![]() |
ঘরে ঢুকেই কাঁদন পরামানিক তার বউকে বলল, একটা খপর শুনেছো?
মন দিয়ে কড়ায় খুন্তি চালাচ্ছে বউ। খবর তো দুনিয়াময়। সেসব শুনলেও যা, না শুনলেও তাই। কিন্তু কাঁদন খবর শোনাবে তার আর বউ শুনবে না, তাও কি হয়!
গরম কড়াইতে একটু তেল ঢেলে দিয়ে কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে বলল, বল তোমার খপর।
কাঁদন বলল, রাজগঞ্জে একটা সেলুন হয়েছে। সেখানে মেয়ে নাপিত শাড়ির উপর কোট চাপিয়ে চুল কাটে।
বউ বলল, অ-মা, এ আর এমন কী! মেয়েরা মানুষ কাটা-ছেঁড়া করছে, আর এটা হল গিয়ে মানুষের চুল।
-আরি তা নয়-
-কি তাইলে?
-ওখানে চুল কাটতে করতে কত খরচ হয় জানো?
-তাতো একটু হবেই। পুরুষের কাজ মেয়েরা করতে খরচ বেশি হবেনি?
-তাই বলে পাঁচ ট্যাকার জায়গায় একেবারে বিশ ট্যাকা?
-তাতে কি হয়েছে?
চৌকাঠের উপর উবু হয়ে বসে ছিল কাঁদন। সিধে দাঁড়িয়ে বলল, আরি তাতেই তো সব।
কড়াইতে জল ফুটছে টগবগ করে। মৌরলা-পুঁটি ছোটাছুটি করছে হলুদ বাটা জলে। মাছের ঝোলে মন দেয় কাঁদনের বউ। ইকড়ি-মিকড়ি এসব না শুনলেও চলবে। সে তো ভালো মতই জানে কাঁদনের দৌড় শঙ্করী সেলুন থেকে সাঁকরাইল থানা পর্যন্ত।
কথা না বাড়িয়ে কাঁদন চলে যায় নিজের কাজে। যা করবে সেটা মনের ভেতর থেকে যায়।
রাজগঞ্জে আছে ঝকঝকে-তকতকে একটা সুপার মার্কেট। সেখানে দিনেরবেলা ইলেকট্রিকের আলো জ্বালিয়ে আনাজপাতি বিক্রি হয়। মাছওয়ালারা ঘড়ি হাতে পাল্লা ধরে। টেবিল ফ্যান চালায়। মাছ কিনলে পলিথিনের থলি দেয়। তা এখানে নতুন হয়েছে একটা বিউটিপার্লার। নাম-স্বপনপুরী।
বড়লোকের মেয়ে বউরা গাড়ি করে এসে চুল কেটে যায়। নিজের চোখে দেখেছে কাঁদন। দেখেছে আর মনে মনে ভেবে ফেলেছে মনোবাসনাটা।
বিকেলবেলা বউকে নিয়ে কাঁদন যাচ্ছে বিউটিপার্লারে। পনের টাকা খরচ করে বউয়ের
চুল অল্পস্বল্প একটু কাটাবে ঠিকই, কিন্তু আসল কারণ
অন্য। একটা বিউটিপার্লার করতে চায় কাঁদন। কলকাতা থেকে আর মেয়ে নাপিত আনতে হবে
না। বউয়ের হাতে চিরুনি-কাঁচি তুলে দিয়েই বাজিমাত করবে সে। অর্থাৎ লাভের সবটাই
চলে আসবে নিজের ঘরে। অনেক কষ্টে বউকে রাজি করিয়েছে তাই। কিন্তু মেয়ে নাপিত হতে
যাও বা রাজি হল বেচারী, নিজের চুল সে
কিছুতেই কাঁটবে না। বলে, ওকে গেরোস্তের
অমঙ্গল হয়।
কাঁদন বলেছে, বাজে কথা। যাদের দু-চাকা ছিল, তারা চার চাকায় ছুটছে। দোতলা বাড়ি হয়ে যাচ্ছে তিনতলা। হপ্তায়-হপ্তায় চুল ছাঁটে সেই সব বাড়ীর মেয়ে বউরা। অমঙ্গল টা কিসের?
-আমি চুল কাটবনি, ব্যাস?
বউয়ের সেই একই কথা। শেষমেষ কাঁদন বুঝিয়েছে, চুল কাটতে হবে না- একটুসখানি ডগা ছেঁটে দিতে বলব- আরি বাবা তোমার চুল কাটাতে আমার বয়ে গেছে। আমি যাচ্ছি তোমাকে নিয়ে একটু দেখাতে-বোঝাতে, এই আর কি!
