Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

গরুর রচনা ।। সুনীল জানা



ইসস্! কি লজ্জার কথা! লজ্জায় যেন মাথা কাটা যাচ্ছে পাপানের। পরীক্ষার খাতা থেকে সে মাথা তুলতেই পারছে না।

বারে, পাপানের লজ্জা করবে না! এমন নামকরা স্কুল কত বড়ো তার বাড়ি, কত কত গাড়ি, ড্রাইভার, দারোয়ান আর কি ভালো সব দিদিমণিরা। বন্ধুদের কাছে তার ইস্কুল নিয়ে কত গল্প করেন পাপান। আর সেই ইস্কুলে কিনা এই কাণ্ড!

পরীক্ষার বেলায় লিখতে দিয়েছে গরুর রচনা!

কেন, হাতি-ঘোড়া-বাঘ-সিংহ এসব ছিল না? এরা কি দোষ করল? সব ছেড়ে শেষকালে কিনা সেই গরু! ছি-ছি, বাড়িতে এখন পাপান মুখ দেখাবে কি করে!

এখন মা যদি বলেন, কিরে পাপান, নিজের সম্বন্ধে কেমন রচনা  লিখলি?

কাকু যদি বলেন, গত জন্মের কথা সব মনে পড়ল তোর?

দিদিটা তো সঙ্গে সঙ্গে  ফোড়ন কাটবেই, এ জন্মেও কোনো উন্নতি হল না দেখছি!

না, পাপান আর ভাবতে  পারছে না। ভাবতে গেলেই মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে তার। ক্লাস টু-তে পড়ে বলে সে কিছু বোঝেনা নাকি? আসলে দিদিমণিদের ফন্দি এসব। এই দেখো না, রুমা দিদিমণি হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কেমন! মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছেন, কেমন জব্দ এবার!

রাগ করে পাপান আর দিদিমনির দিকে তাকালই না। খাতার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করছে না। ক্লাসের মধ্যেই এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে তার বন্ধুদের দেখতে লাগল। ধুস্, সব বন্ধু না কাঁচকলা! যত্ত সব হাঁদারামের দল। দিব্বি কেমন ঘাড় গুঁজে লিখে যাচ্ছে দ্যাখো না। গরুর রচনা না দিয়ে গাধার রচনা দিলেও ওরা বোধহয় আপত্তি করত না। কোনো লাজ-লজ্জাও নেই ওদের। পাপান সাতদিন কথা বলবে না ওদের সঙ্গে।

দিদিমণি ঘুরতে ঘুরতে পাপানের কাছে এলেন। খুব মিষ্টি করে জিজ্ঞেস করলেন, কি হল এদিক ওদিক তাকাচ্ছ কেন? প্রশ্ন বুঝতে পারছ না?

খুব বুঝেছে! ভালোই বুঝেছে পাপান! অত মিষ্টি কথার মানে বুঝতে তার আর বাকি নেই। গরুর রচনা লিখতে দিয়ে মন ভোলানো হচ্ছে আবার!

পাপান রাগ করে কোনো উত্তর দিল না। খাতার দিকে মুখ নামিয়ে নিল। দিদিমণির সঙ্গে এক মাস কথা বলবে না সে। পাক্কা একটা মাস।

কিন্তু রাগ করলে কি হবে, লিখতেই তো হবে গরুর রচনা। না লিখলে নির্ঘাৎ বাংলায় ফেল! তখন আবার বাড়িতে এক যাচ্ছে তাই ব্যাপার! মেজাজ খারাপ করে পাপান একবার কলমটা তুলল, একবার নামাল, তারপর কলমটা কামড়ে আকাশ-পাতাল ভাবতে লাগল। কি লিখবে সে? পরীক্ষার হলে বসেই গরুর কথা ভাবতে ইচ্ছে করে কখনো!

