![]() |
সেদিন স্কুলে ঘটে গেল এক লঙ্কাকাণ্ড। হেডস্যার নবম শ্রেণির লাস্ট বয় বাবলুকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সে নাকি এক মহা অপরাধ করে ফেলেছে। বিদ্যালয়ের ক্লাসে-ক্লাসে আলোচিত হচ্ছে একটাই কথা- বাবলু যা করেছে এমন কাজ করার সাহস নাকি এর আগে কেউ দেখায়নি। বাবলুর কপালে যে কি আছে, কে জানে!
বাবলু এমনিতে খুব খারাপ ছেলে নয়। সব বিষয়ে মাঝারি মানের নম্বর পেয়ে পাশ করতে করতে নবম শ্রেণি অব্দি আসতে পেরেছে। তবে একটি বিষয় বাবলু কখনোই তিরিশের উপর নম্বর পায় না। তা হল ইতিহাস। দেশের ইতিহাস যেমন, তেমন বিদেশের ইতিহাসের অধ্যায়গুলোও সামনে এলে বাবলুর গায়ে জ্বর আসে। কিছুতেই রাজরাজাদের খটোমটো নাম আর সন-তারিখ মনে রাখতে পারে না। বাবলু ভাবে, আচ্ছা, ওই সব বিদঘুটে নামের রাজা-মহারাজা আর সন-তারিখ মনে না রাখলে ইতিহাস পড়া কি অশুদ্ধ হয়ে যাবে? বাবলু কাউকে বোঝাতে পারে না তার মনের কথা। ঘরে হোক বা বাইরে, সকলের একটাই কথা, হ্যাঁ, যেমন করে হোক মুখস্থ করতেই হবে। বাবলুর রাগ মায়ের উপরও। কেননা, মা-ই তো ইতিহাসটা দেখে আর পড়া মুখস্ত করানোর জন্য চাপ দেয়। আচ্ছা ইতিহাস যদি বাবলু পর মুখস্থ করতে না পারে সেটা কি বাবলুর দোষ! ইতিহাসটাই মহা পাজি, মুখস্থ হতেই চায় না। কেন, রাজরাজা ও জায়গার নাম সহজ-সরল হলে কি ইতিহাসের জাত যেত? বাবলু এসব খুব ভাবে আর মনে মনে ভীষণ রেগে যায় ইতিহাসের উপর। আর যারা ইতিহাস পড়ায় তাদের ওপর। এই রাগ নিয়েই সেদিন স্কুলে ঘটে গেছে এক লঙ্কাকাণ্ড। আর তারই প্রতিক্রিয়া, বাবলুকে হেডস্যারের ঘরে ডাক। ক্লাসের অন্য ছেলেরা তো ভয়ে থরথর। আজ বাবলুর কপালে ভীষণ দুঃখ আছে। বাবলু পড়াশোনায় আহামরি না হলেও বাবলুকে সকলেই ভালোবাসে। কারণ পড়াশোনা ছাড়া বাবলু আর সব বিষয়ে চৌখস। অন্যের খুচখাচ উপকার করতে বাবলু সব সময় হাজির। শিক্ষকদের টুকটাক কাজ করে দিতে পারলে বাবলুর চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হয় না। তা এমন ছেলে বাবলু কি এমন কাণ্ড ঘটাল যে, হেডস্যার তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন?
ঘটনাটা এই রকম। ইতিহাস স্যার সুবলবাবু ক্লাসে এসেছেন, পড়া ধরছেন প্রত্যেক ছাত্রকে। স্যার জানেন- বাবলু ইতিহাসে মোটেই ভালো নয়। তবুও বেছে বেছে স্যার বাবলুকেই বেশি প্রশ্ন করেন। এতে বাবলুর খুব রাগ হয়। আসলে বাবলু প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না, এতে স্যার সম্ভবত খুব মজা পান, কেননা বাবলুকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা যায়। ক্লাসে হাসির রোল ওঠে। এটা এখন নিত্যদিনের ঘটনা।
তা সেদিন হল কী, স্যার এক এক করে সন তারিখ সহ বিদঘুটে সব প্রশ্নবাণ ছুঁড়ে যাচ্ছেন বাবলুর দিকে। বাবলু কোনো উত্তর দিতে পারছে না। মাথা নিচু করে আছে। স্যার যেই পাঁচ নম্বর প্রশ্নটি করতে যাবেন, অমনি বাবলু এক কাণ্ড করে বসল। বাবলু বসবার জায়গা ছেড়ে উঠে এসে সোজা স্যারের টেবিলের সামনে। ইতিহাস বইটি টেবিলের উপর খোলা ছিল। বাবলু প্রথমে স্যারের দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে টেবিল থেকে ইতিহাস বইটি নিয়ে স্যারকে প্রশ্ন করে বসল- স্যার, এবার আমি প্রশ্ন করি, আপনি উত্তর দিন তো! স্যার তো হতভম্ব! স্যারকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পরপর চার পাঁচটি প্রশ্ন করে বসল, বই দেখে। অবাক কান্ড একটা প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারলেন না। সারা ক্লাস বাবলুর কাণ্ড দেখে একেবারে থ!
