![]() |
বাবার হাতে বই, চশমার ফাঁক দিয়ে দেখছেন গুলটেকে, বললেন, বল জ-এ জাহাজ।
গুলটে চুপ। স্বরবর্ণ শিখে গিয়েছে সে, এখন শিখছে ব্যঞ্জনবর্ণ। কিন্তু আজ পড়তে একেবারেই ইচ্ছে করছে না তার। কারণ, আজ দিদি আসবে, জামাইবাবু আসবে। দিদির মাস ছয় হল বিয়ে হয়েছে, এর মধ্যে বার দুই ঘুরে গিয়েছে জামাইবাবুকে নিয়ে, এটা থার্ড টাইম।
জামাইবাবু শহরের ছেলে, গ্রাম দেখতে ভারী ভালোবাসে। এসেই গুলটেকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে, ধানখেত, পাটখেত, আলুখেতের মাঝে আলে আলে ঘুরে বেড়ায় আর থেকে থেকে বলে, বাহ্, কী সুন্দর খেত! মাথার ওপর কী বিরাট আকাশ! কি লাভলি হাওয়া রে গুলটে, প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে! গ্রামে না এলে, গ্রামের মেয়েকে বিয়ে না করলে এসব দেখতে পেতাম?
শুনে গুলটের গর্বে ও আনন্দে বুক ফুলে ওঠে। জামাইবাবু এলে সে তখন জামাইবাবুর লোকাল গার্জেন, তাই তাকে তখন বাবা পড়তে বলেন না, দুষ্টুমি করলে শাসন করেন না, ফলে ডবল মজা তার, পুরোপুরি স্বাধীন সে তখন।
-কি হল গুলটে, বলো জ-এ জাহাজ! বাবা আবারও গলা ছাড়লেন।
পড়ায় এবারও সাড়া দিল না গুলটে। খুরখুর করে দু-বার মাথা চুলকে নিল, শিরদাঁড়াটা ঝপ করে মস্ত করে সঙ্গে সঙ্গে কোমর ভেঙে দিল- এসব হল সিগনাল গুলটের- পড়তে ভালো লাগছে না।
কিন্তু লাভ হল না, বাবা এবার চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন, কি হল, পড়তে বলছি না? বলো জ-এ জাহাজ।
বাবা তাকে জাহাজে তুলেই ছাড়বেন! রেগেমেগে বলে দিল, জ-এ জাম্বাবু।
-অ্যাঁ, কী বললি? বাবা হুমকে উঠলেন।
-জাম্বাবু। গুলটে ঘাড় নেড়ে মুখ বেজার করে বলল, এক্ষুনি দিদি-জাম্বাবু আসবে, আমার পড়তে ভালো লাগছে না বাবা।
-সে জামাইবাবু যখন আসবে দেখা যাবে, এখন পড়। বাবা এককথায় গুলটের যুক্তি উড়িয়ে দিয়ে হুংকার ছাড়লেন, পড়।
বাপরে, কি গলা! গুলটে আর রিস্ক নিল না, সঙ্গে সঙ্গে ভালো ছেলে হয়ে গেল। গুটি গুটি করে জাহাজে উঠে পড়ল। চিৎকার করে বলল, জ-এ জাহাজ।
আরে আস্তে আস্তে! বাবা কানে হাত দিলেন। এত জোরে চেঁচাচ্ছিস কেন? দেখবি মজা?
ওরে বাবা! মুহূর্তে গুলটে একেবারে ভিজে বেড়াল। মুখ গুঁজে চুপচাপ পড়তে শুরু করল। তারপর পড়েই চলেছে, পড়েই চলেছে। কিন্তু কান তার পড়ে আছে দরজায়। খালি খালি মনে হচ্ছে, সদর দরজায় কেউ ধাক্কা দিল? কেউ এল নাকি? দিদি-জামাইবাবু?
এই করতে করতে বাংলার ব্যঞ্জন বর্ণের স্টক শেষ, বাবা তবু ছাড়লেন না গুলটেকে। এবার ধরলেন ইংরেজি। ইংরেজির এ বি সি ডি আগেই শেষ, আজ বাবা নাম্বার ধরলেন। বই খুলে ওয়ান বের করে স্লেট দেখিয়ে বললেন, লেখ ওয়ান।
জামাইবাবু আসার দিনে লিখতেও হবে? এবার কান্না পেল গুলটের, যা হয় হোক আজ সে লিখবেন না, কিছুতেই না। ঘাড় শক্ত করে বসে রইল।
-কথা কানে যাচ্ছে না? লেখ!