ঠিক আছে! কিছু ভাববে না পাপান। যা মনে আসে, তাই লিখে যাবে। মানুষ হয়ে গরুর কথা ভাবতে তার বয়েই গেছে।

যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। পাপান অমনি কলম তুলে গড়গড় করে লিখতে লাগল, গরুর চারটে পা আছে। একটা লেজ আছে। দুটো চোখ, দুটো কান-

লিখতে লিখতে হঠাৎ থমকে গেল পাপান। আরে! এগুলো তো হাতি, ঘোড়া, কুকুর, বেড়ালেরও আছে। তাই বলে তারা গরু হয়ে যাবে নাকি! নাঃ এভাবে লেখাটা ঠিক হচ্ছে না। ঘ্যাঁচ-ঘ্যাঁচ করে লেখাগুলো সব কেটে দিল পাপান। কি করে, কি লেখা যায়, ভাবতে লাগল।

কি লিখবে? গরুর শিং আছে? শিং তো মোষেরও আছে, ছাগল-ভেড়াও আছে আরও কার কার আছে যেন!

তবে? গরু লেজ দিয়ে মাছি তাড়ায়!

যাঃ! লেজ দিয়ে মাছি তাড়াবে না তো কি কলম ধরে পরীক্ষা দেবে? এটা লেখার কোনো মানেই হয় না।

একবার মনে হল, গরু ঘাস খায়। কিন্তু ঘাস তো গাধাও খায়, ঘোড়াও খায়। পাপান তো আর খায় না। সে বোকার মতো এসব লিখতে যাবে কেন?

ভাবতে ভাবতে পাপানের মাথা গরম হয়ে উঠল। ঘামে ভিজে যেতে লাগল। উঃ, আচ্ছা গরুর পাল্লায় পড়েছে বটে! পাপানের ইচ্ছে করছিল, গরু অতি যাচ্ছে-তাই প্রাণী। পরীক্ষা না হলে সে ঠিক লিখে দিত কিন্তু। সত্যি কথা বলতে ভয় পায় না।

অনেক ভেবে পাপান এবার লিখতে শুরু করল, গরু খুব উপকারী প্রাণী। তারা আমাদের দুধ দেয়। সেই দুধ থেকে দই হয়, ছানা হয়, পায়েস হয়, রসগোল্লা, রাজভোগ, সন্দেশ, রাবড়ি- কত কী হয়। ইস্, লিখতে লিখতে আরো কত যে ভালো ভালো খাবারের নাম মনে পড়ে যাচ্ছিল পাপানের! কিন্তু মোটেই সে অত লোভী পেটুক না। ইচ্ছে করেই সে ওগুলো আর লিখল না। পড়ে দিদিমণি ভাববে কি তাহলে!

তারপর পাপান লিখল, গরুর দুধ থেকে ঘি হয়, মাখন হয়। সে সব খেলে গায়ের জোর হয়। শরীর ভালো থাকে। বুদ্ধি বাড়ে-

এই অব্দি লিখেই পাপানেরও বোধহয় বুদ্ধি বাড়ল। আরে- এ তো দুধের রচনা হয়ে যাচ্ছে। গরুর রচনা হচ্ছে না তো! ব্যাস, আবার সে ঘ্যাঁচ করে কেটে দিল লেখাটা। পারলে গোটা খাতাটাই ফ্যাঁস করে ছিঁড়ে ফেলত! কিন্তু পরীক্ষা যে!

আবার কলম কামড়ে ভাবতে লাগল পাপান।

একবার সে ভাবল, গরুর বুদ্ধি নেই। অমনি মনে পড়ে গেল, গাধারও বুদ্ধি নেই। তাদের ভূতো চাকরটার বুদ্ধি নেই। এমনকি শিবু মন্টুরও কোনো বুদ্ধি নেই। শিবু মন্টু আবার তাদের ক্লাসেই পড়ে কিনা। পড়া পারে না বলে রোজ দিদিমনির বকুনি খায়। যাক্ গে, গরুর রচনা লিখতে গিয়ে সে আবার শিবু মন্টুর রচনা হয়ে যাবে শেষকালে!

ধুত্তোর! গরুগুলো আচ্ছা গোলমেলে জানোযার তো! দিকে দেখতে কেমন নিরীহ গোবেচারা একেবারে। রাগে দাঁতে দাঁত ঘষতে লাগল পাপান। কিছুতেই সে বাগে আনতে পারছে না রচনাটা!

এখন কি করে পাপান! তুচ্ছ গরুর কাছে হেরে যাবে? কক্ষনো না!

