Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

অন্য দোসর ।। মানসী গঙ্গোপাধ্যায়



শরতের শুরু। মখমল রোদ্দুরে ভরা মিষ্টি সকাল। জলের চৌবাচ্চাটির ওপরে জমাটবাঁধা আলকাতরা যেন পড়ে রয়েছে এক তাল। তার ওপরে বেশ একটা মিঠে বৈচিত্রের মতন পড়ে আছে একখানা সাদা পশমের গোলা। কেউ বুঝি ফেলে রেখে গেছে আলগোছে-অবহেলায়।

দৃষ্টিভ্রমই বলে বুঝি একে।

সাত মাস বয়স হয়েছে তার। বেশ ডাগর-ডোগর পুরুষালি চেহারা। নধর গায়ের রং কুচকুচে কালো। গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকে যখন জলের ট্যাংকটার ওপরে, মনে হয় ঠিক যেন আলকাতরা একদলা। গলার নিচে একপ্রস্থ সাদা রঙের প্রলেপ। সারা রাতটা বাড়ি পাহারা দিয়ে এখন ঘুমোচ্ছে পড়ে-পড়ে কালো নামের সারমেয়েটি।

বন্ধু মেনিটা বাচ্চা দিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। একখানা বাচ্চা জন্মেই চলে গেছে হুলোটার পেটে। বাকি ছানা দুটো এরই মধ্যে চোখ ফুটে রীতিমতো সেয়ানা হয়ে উঠেছে। গায়ের রং তাদের তুলতুলে সাদা। একসঙ্গে জড়িয়ে দুজনে যখন ঘুমায়, দিব্যি একখানা সাদা পশমের গোলা। সেই ছানা দুটোই এখন ধামসে রয়েছে কুকুরটার পেটের ওপরে জড়াজড়ি করে। শরতের হিম সকালে কালোর গায়ের ওম পোহাচ্ছে তারা।

কালো তখন নেহাত বাচ্চা। মা-টা মরে গিয়ে হঠাৎই একদিন বেওয়ারিশ বনে গিয়েছিল সে। সেই সময়, কি জানি  কেমন করে ঠাঁই জুটে গিয়েছিল তার এই বাড়িতে। এই বাড়ির কর্তী-মা একই সঙ্গে খেতে দিত তাদের পাশাপাশি। একটু বয়েস হতে এই বাড়ির মিনিটাকে তেড়ে 'খ্যাঁক' করতে গিয়ে কর্তী-মায়ের হাতে কান মলা খেয়েছিল কালো। ঠিক যেমনি অন্য আরেকদিন কালোর ওপর রেগে গিয়ে 'ফ্যাঁস্' করে তেড়ে যেতে একইরকমের শাস্তি জুটেছিল মেনির কপালে। তারপর থেকেই দুজনের মধ্যে বেশ একখানা সমঝোতা হয়ে গিয়েছিল, একে-অন্যের দোসর বনে গিয়েছিল দুজনে। দুজনে একসঙ্গে মিলেমিশে দুধ-পাঁউরুটি আর মাছের কাঁটা দিয়ে ভাত খেত। তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে চৌবাচ্চার ওপরে পাশাপাশি শুয়ে ঘুম লাগাতো তারা, দুই দোসরে মিলে।

এমনি করেই কেটে যাচ্ছিল এরকম। দিন যায়, মাস যায়। কালো তখন আর ছোট্টটি নেই। মাটির সঙ্গে মুখ লাগিয়ে হাঁটে না। ঘন লোম গজিয়ে উঠেছে তার লেজে। গোলগাল মুখখানিতে তার পরিবর্তন আসছিল একটু একটু করে।

