দোষ কাটানো
কুসংস্কার ছাড়া কিছু নয়।
এখনও বহু গর্ভবতী মায়েদের গ্রহণ দেখতে বা গ্রহণের সময় বাইরে যেতে বারণ করা হয় কারণ গর্ভস্থ সন্তানের নাকি অমঙ্গল হবে। এ ধারণাও যুক্তিহীন এবং ভুল। চোখে উপযুক্ত সৌর ফিল্টার লাগিয়ে তাঁরাও গ্রহণ দেখতে পারেন। গ্রহণের সময় নদীতে বা সমুদ্রে স্নান করলে অতিরিক্ত পূণ্য অর্জন হয়। এ ধারণাও কোনো বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই। অনেকে চোখ নষ্ট হবার ভয়ে সূর্যগ্রহণ দেখেন না। মাইলার ফিল্টার যুক্ত চশমা চেখে লাগিয়ে নির্ভয়ে গ্রহণ দেখা যায়। গ্রহণ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক ধারণারই প্রসার ও প্রচার হওয়া দরকার।
বিশালাকার এই আকাশের মধ্যে রয়েছে নানান কিছু, যত দেখবে, তত জানবে, ততই আনন্দ পাবে। যে আনন্দ লিখে বা মুখের ভাষায় বোঝানো যাবে না। তাই পরিশেষে বলি- আকাশকে দেখো, আকাশকে জানো, আকাশ দেখতে কোনো পয়সা লাগে না।
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬
Topic : A total solar eclipse
0 মন্তব্যসমূহ