Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

চশমা ।। মৃদুলা ভট্টাচার্য



দোলের আগের দিন বিশুদের বাড়িতে অনেক আত্মীয়-স্বজন। পরেরদিন দোল উপলক্ষে পুজো হবে, তারপর সকলে মিলে দোল খেলা হবে। সেদিন শনিবার, তাই বাবা-কাকাদের অফিস ছুটি। পিসে আর পিসি চলে এসেছেন দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে। সকালের জল-খাবারের পর সকলেই গল্প-আড্ডায় মগ্ন। ছোটোরা বিশুর ঘরে ক্যারাম বোর্ড খেলায় মত্ত। বিশুর দাদু দোতলায় বসে কাগজ পড়ছেন। মা, কাকিমা, পিসি, ঠাম্মা সবাই মিলে রান্নার আয়োজন করতে-করতে গল্পগুজব বেশ জমিয়ে তুলেছেন।

এমন সময় দাদু দোতলার বারান্দা থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন। সকলেই ব্যস্ত হয়ে এল তাঁর কাছে। সবাই উদ্বিগ্ন। কি হয়েছে! দাদু উত্তেজিত হয়ে বললেন, আমার চশমাটা কোথায় গেল ? আমি বারান্দায় এই টেবিলে কাগজ আর চশমাটা রেখে জল খেতে গিয়েছিলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যে এসে দেখি চশমা নেই! ভাবলাম, অন্যমনস্ক হয়ে চশমা অন্য কোথাও খুলে রেখেছি। তন্নতন্ন করে সারা ঘর খুঁজে ফেললাম। দেখতে পেলাম না। কিন্তু আমার ঠিক মনে আছে আমি কাগজের ওপর এই চশমাটা রেখেছিলাম। দেখো তো তোমরা খুঁজে পাও কিনা। চশমা ছাড়া তো বই-কাগজ কিছুই পড়তে পারব না। তা বলে চশমা ছাড়া কি চশমাটাও খুঁজে পাবো না!

বাড়িসুদ্ধ সকলে চশমা খোঁজা চলছে। বিশু, টিনা, নন্তু, রুবি, অজু আর দাদুর খাস লোক কিশোরীদা, যাকে বিশু বলে দাদুর রাইট-হ্যান্ড। সবকিছু ঠেলাঠেলি করে সরিয়ে খুঁজতে লাগল। ড্রয়ার, আলমারির তলা, সোফার নিচ সব জায়গায় চিরুনি তল্লাশি চালানো হল। চশমা খুঁজতে গিয়ে অনেক দিন হারিয়ে যাওয়া রূপোর নস্যির কৌটোআরো অনেক কিছু বেরিয়ে এল আলমারির তলা থেকে। আরো অনেক কিছুই বেরোল কিন্তু চশমা পাওয়া গেল না। সবাই হতাশ হয়ে ফিরে গেল।

দাদুর মনটাও খারাপ হয়ে গেল। বেচারির সময় কাটে কি করে। শেষে দাদু ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত হয়ে খাটের উপর ঘুমিয়ে পড়লেন।

দুপুরে ঠাম্মা দাদুকে খেতে ডাকতে যেতে দাদুর ঘুম ভাঙল। ঠাম্মার পেছন-পেছন রুবি আর বিশুও এল। দাদু উঠেই আবার সেই চশমার চিন্তা, কোথায় গেল চশমাটা! এবার ঠাম্মা বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলে, চশমা আর কোথায় যাবে ? সেটার তো পাখা গজায়নি বা পা-ও নেই যে, হেঁটে চলে বেড়াবে। নিজে কোথায় রেখেছ ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে দেখো। বাড়িসুদ্ধ লোককে নাজেহাল করে দিচ্ছ। বেলা হয়েছে স্নান করে খেতে এসো।

