Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ভূতের ভুল ।। মধুসূদন ঘাটী

 

সক্কালবেলা ভুল করে একটা ভূত তার রোগা টিংটিঙে একটা পা ফেলে কখন পালিয়ে গেছে কেউ জানে না। আন্তুপিসি খিড়কি ঘাটে বাসন মাজছিল। বেলতলায় কোনোদিন তেমন কিছু চোখে পড়ে না। আজ হঠাৎ চোখে পড়ল কালো কুচকুচে দেখতে কি একটা যেন নড়ে-চড়ে উঠেছে। মানুষজন কেউ নেই অথচ ওটা নড়ছে কি করে ?

আন্তপিসির ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। বাসন হাত ফসকে তলিয়ে গেল জলে। তারও একটা পা সড়াৎ করে আটকে গেল দুটো ধাপের মাঝখানে। এমন কোনোদিন হয়নি। কাউকে যে চিৎকার করে ডাকতে যাবে তারও তেমন সুযোগ নেই। আন্তুপিসি খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে খিড়কি ঘাটে আসে বাসন মাজতে। অন্যেরা তখন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করে। মা অবশ্য খানিক পরেই ওঠে। কিন্তু উঠেই তো আবার জানলা-দরজা আলগা করে ঠাকুর ঘরে চলে যায় বাসি ফুল-পাতায় নোংরা পরিস্কার করতে। ঘাট থেকে ডাকলে শুনতে পাবে না। খিড়কি ঘাট হলে হবে কি, একটা রাস্তা পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে। যেখান দিয়ে কেউ তেমন সচরাচর যাওয়া-আসা করে না। আর রাতের বেলায় নৈব নৈব চ। এমন ঘুটঘুট্টি অন্ধকার থাকে যে, কেউ কাউকে দেখতে পায় না। ভূতের ভয় তো থেকেই যায়। বাঁশঝোপগুলো মাথা নুইয়ে গল্প করে, হাসাহাসি করে। ঘরর-ঘরর শব্দে ওঠে শুকনো পাতায়। আন্তুপিসি রাতে কখনো ঘাটে নামে না। তারও তো ভয়-ডর বলে একটা বস্তু আছে।

তারই ফাঁকে পাশের বাড়ির পোষ মানা ভোলা যাচ্ছিল লেজ নাচাতে-নাচাতে। ও তো আন্তুপিসিকে চেনে। দুপুরবেলা পায়ে-পায়ে জড়ায় ভালো-মন্দ খাবে বলে। কাল ও বেশ ভুরিভোজ খেয়েছে আন্তুপিসির কাছ থেকে। আমার ছোটো ভাই তিতিনের জন্মদিন ছিল কাল। পাড়ার লোকজনকে তেমন নেমন্তন্ন করা হয়নি ঠিকই কিন্তু তিতিনের বন্ধুদের ডাকা হয়েছিল। এঁটো শুধু নয়, আন্তুপিসি ভোলাকে মাংস মাখানো ভাতও দিয়েছিল। হঠাৎই সেই ভোলার চোখে পড়ল আন্তুপিসিকে। গোঁ-গোঁ শব্দ করে আন্তুপিসি গলা অবধি জলে ডুবে যাচ্ছে। ভোলা তখনই ঘেউ-ঘেউ করে পাড়া মাথায় করতে শুরু করল।

মা ঠাকুরঘর থেকে বলল, কি হয়েছে রে ভোলা? অমন করে চেঁচাচ্ছিস কেন? খিদে পেয়েছে? কাল তো খেলি, এক্ষুনি আবার খিদে পেয়ে গেল? ভোলা আরো জোরে ঘেউ-ঘেউ করে উঠল। মা এবার বাইরে বেরিয়ে আসতেই ভোলা লাফিয়ে মা-র গায়ের উপর আছড়ে পড়ার ভঙ্গি করল। মা-রও চোখ পড়ে গেল পুকুরের দিকে। পুকুরের জল যেন তোলপাড় হচ্ছে। দেখতে পেল আন্তুপিসি তলিয়ে যাচ্ছে জলে। এক দৌড়ে জলে নেমে আন্তুপিসিকে টেনে তুলতে-তুলতে কান্নায় ভেসে গেল মা।

দেখতে-দেখতে পাড়ার লোকজনে ভরে উঠল খিড়কি পুকুরের চারপাশে। ভোলার এই উপকারের কথা মা ছাড়া কেউ জানল না। ভিড় দেখে ভোলা আপনমনে বেলতলায় যেতেই দেখতে পেল সেখানে কালো কুৎসিত কি যেন নড়ে-চড়ে উঠছে। সে খেলার সঙ্গী পেয়ে বেশ ডগমগ। এদিকে আন্তুপিসিকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে শোয়ানো হয়েছে। পরিচর্যার অভাব নেই, গোটা পাড়াটাই জেগে উঠেছে। আমিও চোখ ডলতে-ডলতে ভিড়ের মধ্যে সেঁটিয়ে গেলাম। বারান্দায় আর তিলধারণের জায়গা নেই। ভোলা সেই জিনিসটাকে নিয়ে লোফালুফি খেলছে আর মাঝেমধ্যে ঘেউ-ঘেউ শব্দ করছে। মা-র চোখে এসবই পড়ে। কেন না, ভোলাই তো আজ আন্তুপিসিকে বাঁচিয়েছে। তারপর মা-র যা হল তা আর বলার নয়। মা-ও আন্তুপিসির মতো প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।

সকলের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠল এবার মা-ও। মা কেন হঠাৎ জ্ঞান হারাল! এবার ডাক্তার ডাকবার হিড়িক পড়ল নিয়ম মেনেই। কে আর এমন অবস্থায় মাকে ফেলে রাখবে। জল-বাতাসের বিরাম নেই।

ওদিকে আন্তুপিসি পরিচর্যার চাপে হাঁসফাঁস করতে-করতে বিছানায় উঠে বসেছে। চোখ কচলে বলে উঠল, বেলতলায় কালো মতন একটা...।

নিমেষের মধ্যে সকলের চোখ গিয়ে পড়ল বেলতলার কালো সেই বস্তুটার দিকে। আন্তুপিসি তখন আমতা-আমতা করে উঠল, ওটা নড়ছে  কেন ?