বাবলু বলে চলল- স্যার আপনি তো দশ পনের বছর ধরে এই একই ইতিহাস পড়িয়ে আসছেন। আপনার তো বইয়ের প্রতিটি লাইন মুখস্থ হয়ে যাবার কথা। অথচ আমি এইমাত্র চার পাঁচটি প্রশ্ন করলাম আপনি একটিরও উত্তর দিতে পারলেন না। চিরকাল তো চেয়ারে বসে সামনে বই খোলা রেখে লাইন বাই লাইন পড়ে শোনালেন। কোনোদিন তো দেখলাম না আপনি বই বন্ধ করে আমাদের পড়াচ্ছেন! তাহলে ভাবুন এত বছরেও আপনি একটা ইতিহাস বই আত্মস্থ করতে পারলেন না। তাহলে আপনি কি করে আশা করেন আমরা মাত্র একদিন পরেই সবকিছু পটাপট উত্তর দেব?
এবার বাবলু থামল। বলতে বলতে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। স্যার একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন বাবলুর দিকে। এই বাবলু স্যারের চেনা নয়। একটা গোবেচারা মধ্যমানের ছেলে যে এতটা বিদ্রোহ করতে পারে স্যারের এই ধারণাই ছিল না।
বাবলুর কাণ্ডের কথা ক্লাস রুম ছেড়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ল। পৌঁছে গেল হেডস্যারের কাছে। হেডস্যার ডেকে পাঠিয়েছেন বাবলুকে। হেডস্যার বাবলুকে বললেন, যা শুনলাম সব সত্যি? বাবলু বলল, হ্যাঁ স্যার। হেডস্যার বললেন, এবার তুই নিজেই বল, তুই যেটা করেছিস সেটা ন্যায় না অন্যায়?
-আমি জানি, আমি যেটা করেছি, সেটা ঠিক হয়নি। উনি আমার স্যার। উনি আমার গুরুজন। কিন্তু দিনের পর দিন অন্যদের সামনে আমাকে ছোটো করে দেখানো আমাকে অসহিষ্ণু করে তুলেছে। স্যার তো জানেন, আমার স্মৃতিশক্তি খুব ভালো নয়। তবুও স্বীকার করছি- আমার অন্যায় হয়েছে। আমাকে আপনি যা শাস্তি দিন, মাথা পেতে নেব।
ইতিহাস স্যার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। হেডস্যার তাঁকে বললেন, কি এবার আপনি বলুন বাবলুকে কি শাস্তি দেওয়া যায়?
সুবলবাবু বললেন- থাক, ওকে শাস্তি দিতে হবে না। ভুল তো আমারই। আমি তো ওদের ভালো মতো ইতিহাস বোঝাতে পারিনি। বাবলু তো ঠিকই বলেছে। আসলে আমি এতদিন ইতিহাস বইটাকে বাইরে থেকে দেখেছি, কোনোদিন ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করিনি। বাবলু আমার চোখ খুলে দিয়েছে। দেখা যাক, কাল থেকে আমি বাবলুর চোখে আদর্শ শিক্ষক হতে পারি কি না!
পরদিন ইতিহাস স্যার ক্লাসে এলেন। বসলেন চেয়ারে। শুরু করলেন মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ। ক্লাসের একটি ভালো ছেলে বলল- স্যার, আজ বই চাইলেন না যে? স্যার বললেন, আজ যে আমি তোদের মতোই বাড়িতে পড়াশুনা করে এসেছি। আমার আর বই লাগবে না।
স্যার আজ মোঘল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ এত সুন্দরভাবে বোঝালেন যে, ছাত্ররা নিঃশব্দে স্যারের কথা শুনল। স্যারের এহেন পরিবর্তন সকলকে অবাক করে দিল। দিন কয়েকের মধ্যেই প্রচার হয়ে গেল, সুবলস্যার ইতিহাস দারুন পড়ান। ওনার পড়ানো একবার শুনলেই অধিকাংশ পড়া ক্লাসেই হয়ে যায়। না এরপর আর বাবলুর ইতিহাস পাস করতে অসুবিধা হয়নি।
কুড়ি বছর পর, সুবলস্যার অবসর
নিয়েছেন কর্মজীবন থেকে। তখন তার অফুরন্ত অবসর স্কুলে যাওয়া নেই একদিন তিনি বাজার
থেকে বাড়ি ফিরেছেন। হঠাৎ একটি যুবক এসে তাকে প্রণাম করল। স্যার আমাকে চিনতে
পারলেন না? আমি সেই বাবলু।
স্যার হাতের ব্যাগটা রেখে বাবলুকে জড়িয়ে ধরে বললেন- কি করছিস এখন? বাবলু বলল,
স্যার, আমিতো এখন স্কুলের শিক্ষক। ইতিহাস পড়াই। আপনি
এত সুন্দর ইতিহাস পড়াতেন। আপনার জন্যই আমি ইতিহাসকে ভালোবেসে ফেললাম। আমি বুঝেছি
স্যার, ইতিহাস মোটেই
নিরস নয়।
বাবলুর কথা শুনে সুবলস্যার স্মৃতির বাজারে ডুব দিলেন। মনে পড়ে গেল সব কথা। বাবলুর জন্যই তিনি আদর্শ শিক্ষক হতে পেরেছিলেন। বাবলুই তাঁর ভালো শিক্ষক হওয়ার সলতেটা জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
স্যারের চোখে জল। বাবলু বলল, চলুন স্যার, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।
পাশাপাশি চলছেন দুই শিক্ষক। একজন প্রবীণ, একজন নবীন। প্রবীণের হাত ধরে নবীনের এই পথ চলা- এরই নাম ইতিহাস।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ফেব্রুয়ারি ২০১৩
0 মন্তব্যসমূহ