রুবি হঠাৎ একটা টুলে উঠে ভালো করে দাদুর মাথাটা দেখার চেষ্টা করল। বিশু বলল, কি দেখছিস অমন করে ? দাদা আমি দেখছি ফিল্মস্টারদের মতো দাদু চশমাটা মাথায় তুলে রেখেছে কিনা। দাদু অমনি ঝেঁজিয়ে উঠে বললেন, আমি কি ফিল্মস্টার নাকি যে চশমা চোখে না দিয়ে মাথায় তুলে রাখব ? আমার চশমা থাকে হয় চোখে না হয় খাপে। আর তখন আমি চশমাটা ওই টেবিলের উপরে রেখেছিলাম। বলতে-বলতে গটগট করে স্নান করতে বেরিয়ে গেলেন।

দুপুরে সবাই চুপচাপ খাওয়া সারলাম। সবাই চিন্তিত চশমাটা গেল কোথায়! বাইরের লোক তো আর ঘরে ঢোকেনি। খাওয়ার পর যে যার ঘরে বিশ্রাম নিতে গেল। বিশুর ভাই-বোনেরা আবার ক্যারাম খেলায় মন দিল। কিন্তু বিশু টিনটিনের বই নিয়ে জানলার ধারে তার খাটে শুয়ে পড়ায় মন দিল। কিন্তু ঠিক এক মনে পড়া যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যেই চশমার চিন্তাটা ঘুরে-ফিরে মাথায় চলে আসছে। জানলা দিয়ে হঠাৎ বিশুর চোখ চলে যায় ইউক্যালিপটাস গাছটার দিকে। সেখানে কাক বাসা বানাচ্ছে। হঠাৎ সে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। তখনই তার ভাই-বোনেরা চেঁচিয়ে ওঠে, কোথায় যাচ্ছিস দাদা ? আমরাও যাব। সে মুখে আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ করার ইশারা করে বলে, তোরা যদি আমার সঙ্গে যেতে চাস তবে চুপচাপ নিচে আয়। আর একদম কোনো প্রশ্ন নয়। শুধু যা-যা বলব তাই-তাই করে যাবি।

সবাই চুপচাপ বিশুর পিছন-পিছন গ্যারেজে এসে পৌঁছেছে। সেখান থেকে বড়ো মইটা বার করে ইউক্যালিপটাস গাছটায় লাগিয়ে নিচে সবাই ধরে রেখেছে। আর বিশু উপরে উঠেছে। এমন সময় গাড়ির ড্রাইভার রামস্মরণ হই-হই করে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে বিশু গাছে উঠে কাকের বাসার কাছে পৌঁছে গেছে। কাকটা দেখতে পেয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করতে-করতে বাসা ছেড়ে উড়ে যায়। তার কা-কা শুনে আরো বেশকিছু কাক চলে আসে। দু-একটা কাক বিশুর মাথায় ঠুকরেও দেয়। বিশু তাতে পরোয়া না করে বাসাটা ভালো করে দেখতে থাকে। বিশুর অনুমান যে ঠিক তা কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রমাণিত হয়। সে চশমা হাতে নিয়ে নিচে নেমে এসে দেখে বাড়ির বড়োরা কখন যেন সেখানে এসে পৌঁছেছে।

চশমা হাতে বিশুকে নেমে আসতে দেখে বাবা তাকে প্রশ্ন করল, তোর কী করে মনে হল যে কাক-ই চশমাটা নিয়েছে ?

বিশু উত্তরে বলে, আমি টিনটিনের বইয়ে পড়েছিলাম, ম্যাগপাই রিয়াংকা ক্যাস্টাফিয়রির নিয়ে ইমারেল্ড বাসায় রেখেছিল। আমি জানি কাকেরাও বাসা বানানোর সময় যা পায় তাই নিয়ে যায় বাসা বানাতে। আমি শুয়ে জানলা দিয়ে কাকের বাসা বানানো দেখছিলাম। হঠাৎ ম্যাগপাইয়ের কথা মনে হতেই নিচে নেমে আসি।

দাদু বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে নীরবে বিশুর কাণ্ড দেখছিল, কেউ টের পায়নি। এবার তিনি বললেন, দেখ শুধু ওই ছেলেটাই আমার চশমার কথা ভাবছিল।

দাদু সব নাতি-নাতনিদের উদ্দেশ্যে বললেন, আজ বিকেলে তোদের সবাইকে একটা করে চকলেট খাওয়াব আমি।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । আগস্ট ২০১২

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