![]() |
সুমনের গৃহশিক্ষিকা রত্নাদির একখানা কবিতার বই বেরোল। রত্নাদির এখন কত নাম-ডাক। তিনি এখন শুধু সুমনের দিদিমণি বা রত্না নয়। রীতিমতো কবি রত্না ভৌমিক। কত বড়ো বড়ো লোকজন আসেন তাঁদের বাড়িতে। সাহিত্য সভা হয়, গল্পপাঠ, কবিতা পাঠ, প্রবন্ধ-আলোচনা।
ওফঃ, সুমন যদি এমনটা হতে পারত। দিন-রাত তার এখন শুধু একটাই ভাবনা- পকেটে সর্বক্ষণ কাগজ-কলম, চোখে-মুখে ভাবনার ভাঁজ আর চলনে-বলনে ঠিক যেন কমল পাগলা। কিন্তু হলে কি হবে কাগজ-কলম তার এক হয়ে একছত্র লেখা হয়ে উঠল না। তবে কি সে কবি হয়ে উঠতে পারবে না!
ক'দিন হল সুমন বন্ধুদের সঙ্গে বিকালের খেলাও বন্ধ করে দিয়েছে। ওই সময়টা সে ডাক্তার বাগানের পুকুর ঘাটে একা-একা বসে হাওয়ায় ঢেউ খাওয়া পুকুরের জল দেখে আর ভাবে তার কবি হয়ে ওঠার কথা। কেমন করে কবিতা লেখা যায়, কবিতা লিখতে-লিখতে কেমন করে রত্নাদির মতো, না-না তার থেকেও অনেক বড়ো কবি হয়ে যাওয়া যায়। কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে সেও পাড়ি দেবে একদিন বইপাড়ায়, রবীন্দ্রসদনে। রত্নাদির মতো তার বাড়িতেও কত বড়ো বড়ো লোকেরা আসবে সাহিত্য সভা করতে। সেখানে কেউ আবৃত্তি, কেউ বা গল্পপাঠ করবে, কেউ কেউ প্রবন্ধপাঠ। স্বপ্নের সাগরে ডুব দেয় সুমন। খবরের কাগজের পাতায় পাতায় নিজের লেখা, ছবি প্রশংসা দেখে বেড়ায় সে। বন্ধুদের ইর্ষাও সুমনের চোখ এড়ায় না। এমন কি পাড়ায়-বেপাড়ায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোও সুমনকে বাদ দিয়ে হয় না। তার বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে নাম-সুনাম বেড়েছে বৈ কমেনি।
একদিন এক অনুষ্ঠানে সুমন উপস্থিত। পাশে তার রত্না দিদিমণি। এমন সময় এক নবীন কবি সুমনের পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতে গেলে পাশে দিদিমণি থাকাতে সে লজ্জা পেয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে 'থাক-থাক' বলে পা দুটো সুমন সরিয়ে নিল। আর যেই না 'থাক-থাক' বলার সঙ্গে সঙ্গে পা দুটো সুমন সরিয়ে নিয়েছে অমনি সে ডাক্তার বাগানের স্নানের ঘাট থেকে কাৎ হয়ে একেবারে পুকুরের জলে ঝপাস করে পড়ে গেল। আশপাশ থেকে তার বন্ধুরা ছুটে এল- 'কি হয়েছে, কি হয়েছে' বলে। কেউ বা দৌড়য় তার মাকে খবর দিতে। আবার কেউ হো-হো করে, কেউ ফিক-ফিক, কেউ বা হা-হা করে হেসে ফেলল। সুমনের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। মা এসে জিজ্ঞেস করে, 'কি রে, কি হয়েছে?' সুমন উত্তর দিতে পারে না।
সন্ধ্যা হয়ে এল বলে। বাড়িতে গিয়ে জামা-প্যান্ট পাল্টে একটু পরেই পড়তে বসে সুমন। দিদিমণি পড়াতে এসে মায়ের মুখ থেকে সব শুনে সুমনকে কি হয়েছে জানতে চায়। উত্তরে সুমন মুখ নীচু করে বসে থাকে। কিছু বলতে পারে না লজ্জায়। দিদিমণি আবারও জিজ্ঞাসা করেন। এবার আমতা-আমতা করে সুমন বলে। অল্প কথাতেই দিদিমনি সব বুঝে নেন।
দিদিমণি হাসতে হাসতে বললেন, বেশ তো কবি হবে। এ আর না হওয়ার কি? খুব ভালো কথা। তবে বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে খেলা না করে পুকুরঘাটে-মাঠে শুয়ে-বসে স্বপ্ন দেখলেই তো চলবে না, সব মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদের জীবনের কথা জানতে হবে। মনের কথা বুঝতে হবে। কত সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নায় ভরা মানুষের জীবন। কত সমস্যায় জর্জরিত এই সমাজ। এসব বুঝে ওঠা খুব সহজ কাজ নয়। সাহিত্য সমাজের একটা অঙ্গ। সমাজের ভালো মন্দটা তুলে ধরতে হবে তোমার লেখায়। তোমার লেখনী এই সমাজের মানুষকে সঠিক পথ দেখাবে। তবেই না সেটা লেখা। আর এজন্যই চাই পড়াশুনো। তুমি মন দিয়ে পড়াশুনো করো। আগে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। তবেই না যোগ্য সমাজ গড়ার কাজে হাত দিতে পারবে। যা দেখবে তার ভালো মন্দ ভাববে-বুঝবে। মনে রাখবে, কবি-সাহিত্যিকরা সমাজ থেকে আলাদা নয়। তারাও আর সব মানুষের মতো মানুষ। কিন্তু তাদের দেখার চোখ আর সকলের থেকে অনেক আলাদা। তেমন করে দেখার জন্য চাই মন আর জ্ঞানের বিকাশ। আশা করি তুমি অনেক বড়ো কবি হবে।
মাথা নিচু করে শোনে সুমন। দিদিমণির কথাগুলো মনের মাঝে গেঁথে নেয় নীরবে, একান্ত গোপনে। কলমটা শক্ত করে ধরে। মনের মধ্যে তার একটাই সংকল্প, সে অনেক বড়ো কবি হবে।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । বৈশাখ ১৪১৬
0 মন্তব্যসমূহ