![]() |
একবার ক্লাস সেভেনে বাংলার স্যার রচনা লিখতে দিয়েছিলেন- গ্রীষ্মকাল তোমার কেন ভালো লাগে। আমাদের সহপাঠী রঞ্জুর লেখায় বেশ একটা অভিনবত্ব ছিল। রঞ্জু লিখেছিল, গ্রীষ্মের পরেই বর্ষা, আর তারপরেই আসে শরৎকাল। শরৎকালেই মা দুর্গার আগমন। দুর্গা পুজো। পুজোর লম্বা ছুটি। নতুন জামা কাপড়, জুতো। ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখা। আরো মজা, পুজোর ছুটিতে মা-বাবা দাদা দিদির সঙ্গে দেওঘর বা মধুপুরে বেড়াতে যাওয়া। এরকমই আরো অনেক কিছু লিখেছিল ও। উপসংহারে ছিল- যদি গ্রীষ্মকাল না থাকত তাহলে তো শরৎকালটাই পেতাম না। তাই গ্রীষ্মকাল আমার এত ভালো লাগে। ওর লেখা নিয়ে ক্লাসে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। বিপুলবাবু আদর করে ওর কান মুলে দিয়েছিলেন।
আমি লিখেছিলাম, গ্রীষ্মকাল আমার ভালো লাগে, আম আার ফুটবলের জন্য। তখন গরমের ছুটিতে বনগাঁয় পিসিমার বাড়ি আমাকে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকত। পিসিমা পিসেমশাই আর পিসতুতো ভাইবোনদের ভালোবাসার সঙ্গে মিশে যেত ভোর বেলায় আম কুড়ানোর মজা। নানা স্বাদের, নানা রূপের, নানা নামের আমের ঘোরে কোথা দিয়ে যে কটা দিন কেটে যেত টেরই পেতাম না।
কিন্তু ক্লাস সেভেনে ওঠার পর ফুটবলের নেশাটা এমন পেয়ে বসল যে, বনগাঁর টান কিছুটা ফিকে হয়ে গেল। গরমের সময় কোথাও গিয়ে মন বসে না, মন পড়ে থাকে গঙ্গার ধারে ছোট্ট ছবির মতো শহরটাতে। কারখানার মতোই খেলাধুলার জন্যও তার ভারত জোড়া খ্যাতি তখন। শুধু নিজের খেলার জন্যই নয়, নামী দলের খেলা আর খেলোয়াড়দের দেখার জন্য মনটা ছটফট করত। কলকাতা ময়দানে ফুটবল লিগ শুরু হওয়ার আগে কোম্পানির উদ্যোগে ফার্স্ট ডিভিশনের সমস্ত দল এখানে খেলতে আসত। চোখের সামনে স্বপ্নের খেলোয়াড়দের দেখতে পেতাম। এমনকি তাদের কাউকে কাউকে ছুঁয়েও দেখেছি। কেউ কেউ মাথায় হাত রেখে বা পিঠ চাপড়ে আদরও করেছেন। আর এ সবই তো সম্ভব হয়েছিল গ্রীষ্মকালেই।
আমার আর এক সহপাঠী রুদ্র লিখেছিল, গ্রীষ্মকাল তার প্রিয় রবীন্দ্রজয়ন্তীর জন্য। পঁচিশে বৈশাখ যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন। রুদ্রর লেখাটাই সবচেয়ে ভালো হয়েছিল। বিপুলবাবু খুব প্রশংসা করেছিলেন।
রুদ্র শুধু আমার সহপাঠী ছিল না, ভালো বন্ধুও বটে। আমরা একই পাড়ায় কাছাকাছি থাকতাম। তবে খেলাধুলোয় ওর তেমন উৎসাহ ছিল না। ভালো গান গাইত, আবৃত্তি করত। এব্যাপারে শুধু ও নয়, ওদের বাড়ির সবাই গান, নাচ, আবৃত্তি, অভিনয় নিয়ে চর্চা করত। ওর বাবা-মা কাকা-দাদা-দিদি সবাই।
তখন ক্লাস নাইন। বৈশাখের এক সকালে রুদ্র আমাদের বাড়িতে এল। কিছুক্ষণ গল্প সল্প করে বলল, এবার আমাদের বাড়িতে চল পঁচিশে বৈশাখের অনুষ্ঠানটা এবার বেশ বড়ো করে হবে। সে ব্যাপারে আলোচনা, সেখানে ছোটরাও থাকবে।
গান-টান শুনতে ভালোবাসি ঠিকই, কিন্তু গান-আবৃত্তি এসব আমার আসে না। তখন ফুটবল আর সাঁতার আমার মন জুড়ে। খেলাধুলোয় স্কুলে আর পাড়ার গণ্ডি পেরিয়ে নামটা আরো ছড়িয়েছে। মনে-মনে ভাবি, রুদ্রর সঙ্গে গিয়ে আমি কি করব!
