Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

বাংলা কবিতা তাঁরই হাত ধরে নতুন পথের ঠিকানা পেয়েছে ।।পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়



কতই বা বয়স! নিতান্তই কিশোর। অতি সাদামাটা চেহারা, পোশাক-আশাক।  দোহারা গড়ন, শ্যামবর্ণ। মাথায় এক রাশ ঘন চুল, পরিপাটি করে যত্নে আঁচড়ানো। পোশাক বলতে ধুতি-শার্ট, শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গোটানো। ধুতির কোঁচা ধরা থাকত বাঁ হাতে, কখনও বা পড়তেন মালকোঁচা দিয়ে। না- চেহারায়, না- পোশাকে কোথাও একটু বাড়তি চাকচিক্য ছিল না। ভারি উজ্জ্বল ছিল শুধু চোখ দুটি।

ওই বয়সে আর দশজন খেলাধুলোয় মজে থাকতেই ভালোবাসে। তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকেই মেলানো যায় না। একেবারে অন্যরকম ব্যতিক্রমী। কিশোর বয়সেই দেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট ঘোচানোর জন্য জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। কীভাবে মানুষের কল্যাণ হয়, কেন এ দুঃখ লাঞ্ছনা, আড়ালে রয়েছে কাদের কারসাজি- এসব ভাবতে গিয়ে অনেক নির্মম সত্যই তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

দিনে-দিনে তাঁর কাজ বাড়ে। শুধু ভাবলেই তো চলে না। মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে আলোয় পথ খুঁজে নিতে হয়। এসব সামলাতে গিয়ে পড়াশোনার ক্ষতি হয়। প্রায়ই জোটে বাবার বকুনি। বাবাকে তাঁর ভারি ভয়। রাগে-ক্ষোভে কখন যে ফেটে পড়েন, কে জানে! অবশ্য স্নেহও করেন যথেষ্ট। মা-মরা ছেলে এই হয়তো খুব বকলেন, একটু পরেই আবার পরম স্নেহে ভরিয়ে দিলেন তাঁর মন।

সব কাজ সেরে ফিরতে অনেক রাত হয়। রাঁধুনির ঢেকে রাখা খাবার জুড়িয়ে যায়। বাবাও ঘুমিয়ে পড়েন। রাত-দুপুরে বাবাকে ডেকে যে ঘরে ঢুকবেন, তেমন সাহস নেই। ফলে আঁটতে হয় অন্য ফন্দি। বন্ধ সদর দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা না করে অন্য উপায়ে ঢুকতে হয় বাড়িতে। দোতলার জানালার একটা গড়াদ ছিল আলগা। সেই ফাঁক দিয়ে কোনোরকমে শরীরটাকে ঢুকিয়ে দিতেন ভেতরে। এইভাবে চলছিল দিন। হঠাৎ যে এমন অঘটন ঘটে যাবে তা আর কে জানত! এই গোপন প্রবেশ পথের সামনে শুয়েছিল সদ্য দেশ থেকে আসা তাঁরই এক দূর সম্পর্কের দাদা। বেশ আয়েশ করে ঘুমোচ্ছিল। দাদার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে দেখল, এ কী! জানলা দিয়ে কে যেন ভেতরে ঢুকছে। আর দেরি নয়, তখনই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জাপ্টে ধরল তাঁকে। তাগড়াই চেহারার সেই দাদাটির বাহুবন্ধনে বন্দি হয়ে তাঁর তো হাঁসফাঁস অবস্থা! যত বলেন, ''ছেড়ে  দাও, ছেড়ে দাও'', দাদাটি- ''চোর ধরেছি, চোর'' বলে ততই চিৎকার করে চলে। বাড়ির সকলের ঘুম ভেঙে যায়। লাঠি-সোটা, আলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সবাই। সেই আলোয় চোরের কাঁচুমাচু মুখটি দেখে বিস্মযের আর শেষ থাকে না- কোথায় চোর! এ যে আমাদের সুকান্ত!

এত ব্যস্ততা, এত কাজ- এরই মাঝে একটু ফুরসত পেলেই সুকান্ত খাতা-কলম নিয়ে বসে পড়তেন। কবিতা লিখতেন। তাঁর কবিতাতেও সেই মানুষের লড়াই আর সংগ্রামের ছবি। জীবনের জয়ধ্বনি। ওই অল্প বয়সেই সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। বাংলা কবিতা তাঁরই হাত ধরে চেনা পথ ছেড়ে নতুন পথের ঠিকানা পেয়েছে।

সুকান্তর জন্ম ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই আগস্ট। জন্ম হয় মাতামহ সতীশচন্দ্র ভট্টাচার্যের কালীঘাটের বাড়িতে।

মণীন্দ্রলাল বসুর ছিলেন একজন নামী লেখক। 'সুকান্ত' নামে একটি গল্প লিখেছিলেন তিনি। সেই গল্পের নায়কের নামেই সুকান্ত-র নাম দিয়েছিলেন জ্যাঠতুতো বোন রানীদি।

সুকান্তর বাবা নিবারণচন্দ্র, সুনীতি দেবী। শৈশবে মাকে হারিয়ে রানীদির কোলে-কাঁখে বেড়ে ওঠেন তিনি। দিদি খুব ভালোবাসতেন, ভালোবাসতেন তাঁর বৌদি সরয়ুদেবীও। তবু মায়ের অভাব তাঁকে বড়ো কষ্ট দিত। কৈশোরের বন্ধু অরুণাচলের মা সরলাদেবীর মধ্যে সুকান্ত বুঝি খুঁজে পেয়েছিলেন হারানো মাকে। সরলাদেবীও নিজের ছেলের মতো সুকান্তকে ভালোবাসতেন। কখনো তাঁর জন্য বানিয়ে রাখতেন তালের বড়া কখনো বা নারকেল নাড়ু।

কবিতা লিখে কিশোর বয়সেই সকলের নজর কেড়েছিলেন সুকান্ত। কবিতা ছাড়াও লিখেছিলেন কয়েকটি গল্প, কিছু গান ও ছড়া। পড়ে সকলেই অবাক হয়। বলে এতটুকুন ছেলে এমন লেখা লিখল কেমন করে!

সুকান্তর ব্যস্ততার শেষ ছিল না। জনযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পত্রিকার ছোটোদের বিভাগ সম্পাদনা, রাজনীতি, নানা জনহিতকর কাজ, কবিতা লেখা- দিনভর তাঁর কত ব্যস্ততা। এত পরিশ্রম শরীর সইবে কেন! অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। ধরে কালব্যাধি।

হাসপাতালে ভর্তি করা হল। চলল চিকিৎসা। কিন্তু সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। মাত্র ২১ বছর বয়সে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ই মে মারা যান কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য।

 

প্রকাশিতচিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