![]() |
আজকে তোমাদের যে গল্প বলব সেটা আমার নিজের গল্প নয়। আমি তোমাদেরকে গল্পটা জানাচ্ছি এটুকুই আমার কাজ। গল্পটা আসলে হাসান চাচার। তোমরা কি হাসান চাচাকে চেনো? চিনবেই বা কি করে? আমি বলব তারপরে তো চিনবে।
তাহলে বলি শোনো, হাসান চাচার বাড়ি নদীয়া জেলার কালীনারায়ণপুর গ্রামে। সুন্দর সেই গ্রামের বুক চিরে বয়ে গেছে চূর্ণী নদী। চূর্ণী নদীর পাশে একটা বিশাল বড়ো বটগাছ দেখতে পাবে। সেই গাছের পিছনেই হাসান চাচার বাড়ি। অবশ্য, বাড়ি বলছি কিন্তু সেটা ঠিক বাড়ি নয়। তার না আছে ছাদ, না আছে দেওয়াল। কয়েকটা কাঁচা বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে দর্মার বেড়া, তার উপরে ত্রিপলের ছাউনি। এই নিয়েই হাসান চাচার সংসার। কত ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এই বাড়িতেই চাচা জীবন কাটিয়ে দিলেন তার ঠিক নেই। আমাদের বাড়ি হাইস্কুলের কাছে। চাচা আমাদের বাড়িতে চালের বস্তা, মাসকাবারি সদাই পৌছে দেন। সেই থেকেই আলাপ। আমি আর আমার কাকাতো ভাই বেশ কয়েকবার গেছি চাচার বাড়ি। চাচার ঘরের সঙ্গে লাগানো একটা কুল গাছ আছে। কুল একটু বড়ো হলেই কাকা আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন। আবার কোনোদিন কুলের লোভে আমরাই পৌঁছে যেতাম চাচার বাড়িতে। চাচা আমাদের খুব খাতির করতেন। ওনার বাড়িতে আসবাব বলতে একটা মাত্র ভাঙা খাটিয়া। তার উপর বসে টোপ খাওয়া অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে লঙ্কা লবণ মাখিয়ে কুল খেতাম আমরা। সে সব কথা মনে পড়লে এখনও জিভে জল চলে আসে।
তাই, থাক সে কথা। যে কথা বলতে আজ এসেছি সেটা বলেনি। চাচার বাড়িতে আমরা আরও একটা কারণে যেতাম- গল্প শুনতে। কতরকমের গল্প যে চাচার ভাণ্ডারে ছিল তোমরা ভাবতেও পারবে না। আজ যদি সেসব লিখতে বসি তাহলে একটা আস্ত বই লেখা হয়ে যাবে। তবে আমারা চাচার জীবনের ঘটনাগুলো শোনার জন্য উৎসুক হয়ে থাকতাম। চাচার গল্পগুলো কতটা সত্যি আর কতটা রং মেশানো জানি না, তবে শুনতে বেজায় ভালো লাগতো। এমনই একটা ঘটনা তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করছি, ভালো লাগলে তোমরা সকলের সঙ্গে শেয়ার করো কিন্তু।
এই ঘটনা ঘটে যখন তখন চাচার বয়স ৪০ কি ৪৫। আজ থেকে বছর ২০ আগে। চাচী তখনও বেঁচে ছিলেন। চাচা তখন প্যাডেল ভ্যানে মাটি টানার কাজ করতেন। এছাড়াও কাঠ পাথর বালি এইসব টেনে নিয়ে বেড়াতেন। কাজের তেমন অভাব ছিল না। আয়ও হতো ভালো। দু'চার পয়সা জমিয়ে রেল কলোনির জমিতে একটা টিনের ঘর বানিয়ে ছিলেন। রেল কলোনির ঘর মানে রেলের জমিতে অস্থায়ী ভাবে থাকা। তাই স্টেশন মাস্টারের কথা মেনে চলতে হতো সবসময়। বাজার থেকে কিছু কিনে আনা হোক বা রাত-বিরাতে কোনো যাত্রীকে দূর গ্রামে পৌঁছে দিয়ে আসা হোক, ডাক পড়তো হাসান চাচার ভ্যানের। হাসিমুখে সব কাজই করে দিতেন চাচা। কোনোদিন না করতেন না।