মনের ভাব বুঝতে পেরে রুদ্র বলল, শান্তিনিকেতন থেকে আমার মামা-মামি মামাতো ভাই বোনেরা এসেছে! ওখানে তো পয়লা
বৈশাখেই রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান হয়ে গরমের ছুটি পড়ে যায়। এবার গরমের ছুটিটা
ওরা এখানেই কাটাবে। মামা-মামী দুজনেই খুব ভালো গান গায়। প্লিজ চল।
ওদের বাড়িতে ঢোকার মুখেই কানে এল, দরাজ কণ্ঠে কে যেন গাইছেন- 'আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান, বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।' ঘরে ঢুকে দেখি খাটের ওপর বসে সৌম্য-সুদর্শন একজন গাইছেন। বাড়ির সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছে। একটা গান শেষ হলেই আর একটা গান গাইতে বলছে সবাই। তিনিও গাইছেন তাঁর অপূর্ব সুরেলা কন্ঠে। রুদ্র ফিসফিস করে বলল, আমার বড়োমামা।
সুরেলা কণ্ঠে তিনি ধরলেন- 'এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে মুকুলগুলি ঝরে, আমি কুড়িয়ে নিয়েছি, তোমার চরণে দিয়েছি- লহো লহো করুণ করে।'
এরপর তিনি গাইলেন, 'মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি, হে রাখাল, বেণু তব বাজাও একাকী।'
এতদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছি রেডিওতে বা পাড়ার কোনো অনুষ্ঠানে শ্রোতার ভিড়ে দাঁড়িয়ে। কিন্তু এমন করে কখনো অনুভব করিনি। এক গভীর ভালোলাগায় মনটা ভরে গেল। সেদিন রুদ্রর মামা-মামীরা সবাই মিলে একটা গান গাইলেন- 'আমাদের শান্তিনিকেতন, আমাদের সব হতে আপন। তার আকাশ ভরা কোলে মোদের দোলে হৃদয় দোলে, মোরা বারে-বারে দেখি তাই নিত্য নূতন।' এ গানটা বোধহয় সেই প্রথমবার শুনলাম।
সেদিন গানে-গানে বেলা গড়িয়ে গেল। ঠিক হল, সন্ধেবেলা রবীন্দ্রজয়ন্তীর মিটিং হবে। রুদ্র বলল-ওবেলা আসতে ভুলিস না যেন।
মনে মনে ভাবছি, আমি এসে কি করব, আমি তো এসবের কিছুই পারি না। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কেন জানি না সেদিন রাধাচূড়ার রং অনেক বেশি উজ্জ্বল মনে হল। পথের ধারের ঝরা বকুল মাড়িয়ে যেতে মন চাইল না, বরং ক'টা ফুল কুড়িয়ে নিলাম। মনটা ভালো হয়ে গেল।
সন্ধেবেলা কিসের এক অমোঘ টানে পৌঁছে গেলাম রুদ্রদের বাড়ি। ওর মামা-মামী আর মামাতো দাদা-দিদির সঙ্গে আলাপ হল। রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের নানা পরিকল্পনা চলতে লাগল। বড়োরা কি গান গাইবেন ঠিক হল। রুদ্রর বাবা-মা-মামী-দিদিরা আর প্রতিবেশী দুই কাকিমা একক সঙ্গীত পরিবেশন করবেন। দুই কাকিমাকে ঘষে-মেজে নেবার দায়িত্ব নিলেন রুদ্রর মামা-মামি। 'আফ্রিকা' কবিতা আবৃত্তি করবে রুদ্র। 'সোনারতরী' কবিতা আবৃত্তি করবে রুদ্রর এক দাদা। এছাড়া পাড়ার দিদি আর বোনেরা মিলে মঞ্চস্থ করবে রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য। রবীন্দ্র সংগীতের সঙ্গে নাচবে ছোটোরা। মেয়েরা একটা নাটক করবে 'লক্ষ্মীর পরীক্ষা'। আর একেবারে কচি-কাঁচাদের জন্য থাকবে আবৃত্তি প্রতিযোগিতা 'দামোদর শেঠ'।
সেদিন রবীন্দ্রজয়ন্তী নিয়ে আলোচনার পর আবার বসল কবিতা ও গানের আসর। মেয়েরা সমবেতভাবে গাইল- 'এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ, তাপস নিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।'
পাশের বাড়ির কাকিমা রেওয়াজের অভাব থাকলেও সুন্দর গাইলেন- 'তুমি কি কেবলই ছবি, শুধু পটে লিখা, ঐ যে সুদূর নীহারিকা…।'
রুদ্রর মামিমার অসাধারণ পরিবেশন- 'রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব। আমি হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব...।'
একের পর এক গানের স্নিগ্ধ বর্ষণে আমার মাঠ-চরা রুক্ষ কৈশোর যেন একটু একটু করে ভিজে যাচ্ছিল।
রুদ্রর মামা গল্পের ছলে শোনালেন, রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতনের কথা। সেখানকার পড়াশুনোর ধরন-ধারণ আর আশ্রমিকদের নানান গল্প। মনের মধ্যে শান্তিনিকেতনের একটা ছবি আঁকা হয়ে গেল। সেদিন বাড়ি ফেরার পথে সারাক্ষণ মনে হচ্ছিল, নাইবা থাকল সুসজ্জিত মঞ্চ, ফুলের মালা আর সাদা টেবিল ক্লথের উপর কবিগুরুর ছবি, পঁচিশে বৈশাখেরও না হয় এখনও ক'দিন বাকি, তবুও আজ তাঁরই গানে, কবিতায়, গল্পে-কথায় যে মনোরম সন্ধ্যাটি উদযাপিত হল তা তো রবীন্দ্রজয়ন্তীই।
পরে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনেক অনুষ্ঠানেই হাজির থেকেছি, কিন্তু সেদিনের সেই অনাড়ম্বর একান্ত-ঘরোয়া পরিবেশে কবিগুরুর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম তা আজও আমায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১৪
0 মন্তব্যসমূহ