এটাই আসল কারণ। দুজনে মিলে সব দেখবে, শুনবে। বেশিরভাগটাই আবিশ্যি কাঁদন দেখবে। এমনি এমনি তো আর ঢুকতে দেবে না- একটা অজুহাত থাকা চাই। বউযের চুল কাটাটা সেই অজুহাত। দরকার হলে আরো একদিন আরো বিশ টাকা নয খরচ করা যাবে। আর একটু ডগা ছেঁটে আনা যাবে। বিউটিপার্লার বলে কথা।
এইমাত্র 'স্বপনপুরী'র সামনে এল ওরা। পথ বড়ো একটা কম নয়। হাঁটতে আর চায় না বউ। নানান গল্পগাছায় ভুলিয়ে রাখতে হয়েছে। মান্ধাতার আমলের শঙ্করী সেলুন হবে এ যুগের বিউটিপার্লার! কষ্ট তো একটু করতেই হবে।
কাঁচের পাল্লায় কালো ধোঁয়া মাখানো। ভেতরে মানুষ দেখা যাচ্ছে না মোটেই। সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদন। পাশে বউ। সে তো ভয়ে গুটিসুটি মেরে গেছে। কাঁদন ফিসফিসিয়ে বলল, অমন করে থেকো না। ভরসা আনো-মনে ভরসা আনো।
আস্তে করে ঠেলা দিতেই দরজা দু-ভাগ হয়ে জোড়া লেগে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কাঁদন ঢুকে পড়েছিল। বউ বাইরে। ভেতর থেকে ফের ঠেলা মেরে বউকে ঢুকাতে হল। সুন্দর জায়গা। সুন্দর একটা গন্ধ। দেয়ালে তিনদিক জুরে আয়না। কাদন পারামানিক যেদিকে তাকায় সেদিকেই নিজেকে দেখে। একসঙ্গে এতগুলো কাঁদনকে এর আগে দেখেনি সে। চারিদিকে চোখ বোলাচ্ছে সে। কত রকমের জিনিস। আলমারিতে সারি সারি স্নো-পাউডার। ছোটো বড়ো শিশি। রকমারি সব যন্ত্রপাতি।
দুটো কাঁচি, কযেকটা চিরুনি, একটা ক্ষুর আর ফিটকিরি পাউডার সম্বল করে বছরের পর বছর জাতব্যবসা চালিয়ে গেছে কাঁদন, ওর বাবা এবং তারও বাবা। আর এ হল গিয়ে বিউটিপার্লার। অন্যরকম তো একটু হবেই। একটু নয়, সবটাই অন্যরকম। সেলুন বলে মনেই হচ্ছে না। সে যাই হোক। কিন্তু চেষ্টা করেও আসল জিনিসটা দেখতে পেল না কাঁদন। কিভাবে মেয়েদের চুলে কাঁচি চালায়, একটু দেখার দরকার ছিল। বিশ টাকা খরচ করবে তো সেই জন্যই। তা দেখতে যদি না-ই পেল তো কী আর হল!
ঘরের ভেতর আর একটা ঘর। ভেলভেট এর পর্দা ঝুলছে। পর্দার ওধারে মেয়ে নাপিত। উঠে দাঁড়ায় কাঁদন। পায়চারি করে। পর্দার সামনে দাঁড়ায়। কান পাতে নিদেনপক্ষে কাঁচির খচাং-খচাং শব্দ তো আসবে! তার বদলে শুনল, ''আমি বনফুল গো''। কে জানে, সুরের তালে কাছে চলে কিনা! ব্যাপার স্যাপারই তো আলাদা।
ভেতর একটা মেয়ে এসে কাঁদনের পাশেরজনকে ডাকল, আপনি আসুন। এরপর কাঁদনের পালা, মানে বউয়ের। বুক দুরুদুরু করে ওঠে তার। মনের
যা অবস্থা, ভয়ে বুঝি কেঁদে
ফেলে।
কানের পাশে ফিসফিস করে ওঠে কাঁদন, ভয় নেই- ভয় নেই।
বউ চুপ। মুখ বাঁকায় কেবল। তারপর বলে, কি করে করবে গো? কোত্থেকে পাবে এত সব জিনিস?