কিন্ত চাচার একটা বদ স্বভাব ছিল। একটু বেশি পয়সা আয় হলেই নেশা করতেন। নেশায় বুঁদ হয়ে বাড়ি এসে কোনোরকম কিছু খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। চাচীর সঙ্গে কোনোদিন খারাপ ব্যাবহার করতেন না ঠিকই কিন্ত চাচীর সঙ্গে কথাও তেমন বলতেন না। সকাল হলেই আবার পান্তা খেয়ে কাজে বেরিয়ে যেতেন। চাচীর মনে ছিল অনেক কস্ট, সেসব শোনার সময় ছিল না চাচার। বিয়ের বিশ বছর পরেও ছেলে মেয়ে হয়নি চাচীর। সেই কস্টের সঙ্গে জুড়ে বসেছিল হাজার রকম রোগ।
বাতের বেথা, হাঁপানি তো চোখে দেখা যায়, আর কি কি রোগ ভিতরে লুকিয়ে আছে তা জানা ছিল না চাচীর। শরীর মন কোথাও শান্তি ছিল না। তার উপরে গত তিন দিন ধরে গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছিল। চাচা একবারও খবর নেননি। রাত্রে নেশা করে এসে ঘুম দিতেন, সকালে উঠে কোনোরকমে খেয়ে কাজে বেরিয়ে যেতেন। চাচীর খোঁজ করার সময় ছিল না। কিন্তু সেদিন রাত্রে এমন হয়নি। নেশা করে বাড়ি ফিরে কোনোরকমে খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়েছেন চাচা, স্টেশন মাস্টার খোঁজ পাঠালেন রেললাইনে একজন কাটা পড়েছে। তার লাশ তুলে রানাঘাটে পৌঁছে দিয়ে আসতে হবে। খবর শুনে হাসান চাচার মনটা ভারি হয়ে উঠেছিল। ভয় তিনি পাননি, কিন্ত কস্ট লেগেছিল মনে। না জানি- কার বাড়ির লোক।
খবর পাওয়ার মিনিট ৫ পর, রাত তখন একটা হবে, চাচা কোমরে গামছা বেঁধে নিলেন। ডিসেম্বর মাস এমনিতেই শীত, তার উপরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিও হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে, তাই চাচী ভালো চাদরটা বের করে দিলেন আর দিলেন একটা পুরানো বিছানার চাদর। লাশটাকে চাদরে জড়িয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে ভ্যানে তুলতে কাজে লাগবে। গায়ে চাদর জড়িয়ে চাচা বেরিয়ে পড়লেন লাশ টানতে।
রাস্তায় বেরিয়ে বুঝতে পারলেন গতকাল অমাবস্যা গেছে, আকাশে চাঁদের সরু রেখাটুকুও দেখা যাচ্ছে না, তাই রাস্তায় একটুও আলো নেই। এই অবস্থায় লাশ খোঁজা বেশ কঠিন। তাই টর্চ নেবেন বলে পিছন ফিরতেই দেখেন চাচী ৪ ব্যাটারীর টর্চটা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। টর্চ নিয়ে ভ্যান টেনে স্টেশনের কাছাকাছি আসতে সময় লাগল ৫ মিনিট। টর্চের আলোয় দূর থেকে দেখতে পেলেন একটা দেহ লাইনের ধারে পড়ে আছে।
