![]() |
হুলো আর কেলো হরিহরবাবুর পরিবারের দুই সদস্য। হুলো খুব মিষ্টি স্বভাবের-শান্তিপ্রিয়, আর কেলো খুব অশান্ত প্রকৃতির, দুষ্টুমি করার ওস্তাদ। তবে দু-জন দু-রকমের হলেও ওদের মধ্যে বন্ধুত্বটা কিন্তু খুব গভীর। একদিন কেলো আর হুলো ঠিক করল কেলোর দাদুর বাড়ি যাবে। একই পাড়ায় ও দাদু থাকে। দাদু কুকুর সমাজের নেতা। ঘুরতে গিয়ে প্রত্যেকবারই দাদুর কাছে কেলোর কিছু না কিছু আবদার থাকেই। আজও সেই রকম কেলো আবদার করে বলল, দাদু শোনাও একটা গল্প।
দাদু বলল, তখন তোদের বয়স অল্প, খেতাম শুধু জল সকাল-বিকাল। কেলো আর হুলো বুঝতে পারল, আজ দাদু তার নিজের কোনো আন্দোলনের গল্প শোনাবে।
দাদু বলল, মানুষ করেছিল আবিষ্কার, খিদে হরণ গাছ।
খিদে মেটাতে মাত্র দুটো পাতাতেই হত কাজ।
খিদেহরণ গাছের পাতা খুব সহজেই পাতা যেত তখন। মানুষদের সবার ঘরে খুশির হাওয়া বইছিল। তাদের ভাবটাই ছিল এমন-
ঘরে চাপে না আর রান্নার হাড়ি
সেই টাকা দিয়ে কিনেছে দু-দুটো গাড়ি
আর এদিকে-
বাচ্চাদের পড়াশোনা উঠেছে লাটে
খাওয়ার জন্যই তো সব,
জ্ঞানের জন্য কে আর খাটে?
সেই সময় আমাদের মানে কুকুরদের খুব কষ্টের মধ্যে দিন কাটছিল। একদিন কুকুর সমাজের সভা বসল। সব কুকুর মিলে আমাকে সেই সভার সভাপতি করল। একটা কুকুর বলল,
এঁটোখাবার মেটাতো পেটের জ্বালা
এখন তো মানুষের রান্নাঘরে পড়েছে তালা।
আর একটা কুকুর বলল,
দেখেছি ওই পাতা
ওয়াক থু, যা-তা!
উঠে আসে অন্নপ্রাশনের খাবার
ওরা খায় কি করে বার বার!
আরে কুকুর বলল
কিছু করুন আমাদের নেতা
জ্বলবে আর কত বন্ধুর চিতা!!
আমার প্রতি সবার খুব আস্থা, সবাই নিশ্চিত আমি কোনো রাস্তা দেখাতে পারব বেঁচে থাকার জন্য। আমি সভায় ঘোষণা করলাম-
এসো, কাজ করে করি প্রতিবাদ
পারবে না কেউ তাতে দিতে অপবাদ।
দিন যায় মাস যায়, এমন ভাবেই চলছিল আমাদের। এদিকে মানুষদের মধ্যে খিদে হরণ পাতা নিয়ে সমস্যা দেখা দিতে লাগল। যেমন পাড়ার গুছাইতবাবুর মেয়ের বিয়েতে খাবাবের একটাই মেনু, সেই খিদেহরণ পাতা। মাছ, মাংস, পোলাও নেই। নিমন্ত্রিত একজন বলেই ফেলল,
পেটের জন্য পাতা আমাদের অন্ন
বিয়ে বাড়িতে জিভের জন্য পাতা জগন্য।
হরিহরবাবুর বাড়িতেও সমস্যা। বাড়ির কাজের লোক, দারোয়ান, মালি সবাই চলে গেল। তাদের কথা-
বেঁচে থাকতে চাই দুটো পাতা সারাদিনে,
চললুম গাঁও, এখানে থাকব কেনে?
অল্প-মজুরির কাজের লোকেরা ভাবল, যা রোজগার তা খেতেই চলে যায়? সেই খাবারই যখন বিনা পরিশ্রমে পাওয়া যাচ্ছে, তবে আর খাটব কেন ?
ভগবান মুখ তুলে তাকিয়েছে যখন,
কাজ না করেই এবার কাটাব জীবন।
হরিহরবাবু আক্ষেপ করে বললেন,
খাওয়ার জন্য করে না এখন
আর কেউ কোনো কাজ
বড়ো চুল, ছেঁড়া জামা,
ঘরে-ঘরে কি দুর্দশাই না আজ!!
এদিকে আমার কুকুরের দল বাড়ির উঠোনটায় জল ঢেলে পরিষ্কার করছে। আমিও আছি সঙ্গে। দৃশ্যটা দেখে চমকে গেলেন হরিহরবাবু। যখন একে-একে সব কাজের লোক চলে গেল, তখন আমাদের এই কাজ করা দেখে হরিহরবাবু খুশি হলেন বললেন,
খিদে পেটে একী প্রতিবাদের ভাষা!
স্বীকার করি বুদ্ধিটা তোমাদের খাসা।
গল্প বলতে বলতে দাদুর মুখে হাসি। বললেন,
শেষে মানুষ উঠল জেগে
মিছিলে যোগ দিল একে-একে।
রাস্তায় মানুষের মিছিল, তাদের স্লোগান-
খিদেহরণ পাতা চাই না আর,
রসাতলে যাবে জগত সংসার
লড়াই লড়াই লড়াই চাই
লড়াই করেই খেতে চাই।
মানুষের এই আন্দোলনে প্রশাসনও সায় দিল। পাড়ায় পাড়ায় পুলিশ গিয়ে খিদে হরণ গাছের চাষ নিষিদ্ধ করল। বলল-
খিদে হরণ যদি দেখা যায় কারও হাতে
পুরে দেব তাকে তখুনি হাজতে।
তারপর স্বাভাবিক হল। সেই থেকে খাওয়ার জন্য সবাই পরিশ্রম করতে শুরু করল আবার। এঁটো, বাড়তি খাবার পেতে আর কোনো অসুবিধায় রইল না আমাদের।
দাদুর গল্প শেষ হতেই কেলো বলে উঠল, আ-হা! খিদেহরণ-ইচ্ছাপূরণ!! এমন একটা গাছের সন্ধান যদি পেতাম।
কুকুর তো নয়, মানুষ হতাম, গাড়ি-বাড়ি, কতকিছু চেতাম।
হুলো চুপ থাকার পাত্রী নয়, সে ম্যাও-ম্যাও করে বলে উঠল,
বিনা পরিশ্রমে খাওয়ার পরিণতি,
শুনলি না কেমন হয়েছিল মানুষের আকুতি।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৮
0 মন্তব্যসমূহ