Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

শেষ শিকার ।। রূপক চট্টরাজ



ছেলেবেলা থেকেই মামলুর শিকারের নেশা। যখন ও গায়ে থাকত, প্রায়ই বাবার সঙ্গে শিকারে বেরুত। তখন শিকার বলতে ছিল বালিহাঁস। গাঁয়ের বেশ কিছুটা দূরে প্রকাণ্ড ঝিল ছিল। ওই ঝিলে দলবেঁধে উড়ে আসত হাঁসেরা।

একটু বড়ো হতেই মামলু বন্দুক চালাতে বেশ ওস্তাদ হয়ে উঠল। কিন্তু কলকাতায় পড়তে আসায় শিকারে ভাটা পড়েছিল। শুধু ছুটিছাটাতে যখন গাঁয়ে যেত তখনই গাঁয়ের বন্ধুদের সঙ্গে শিকারে বেরুত।

একবার গরমের ছুটিতে মামলু গাঁয়ে এসেছে। তখন ওর বন্ধু ক্যাবলা ও মাধব গাঁয়েই ছিল। ওরা তো মামলুকে পেয়ে ভীষণ খুশি।

মাধব বলল, জানিস মামলু, গাঁয়ে হনুমানের উপদ্রব বেড়েছে। সমস্ত ফসল নষ্ট করে দিচ্ছে।

হনুমানের লেজের ডগা কেটে জমা দিলেই পঞ্চাশ টাকা পাওয়া যাবে, কেবলা বলল।

মাধব উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, সে কিরে ?

চোখ দুটো বড়ো-বড়ো করে মাধব বলল, গত সপ্তাহে এ তল্লাটের সব গাঁয়ে ঢেঁড়া পিটিয়ে গেছে। আদেশ দিয়েছেন এলাকার জেলাশাসক।

মামলু ভুরু কুঁচকে বলল, কিন্তু দুদিন হল এসেছি, কোনো হনুমানের নাম-গন্ধ তো পাচ্ছি না।

ক্যাবলা বলল, পাবি রে পাবি। ওরা এখন গা ঢাকা দিয়েছে।

মাধব বলল, তোকে হনুমান দেখাব। কিন্তু কথা দিতে হবে, হনুমান দেখলেই তুই গুলি করবি। আর আমরা তার লেজ কাটব।

সামান্য ইতস্তত করে মামলু ঘাড় নাড়ল, ঠিক আছে।

কেবলা আর মাধব হন্যে হয়ে হনুমান খুঁজতে লাগল। লেজ কেটে দিতে পারলেই পঞ্চাশ টাকা। বেশ মজা করে খাওয়া-দাওয়া বেড়ানো হবে শহরে গিয়ে। খুঁজতে-খুঁজতে একদিন ক্যাবলা হদিস পেল একটা বিরাট গোদা হনুমানের। ছুটে এল মামলুর কাছে। হাঁপাতে-হাঁপাতে বলল, চল তাড়াতাড়ি চল। নইলে পালিয়ে যাবে। আমি মাধবকে ডেকে আনছি। তুই তৈরি থাক। বেশি দেরি করিস না।

মামলু জিজ্ঞেস করল, কোথায় হনুমানটা দেখেছিস ? সেটা বল।

ক্যাবলা যেতে-যেতে উত্তর দিল, বেলুকাকাদের বাগানের দেবদারু গাছে। বলেই ছুট দিল মাধবকে ডাকতে।

বন্দুকে গুলি ভরে বেরিয়ে পড়ল মামলু। ওর আগেই ক্যাবলা ও মাধব বেলুকাকাদের বাগানে চলে এসেছিল।

দেবদারু গাছের ডগার দিকে একটা ডালে বসেছিল হনুমানটা। হনুমানের পিছনের দিকটা দেখা যাচ্ছিল, আর লেজটা ডালের পাশ দিয়ে ঝুলেছিল।

বেশ কিছুক্ষণ মামলু নিশানা ঠিক করে বন্দুক ছুঁড়ল। গুলির আওয়াজে সারাবাগানটা কেঁপে উঠল। পাখিরা চিৎকার করে উড়তে শুরু করল। মামলু মাথা নিচু করে কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে রইল। মাথা তোলার আগে দেখল ওর পায়ের সামনে টপ-টপ করে রক্ত ঝরছে। মামলু এক পা সরে গিয়ে ওপরের দিকে তাকাল। দেখল, হনুমানটা এডালে-ওডালে লটকাতে-লটকাতে পড়ছে। আস্তে-আস্তে হনুমানের অত বড়ো লাশটা ধপ করে পড়ল মামলুর পায়ের সামনে। তারপর কোনরকমে হনুমানটা মাথা তুলে দু-হাত তুলল নমস্কারের ভঙ্গিতে। হনুমানটার দুচোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছিল। মুহূর্তের মধ্যে ঢলে পড়ল মাটিতে।

ক্যাবলা ও মাধব হনুমানের লেজ কাটার জন্য এগিয়ে আসতেই মামলু বাধা দিল, ওর লেজ কাটিস নারে। তোদের কথায় কি যে করে ফেললাম। আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তোরা বরং এই বাগানে গর্ত খুঁড়ে ওকে সমাধিস্থ কর।

ক্যাবলা আর মাধব কি করেছিল মামলু জানে না। তবে, ওই ঘটনার পর থেকে মামলু আর কোনোদিন শিকার করেনি। বন্দুক ছুঁলেই ওর চোখের সামনে ভেসে উঠত মৃত হনুমানের মুখ।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