এযে মহিলার দেহ এটুকু বোঝা যাচ্ছে। যেখানে দেহটা পড়ে আছে সেখানে স্টেশনের আলো এসে পৌছায় না। তাই কাটা মাথাটা ঠিক কোথায় পড়েছে বোঝা যাচ্ছিল না। লাশটা পড়ে আছে ঠিক যেখানে শান্তিপুর আর কৃষ্ণনগর যাওয়ার লাইন দুটো আলাদা হয়ে যায় সেই জায়গায়। লাইন দুটোর মাঝে অনেকটা খাঁই। কাটা মাথাটা যদি খাইয়ের ভিতরে পড়ে তাহলে খোঁজা মুশকিল। সাপ খোপ, শেয়াল সবই আছে ওই খাইয়ে। কিন্ত মাথা ছাড়া লাশ নিয়ে যাওয়াও তো যাবে না। কার লাশ সেটা বুঝতেও তো মাথাটা দরকার। তাই বডির দিকে না গিয়ে লাইন টপকে খাইয়ের দিকে চাচা পা বাড়ালেন।
কাটা মাথা রেলের চাকার ঘসায় একটু সামনের দিকে এগিয়ে আসতে পারে, তাই লাইনের পাশ দিয়ে খাড়া ঢাল বেয়ে খাইয়ের মধ্যে নেমে পড়লেন চাচা। চারিদিকে ঝোপ জঙ্গল, ঝিঁঝির ডাকে কানে তালা লাগার জোগাড়। এর মধ্যে টর্চের আলো এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে থমকে দাঁড়ালেন তিনি। একটা জংলি ঝোপের ডালে ঝুলে আছে এক গোছা চুল, আর সেই চুলের সঙ্গেই ঝুলছে কাটা মাথাটা। যদিও মুখটা উল্টো দিকে থাকায় চেনার উপায় নেই। তাই সাহসে ভর করে এগিয়ে গিয়ে গাছের ডাল থেকে চুলের গোড়া ধরে মাথাটা নামিয়ে এনে টর্চের আলো ফেলতেই ধড়াস করে উঠল চাচার বুকটা। অসম্ভব এক ভয় আঁকড়ে ধরল চাচাকে। মুখ থেকে বেরিয়ে এল গোঙানি। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে সারা শরীর অসাড় হয়ে গেল। পাথরের মতো স্থির হয়ে টর্চের আলোয় পরিস্কার তিনি দেখলেন কাটা মাথাটা চাচীর। ভয়ে শোকে চাচা জ্ঞান হারালেন।
জ্ঞান ফিরল পরের দিন রানাঘাট হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরে জানতে পারলেন কাল রাত্রে তার স্ত্রীই রেল লাইনে গলা দিয়েছে। চাচা অজ্ঞান থাকায় গ্রামের লোকেরা মিলেই চাচীকে মাটি চাপা দিয়ে এসেছে।
সেই দিন চাচা নিজের ভুল বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন নেশা করে তিনি কি হারিয়েছেন। কিন্ত আজও বুঝতে পারেননি সেই রাত্রে বাড়ি থেকে বেরানোর সময় কে তার হাতে চাদর আর টর্চ তুলে দিয়েছিল।
এরপর চাচা রেল কলোনি ছেড়ে এই বটতলায় থাকা শুরু করেন। আর কোনোদিনও নেশা করেননি। জীবন থাকতে আর করবেন না।
সেদিন এই ঘটনা শুনতে শুনতে সন্ধে হয়ে গেছিল। আমি আর ভাই দুজনে একা বাড়ি আসার সাহস পাচ্ছিলাম না। তাই চাচা তার ভ্যানে করে আমাদের পৌঁছে দিলেন। রাত্রে ভাত খেতে বসে মার কাছে সব গল্প বললাম।
মা হেসে বললেন- চাচী আবার কে? তোমাদের চাচা তো কোনোদিন বিয়েই করেননি।
অলংকরণ- তন্ময় দে
0 মন্তব্যসমূহ