পাপানের মাথায় হঠাৎ একটা দারুণ বুদ্ধি খেলে গেল। গরুর রচনা কথায় লিখে আর কাজ নেই। তার চেয়ে সোজাসোজি এঁকে দেওয়াই ভালো। তাহলে দিদিমনির আর বুঝতে অসুবিধে হবে না।

ব্যাস, অমনি কলম বাগিয়ে গরু আঁকতে লেগে গেল পাপান। গুনে গুনে গরুর চারটে পা আঁকল, দুটো চোখ আঁকল, দুটো কান আঁকল, একটা লেজ আঁকল। লেজটা একটু বেশিই লম্বা হয়ে গেল অবিশ্যি। তা হোক গে, ওতে মাছি তাড়াতে সুবিধে হবে। পেটটাও যেন একটু বেঢপ মোটা হয়ে গেল। বেশি ঘাস পাতা খেয়ে ফেললে অমন হয় একটু আধটু। কান দুটোও কেমন খাড়া খাড়া। ভালোই হয়েছে আলাদা করে আর শিং¬ আঁকতে হল না। একটা পা বোধয় একটু ছোটো হয়ে গিয়েছে। দূর থেকে বুঝলে কিন্তু কিছু বোঝা যাবে না। গরুটা এঁকে এদিক ওদিক থেকে কয়েকবার ভালো করে দেখল পাপান। দিব্যি গরুর মতো দেখাচ্ছে। আবার কি!

না, আর একটু বাকি আছে। গরু ঘাস খায়, পাপান গরুর মুখের কাছে কিছু ঘাস আঁকল। সেগুলো ঘাসও হতে পারে, খড়ও হতে পারে। যে যেমন মনে করে আর কী! গরু দুধ দেয়, তাই সে গরুর পাশে এক বালতি দুধ আঁকল। এঁকে তার গায়ে লিখে দিল, খাঁটি গরুর দুধ। ব্যাস্- আর কারও ভুল হবে না। তারপর বালতির পাশে সার দিয়ে চৌকো-চৌকো গোল্লা-গোল্লা সন্দেশ রসগোল্লা আঁকতে লাগল, দেখে মনে হবে যেন, একবারে ময়রার দোকান বসে গেছে সেখানে।

বাব্বা বাঁচা গেল! গরুর রচনা শেষ। পাপান এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ক্লাসের চারদিকে চোখ ঘোরাতে লাগল। সবাই কেমন ঘাড় গুঁজে লিখে যাচ্ছে। বেশ তো লিখুক। দেখা যাক, কে কত নম্বর পায়। মাথা খাটিয়ে এমন বুদ্ধি আর কাউকে বার করতে হচ্ছে না।

এমন সময় হল কি-

হঠাৎ পাপানের চোখ দুটো কুঁচকে উঠল। আরে, শিবুটার ব্যাপার কি? ওই তো জানলার ধারে বসেছে শিবু। বসে বসে করছে কি? একবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছে, একবার লিখছে। ব্যাপারটা একটু কেমন কেমন ঠেকছে যেন। পাপান অমনি চোখ বড়ো বড়ো করে শিবুর দিকে তাকিয়ে রইল।

বার বার জানলা দিয়ে কী দেখছে শিবু?

পাপানও জানলা দিয়ে সামনে উঁকি মারতে চেষ্টা করল। অনেকক্ষণ ধরে অনেক কায়দা কসরত করে, অনেকবার এদিক-ওদিক ঘাঁড় এঁকিয়ে বেঁকিয়ে শেষে পাপান দেখল কী- ও হরি, একটা আস্ত গরু কিনা দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার মোড়ে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শিবুর দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন লেজ নাড়ছে। শিবুর চেনা গরু নিশ্চয়ই। আর তাকে দেখে দেখে দিব্যি রচনা লিখে যাচ্ছে শিবুটা।

মহা চোর তো শিবু! পাপান আর চুপ করে থাকতে পারল না। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, শিবু গরুর রচনা টুকলি করছে, দিদিমণি!


অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

  1. You can even refer friends 카지노 사이트 to the platform and luxuriate in a referral bonus. Slots.lv also offers free spins, slots rewards, and day by day bonuses. Generally, most online playing sites are safe to use - lengthy as|so lengthy as} they're licensed, of course.

    উত্তরমুছুন