কাঁদন কিছু বলে না? মেলায় সাজগোজ করিয়ে বিউটিপার্লার করা তার কম্ম নয়? কত হাজার টাকা যে লাগবে তার ঠিক নেই। মাঝখান থেকে কুড়ি টাকা ফালতু চলে যাবে। 'আমি আসছি একটু', বলেই টুক করে কাঁদন বেরিয়ে গেল।
বউ তো জানে, কাঁদনের চালাকি আর আসবেই না। ঠায় বসে থাকতে থাকতে বউও উঠে পড়বে। তখন রাস্তার আশেপাশে নিশ্চয়ই ঘোরাঘুরি করবে কাঁদন। দেখা হয়ে যাবে ঠিক। এসব ভেবেই চলে গেল। ফিকির জানতে বাকি নেই।
ভাবতে ভাবতে বউ উঠতে যাবে অমনি একটা লোক এসে বলল, কি হল চলে যাচ্ছেন কেন? হয়ে গেছে- আসুন। পর্দার ভেতর থেকে একটা মেয়ের গলা পাওয়া গেল। হয়ে গেছে- হয়ে গেছে- চলে আসুন।
বেচারী বউটা পড়েছে সেই শাঁখের করাতে। না পারছে এদিক যেতে, না পারছে সে দিক।
কিভাবে পর্দা সরাল কাঁনের বউ। যা দেখলে চক্ষু চড়কগাছ একেবারে। এক পা-দু পা এগিয়ে দাঁড়াল। সত্যি এমন ঘর, ঢুকেও শান্তি। কুড়ি টাকা কি আর এমনি এমনি নেবে! চারপাশে মাথা ঘোরাল কাঁদনের বউটা।
-বসুন।
গোল চেয়ারটায় বসতেই একপাক ঘুরে গেল চোঁ করে। নিজের মনেই হেসে ফেলল সে। ঘাড়-মাথা এক হয়ে ডল পুতুলের মতো বসে আছে। আঁসলে পনের টাকা আছে। নিজের জমানো। সেই থেকেই নয় দিয়ে দেওয়া যাবে। পাঁচটা টাকা কি আর বাকি রাখবে না। এমন সুন্দর ঘর থেকে সত্যিই এমনি এমনি চলে যাওয়া যায় না!
-বলুন, কি হবে?
সুন্দর একটা চাদর জড়িয়ে দিল গায়ে? ফুরফুরে সেন্টের গন্ধ? কত সুন্দর সুন্দর মেয়ে বউরা আসে এখানে। তাদের গায়ে কি আর মার্কিন কাপড় জড়াবে! কাঁদনের বউয়ের বেশ ভালো লাগছে তাই। কেমন বড়োলোক বড়োলোক মনে হচ্ছে নিজেকে। সে বলল, আমি শুধু চুলের ডগাটা একটু কেটে নেব।
-ব্যাস?
-হ্যাঁ, আর কিছু নয়।
আয়নায় নিজেকে দেখছে বউ। সামনে-পেছনে। ডানদিকে-বামদিকে। এক জায়গায় বসে চারিদিকে নিজেকে দেখা যায়।
হঠাৎ মেয়ে নাপিতটা বলল, হয়ে গেছে।
উঠে দাঁড়াল বউ।
-কত দিতে হবে?
-কিছু না।
-সে কি! কিছু দিতে হবেনি? অবাক তাকাল সে?
-না থাক। কী আর দেবেন।
ঝটপট বেরিয়ে পড়ে সে। দুই হাত দিয়ে কাঁচের পাল্লা সরাবার সময় নিজেকে মনে
হচ্ছিল, ঠিক যেন রানী
ভিক্টোরিয়া।
ঘাপটি মেরে কোথায় বসেছিল কাঁদন। তিনলাফে একেবারে সামনা-সামনি।
-চলো, চলো তাড়াতাড়ি!
মুখ উঁচু করে বউ বলল, কেন? ভয় কিসের?
-দেখলেই যদি ডাকাডাকি করে?
-চুল তো কাটা হয়ে গেছে।
-তাই নাকি? টাকা?
-দিয়ে দিয়েছি। বাজার খরচের টাকাটা ছিল আমার কাছে। কালকেই দিয়ে দেবে কিন্তু।
কাঁদন চোখ পাকাল, কুড়ি টাকা!
-না,পাঁচ টাকা কম করেছে।
দুঃখিত মনে হাঁটতে থাকে কাঁদন পারামানিক। তিনটে মাথায় কাঁচি চালালে তবে পনের টাকা রোজগার। আর চুলের ডগ ছেঁটে দিয়ে বেমালুম অতগুলো টাকা নিয়ে নিল!
বউ ফের বললে, টাকাটা দিয়ে দেবে তো, কি গো? কাল কিন্তু বাজার হবেনি।
লম্বা শ্বাস ছাড়ে কাঁদন, হ্যাঁ দিতে তো হবেই। কাঁদনের বউ কিছু বলে না। বেশ খুশি খুশি ভাব। সিনেমা দেখার জন্য পাঁচটা টাকা চাইলেও দেয় না কাঁদন, আর বিউটিপার্লারের কৃপায় যদি পনের টাকা আসে মন্দ কি!
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২০
Topis : Laughter is a funny story, হাসি মজার গল্প
0 মন্তব্যসমূহ