সত্যিই তো! ভোলা ওটাকে যত নাড়াচ্ছে ওটা ততই লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছে? বস্তুটা যে কি কেউই আন্দাজ করতে পারছে না? এবার মা-র চারপাশ থেকে লোক পাতলা হতে শুরু করল? বেলতলায় যেন রথের মেলা বসে গেছে? লোক জমতে-জমতে লোকারণ্য হয়ে উঠল? সকলের মুখে তখন একটাই কথা, কালো-কুৎসিত বস্তুটা কি?

লোকজনের চাপে ভোলা ভেগেছে। কালো মতন ভুসোকালি রঙের এটা যে কি হতে পারে তার হদিস এখন কে দেবে! তাই নিয়ে কিছুক্ষণ চলল আলোচনা। বাবাই মত দিলেন- ওঝা ডাকতে হবে। সবাই কেমন চুপসে গেল। বলল, ওঝা কেন? এটা কি তবে কোনো ভুতুড়ে কাণ্ড? ততক্ষণে পাড়ার এক হাতুড়ে ডাক্তারও এসে হাজির হয়েছেন। তিনি বললেন, হতে পারে।

ব্যস, কয়েক সেকেন্ডেই খালি হয়ে গেল বেলতলা। ওদিকে মা'ও উঠে বসেছে। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওই কালো বস্তুটার দিকে। আন্তুপিসি ভেজা কাপড়ের আঁচলে চোখ-মুখ রেখেছে। পাছে আবারও চোখে পড়ে যায় জিনিসটা।

বেলা বাড়তে লাগল। পাশের গ্রামের ওঝাও লোকমুখে শুনেছিল বস্তুটার গল্প। তিনি এমনিতেই এসে হাজির হলেন। তারপর গুটিকয়েক লোকদের সরিয়ে বস্তুটার কাছে গিয়ে বসলেন। সকলের মাথা ঝুঁকে পড়ল বস্তুটার ওপর। আশ্চর্য, সেটা তখনও নড়ছে। এবার খপ্ করে মুঠোয় ধরে ওঝা হা-হা করে হেসে উঠলেন। নড়াচড়াও বন্ধ হয়ে গেল। সবাই তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, কিছু বলুন-

ওঝা  বললেন, এটা ভূতের পা। ভুল করে সে তার একটা পা ফেলে ভেগেছে। অবিনাশ চাটুজ্জে যখন মারা গিয়েছিলেন, আপনারা সকলেই জানেন তাঁর একটা পা ছিল কাঠের তৈরি। বিদেশ থেকে অনেক খরচপাতি করে সেটা আনিয়ে ছিলেন। ব্যবহার করেছেন বছর দশেক। দেখতে অনেকটা সত্যি পায়ের মতোই। মারা যাওয়ার পর সেই পায়ের শান্তি কামনায় মাঝে খটখটিয়া গ্রামে ঘুরে বেড়ান। এই গত পরশু যেমন ঘোষপাড়ার নিত্যানন্দের বাড়িতে উকি মেরে ছিলেন। ঝাঁটা পেটা করে সেটাকে তাড়ানো হয়েছে। আন্তুপিসির বাড়িতে তার তো যাতায়াত ছিল। মাঝেমধ্যে এসে আন্তুপিসির কাছে দোক্তা পান খেয়ে যেতেন। কাল হয়তো সেই দোক্তা পানের লোভেই একবার এসে হাজির হয়েছিলেন এখানে। আগে যতবার এসেছেন কোথাও পা-টা ছেড়ে যাননি। এবার গিয়েছেন। ভালোই হয়েছে। আমি এই পা-টা নিয়ে যাচ্ছি। কোনো মিউজিয়ামে রাখার ব্যবস্থা করছি। অবিনাশ চাটুজ্জে একটা পা হারিয়ে আর কোথাও যেতে পারবেন না। বলেই সরু লিকলিকে কালো-কুৎসিত বস্তুটাকে তাঁর লম্বা ঝোলা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেললেন।

আন্তুপিসি এবার এগিয়ে এল ওঝার কাছে। এসে বলল, ওটা অবিনাশের কাছেই থাক না। অনেক দিনের পুরনো কথা। ভীষণ ভালো মানুষ ছিল অবিনাশ। ওটা যদি তার পা-ই হয় তবে তার কাছেই ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হোক। হাজার হোক, মানুষটা এত হাসিখুশি ছিল যে, পাড়ায় ঢুকলেই ছোটোদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। কে আগে অবিনাশের কাছে যেতে পারবে। কেন না, ওর লম্বা জামার পকেটে সবসময়ই ভরা থাকত নানান স্বাদের চকোলেট। ছোটোদের কথা ভেবেই ওকে এবারের মতো ছেড়ে দাও। ভূতেরও তো ভুল হতে পারে।

সকলের মুখে এবার হাসি ফুটে উঠল।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । মে ২০১৩

Topic : Ghost story in bengali, ভূত-ভৌতিক

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