![]() |
চিঠির প্রথমে আমাদের প্রণাম নেবে। আমার বাবা, পাশের বাড়ির কাকু, ময়নার বাবা-কাকারা তোমার নাম ধরে কথা বলে শুনেছি। কিন্তু আমরা তোমাকে দাদু বলেই ডাকলাম। তোমার মাথার চুলগুলি সব সাদা-সাদা, পাকা চুলের লোকেরা দাদুই হয়। তাই তুমিও আমাদের দাদু।
দাদু, আমরা কিন্তু বেশ রাগ করেই তোমাকে চিঠি লিখছি। আমরা বলতে আমি টুসকি, আমার বন্ধু ইন্দু, ময়না, দেবযানি, পিকু আর আমাদের কুকুর সিল্কি। গত পরশু আমার বাড়ির দিদিমণি আমায় চিঠি লেখা শিখিয়েছে। আমি আমার বন্ধুদের হয়ে তোমায় চিঠি লিখছি। তোমার উপর কিন্তু আমাদের বেশ রাগ হয়েছে।
আজ রথযাত্রা ছিল। তাই আমরা সব বন্ধুরা মিলে ঠিক করলাম, আমরা এবছর রথ টানব। আমরা সবাই কিছু কিছু টাকা দিয়ে একটা দোতলা ও রথের তিনটে ঠাকুর কিনলাম। তারপর আমাদের বাড়ির গাছের কচি পেয়ারা আর হরিকাকুর দোকান থেকে দু-টাকার নকুলদানা কিনে ঠাকুরকে প্রসাদ দিলাম।
তারপর আমার বইয়ের রঙিন কাগজের মলাট ও পিকুর আনা ফেভিকল দিয়ে তাকে সাজালাম। ইন্দু ওদের ছাদে কাপড় শুকানোর দড়িটা ছিঁড়ে এনেছিল রথ টানা হবে বলে।
তারপর সবাই মিলে সকাল ন'টায় রথ নিয়ে রাস্তায় বেরোলাম। মা বাপি তো কিছুতেই আমাকে রাস্তায় যেতে দেবে না। বলেছিল মাঠে টানতে। আমি কান্নাকাটি করে রাজি করিয়েছি। তবুও বাপি আমাদের রাস্তা অব্দি পৌঁছে দিতে এসেছিল।
আমাদের রথ ভালোই চলছিল। সিল্কি আনন্দে ঘেউ ঘেউ করছিল। আমরাও আনন্দে রথ টানছি। রাস্তার দু'পাশের দোকানগুলোতে প্রসাদ দিচ্ছি। বেশ চলছিল রথটা। পিকু জোরে জোরে ঘন্টা বাজাচ্ছিল। তারপরই শুরু হল রথ উল্টোনো। আমাদের রাস্তাটা এত ভাঙাচোরা, জলের পাইপ বসানোর জন্য রাস্তা খুঁড়ে ছিল কিছুদিন আগে, সেখানে উঁচু-নিচু ঢিবি। আমাদের রথ একটুখানি যাচ্ছে, আর উল্টে উল্টে পড়ছে। লাফাচ্ছে, হোঁচট খাচ্ছে, ঠাকুর তিনটে খালি-খালি পড়ে যাচ্ছে রথ থেকে। দিলীপকাকুর মিষ্টির দোকানের সামনে জগন্নাথ পড়ে গেল। তুলতে গিয়ে দেখলাম ঠাকুরের ডানদিকের কাটা হাতটা ভেঙে গেছে। সেই হাত ভাঙ্গা ঠাকুর নিয়ে রাস্তার এক ধার দিয়ে আমরা যেতে লাগলাম। নকুলদানা পেয়ারা প্রসাদগুলো খালি রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে। আমরা সেগুলো তুলে ধুলো-ময়লা ঝেড়ে থালাতে রাখছি। দুটো নকুলদানা নর্দমায় চলে গেল। দুটো সিল্কির পেটে। রাস্তার সবাই আমাদের দেখে হাসাহাসি করছিল, আর কি সব যেন বলাবলি করছিল। শৈল্যবুড়োর চপের দোকানের সামনে পড়ে গিয়ে সুভদ্রার ঘাড় ভাঙল। চার দিন আগে আমিও এই জায়গাটাতে উল্টে পড়েছিলাম। বাবার সঙ্গে চপ কিনতে গিয়ে। তখন আমার কান্না পায়নি। কিন্তু আজ আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। বাকি রাস্তাটা রথটাকে কোলে তুলে তুলে নিয়ে ঘুরতে হল। আচ্ছা দাদু, আমরা কি আর রাস্তায় রথ টানতে পারব না।
রাস্তা কে তৈরি করে আমরা জানি না। তোমাকে আমরা টিভিতে, কাগজে দেখেছি। তোমাকে আমার মামারবাড়ির ভালো দাদুর মতো দেখতে। তুমি তো আমাদেরই দাদুই। মুখ্যমন্ত্রী দাদু। তাই আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম, তোমাকে জানাই। তুমি আমাদের চিঠি পড়ে কিন্তু তাড়াতাড়ি রাস্তাটা ঠিক করে দিও। আমরা পরের বছর উল্টোরথে যেন আনন্দ করে রথ টানতে পারি। ভাঙা ঠাকুর আর ভাঙবে না।
তুমি আমাদের প্রণাম নিও। ইতি-
টুসকি, ইন্দু, ময়না, পিকু, দেবযানি, আর সিল্কি (আমাদের কুকুর)
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬
0 মন্তব্যসমূহ