একদিন আচমকা বাচ্চা দিয়ে মা হয়ে বসল মেনিটা। একটা নয়, দুটো নয়, তিন-তিনটে বাচ্চা, একসঙ্গে। এই তিন খুদেকে দেখে কালোর দুই চোখে বিস্ময় ভেঙে পড়েছিল সেই দিন। মেনিকে কেমন যেন নতুন আর অচেনা লাগছিল তার। খুদে-খুদে বাচ্চাগুলোর চোখ বলতে কিছু নেই। মেনির পেটের ওপর হামলে পড়ে লাল-লাল ঠোঁটে তারা চুকুস-চুকুস দুধ চোষে। আর তাই দেখে কালোর চোখে যেন দ্বন্দ্ব লেগে যায়। বন্ধুর ছানাগুলোর প্রতি উদগত মমতায় মোহিত হয়ে থাকে কালো, এক আশ্চর্য জীবগুলোকে নিয়ে দিনরাত্তির কেটে চলে তার।

এরইমধ্যে বিপত্তিটা ঘটে গেল একদিন। মুহূর্তের অসতর্কতায় মেনির একটা ছানাকে কপাৎ করে খেয়ে গেল হুলো বেড়ালটা। মেনি-মা কাতর স্বরে কেঁদে বেড়ালো কটা দিন, হারিয়ে যাওয়া বাচ্চাটার শোকে।

সেই দিনের পর থেকে সজাগ থাকে মেনি, সজাগ থাকে কালোও। বন্ধু মেনির ছানা দুটোকে যেন প্রাণে ধরে আগলে রাখে সে। চোখের ওপর বাচ্চা দুটো বড়ো হতে থাকে একটু-একটু করে। দুষ্টু হুলো আড়াল থেকে ড্যাবডেবিয়ে চায়, আর হা-পিত্যেশ করে মরে।

আরো একদিন বাচ্চাগুলো হুটোপুটি করে খেলা করছিল তখন টগর গাছের তলায়। হুলোটা পাঁচিলের ওপর থেকে বারে-বারে ফিরে চায়। না মেনির, না কালোর, কারুরই গায়ের গন্ধ পাচ্ছে না সে এতটুকু। এইবার হুলোটা পাঁচিলের ওপর থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল এসে বাচ্চা দুটোর ওপর। এই বুঝি সব শেষ হল আজ।

কিন্তু না। কোথায় ছিল কালো কে জানে, ছুটে এসে হামলে পড়ে হুলো বিড়ালের ঘাড়ে। মেনির কপাল মন্দ। কোলাহল শুনে দৌড়ে এলেও হুড়োহুড়িটা দেখার সুযোগ ঘটল না তার। ততক্ষণে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছে হুলো।

ছানা দুটো তখনও উটের মতো কুঁজো হয়ে রয়েছে। পুঁচকে-পুঁচকে লেজ দুটো সেঁধিয়ে গেছে তাদের পেটের ভেতর। দুই জোড়া নীল চোখ ভয়ে কাঁপছে তির-তির করে, মাকে দেখে ওরা ছুটে এসে তাকে গোত্তা মেরে মাটিতে ফেলে হামলে পড়ল তার পেটের ওপর। মেনিটা তখন ভরাট দুটি চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে কালোর মুখের দিকে। কালোটাও আস্তে-আস্তে তার কাছে বসে পড়ে একটা পা বাড়িয়ে মেনিকে আদর করে সোহাগ ভরে ডাক ছাড়ল। যেন বলতে চায়, ভয়টা কিসের ? আমি আছি না, তোমার দোসর!

বন্ধুর উপকারের প্রতিদান দেবার সময় এল একদিন। নিঃঝুম দুপুরবেলা। খাওয়া-দাওয়া সেরে ভাতঘুম দিচ্ছিল কালো, জলের ট্যাংকের উপরে শুয়ে। মেনি-মাও তার পেটের তলায় ছানা দুটোকে নিয়ে সিঁড়ি ঘরের ভেতরে গভীর ঘুমে বেহুঁশ। টগর গাছের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসেছিল হুলোটা। প্রতিশোধ নেবার এমন একটা সুযোগের সদ্ব্যবহার না করার কোনো মানেই হয় না। গাছের আড়াল থেকে হুলোটা ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘুমন্ত কালোর ওপরে। দাঁত দিয়ে তার টুঁটি কামড়ে ধরে চার পা দিয়ে খামচাতে লাগলো তার চওড়া বুকে। আচমকা আক্রমণে অসহায় হয়ে আর্ত চিৎকার জুড়ল কালো।