গুলটে বেজার মুখে জোরে জোরে ঘাড় নাড়ল, না!
-লিখবি না? বাবা গর্জন ছাড়লেন, খুব সাহস বেড়েছে না তোর?
অ্যাই রে বাবা হাত-ফাত চালিয়ে দেবেন না তো! গুলটে চমকে হাত দিয়ে মুখ আড়াল করে 'লিখছি লিখছি' করে উঠল। বাবা চক পেন্সিল বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, লেখ ওয়ান।
গুলটের হঠাৎ চোখ চলে গেল দেওয়ালে ঝোলানো ইংরেজি ক্যালেন্ডারের দিকে। বলল, ওই তো লেখা আছে।
-ফুক্কুড়ি হচ্ছে আমার সঙ্গে? দ্যাখ!
বাবা এবার সাংঘাতিক রেগে গেলেন। মাদুরে রাখা বেতটা তুলে নিলেন হাতে। চোখ বুজে ফেলল গুলটে, এই পড়ল, এই পড়ল, ভেবে থিরথির করে কাঁপছিল চোখের পাতা।
কিন্তু না আজ ভাগ্য ভালো গুলটের। ঠিক তখনই সদর দরজায় কড়াটা জোরে জোরে বেজে উঠল। বাবা বেতটা ফেলে উঠে পড়লেন। কটমট করে চোখ পাকিয়ে বললেন, দাঁড়া আসছি।
ঘাম দিয়ে যেন জ্বর ছাড়ল গুলটের। বুকটা এতক্ষণ ভয়ে ধুকপুক করছিল। এবার আনন্দে ধড়াস ধড়াস করতে আরম্ভ করল। এ আর দেখতে হবে না, নির্ঘাত দিদি জামাইবাবু। আর চিন্তা নেই, পড়াশোনা এখন ডকে। জামাইবাবুর সঙ্গে হইহই করে ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটবে। বাবাও কিছু বলতে পারবেন না তাকে। মাও না। কী আনন্দ!
কিন্তু আজ ভাগ্যটা একইসঙ্গে ভালো আবার খারাপও গুলটের। বাবা দরজা খুলতেই লাল মাড়ি বের করে এক গাল হেসে বাড়িতে ঢুকে এল তাদের মুনিস ঝোড়োদা। হাতে ডাবের কাঁদি। জামাইবাবুর জন্য গাছ থেকে পেড়ে এনেছে এই।
জামাইবাবু নয়, ঝোড়োদা! সমস্ত উৎসাহ আর আনন্দ দপ করে নিভে গেল গুলটের। বাবা ঝোড়োদার সঙ্গে একটু বকবক করে আবার উঠে এলেন দাওয়ায়। ভবি ভোলার নয়, ওয়ান না লিখিয়ে তিনি ছাড়বেন না গুলটেকে। কোনো মানে হয়?
মোটেই না। গুলটের এবার রাগ হয়ে গেল। অভিমানে বুক ফুলে ফুলে উঠল। বাবা এসে
পড়লেন, গুলটের স্লেটের
দিকে ডেঁটে উঠলেন- এখনও লিখিসনি? কি তেড়েটে ছেলে
রে বাবা! পড়াশুনার নাম নেই, খালি ফাঁকিবাজি!
আমি একা ফাঁকিবাজ? দিদি ফাঁকিবাজ নয়? জামাইবাবু ফাঁকিবাজি নয়? বলেছিল সকাল সকাল চলে আসবে, কোথায় সকাল সকাল? বাইরে রোদ্দুর চড়চড় করছে। পড়তে পড়তে জীবন শেষ।
-আরে কথা না বলে কেন বদমাশ ছেলে! বাবা বেতটা তুলে নিলেন হাতে, দেব পিঠে? ফাঁকিবাজি ছুটিয়ে দেব।
না, অনেক সহ্য করেছে, আর নয়। এবার গুলটে বিদ্রোহ করল, আচমকা বাবার হাত থেকে বেতটা কেড়ে নিয়ে বলল, মারবে না মারবে না বলছি! আমি একা ফাঁকিবাজ? পড়াতে পড়াতে তুমি চলে গেলে কেন? ঠিক করে পড়াতে পারো না, বারবার উঠে যাও, খালি ফাঁকি, খালি ফাঁকি না?
বলতে বলতে বেত ছুঁড়ে ফেলে গুলটে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলল। বাবার হাত থেকে বেত কেড়ে নিয়েছে, বাবারে!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২০
Topic : Children's Best funny
story in bengali, হাসি মজার গল্প
0 মন্তব্যসমূহ