বন্ধুর আর্তনাদ শুনে মেনিটা তখন সিঁড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে লাফিয়ে পড়ল হুলোর গায়ে। হিংস্র বিড়ালিনী বুঝি বাঘিনীর চেয়েও ভয়ঙ্কর।

একদিকে মেনি আর কালো, দুই দোসরে একসঙ্গে, অপরদিকে দুষ্টু হুলোটা একা। লড়াইটা আর জমবে কেমন করে!

তবুও পালিয়ে যেতে-যেতে আচমকা ফিরে এসে হুলোটা মরণ কামড় দিয়ে গেল মেনি বেড়ালটাকে। তারপর চোখের নিমেষে পগারপার।

মেনির মাথাটা কাত হয়ে পড়ে আছে। থেকে-থেকে কেঁপে উঠছে তার দেহটা। খানিক বাদেই সব শেষ।

বন্ধুর শোকে কাতর, কালো তখন আকাশের দিকে মুখ তুলে, ডাক ছেড়ে কাঁদতে বসল। একদিন সে মেনিটার সামান্য একটু উপকার করেছিল বলে এমনি করে নিজের জীবন দিয়ে বন্ধু তার প্রতিদান দিয়ে গেল। এই ব্যাপারটা মেনে নিতে ভারি কষ্ট হচ্ছে তার।

একদিন আচমকা মরে গিয়েছিল কালোর মা। মা নেই, এই বোধটুকুও জন্মায়নি তখন তার। কালো কিন্তু সেদিন অনাথ হয়ে যায়নি। অনাথ হল না মেনির ছানাদুটিও। দুধভাতে বেঁচে রইল তারা, মহাসুখে আর ফুর্তিতে। এমন মানুষ-মা রয়েছে যাদের মাথার ওপর।

শরতের একখানা মিষ্টি সকাল। আকাশ ফুঁড়ে সূর্য উঠেছে, চারদিকে খুশির আলো ছড়িয়ে দিয়ে। বাগান-ছায়া ঘন সবুজ জাজিমের উপর গোলাপ-গাঁদা-টগর-জবার ঠাস বুনোট। রঙিন প্রজাপতি আর দুষ্টু ফড়িংদের নাচন-কোদন শুরু হয়ে গেছে সারা বাগানজুড়ে। গাছের পাতায়-পাতায়, ফুলে-ফুলে, শাখায়-শাখায় নতুন শরতের খুশিয়ালি।

হঠাৎ মুঠো-মুঠো মিঠে বাতাস এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিল কালোর। ঘুম ভাঙিয়েছে বিচ্ছু দুটোরও, যারা তখন কালোর পেট ধামসে তার গায়ের ওম পোহাচ্ছিল। ঘুম ভাঙতেই দেখা গেল হুড়োহুড়ি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল তিন তলায়।

না-না, যুদ্ধ নয়, সাদা-কালোয় বিচিত্র সে এক চোর-পুলিশের খেলা।

আকাশের শালিক, চড়াই, দোয়েল, কোয়েলরা দলবেঁধে বেড়াতে এসেছে। খোলা বাগানে। তাদের সমবেত কলগুঞ্জনে আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে উঠেছে। হঠাৎ করে এমন একটা খেলা শুরু হয়ে যেত তাদের মনেও নতুন খুশির মাতন লাগল যেন। বাগান জুড়ে রঙিন পাখিদের লাফালাফি আর ঝাঁপাঝাঁপির অন্ত রইল না।

একদিন নিজের জীবন  উৎসর্গ করে কালোকে বাঁচিয়ে গিয়েছে যে বন্ধুটা, এমনি করেই তার প্রতিদান দিয়ে চলেছে কালো। যত দিন না ছানাগুলো বড়ো হয়ে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে, ততদিন ওর যেন ঋণ মুক্তি ঘটছে না।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৭

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