Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

ওস্তাদের মার শেষ রাতে ।। ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়


শিয়ালদা স্টেশনে ঘন ঘন ঘোষণা হচ্ছে ২৩৪৩নং আপ শিয়ালদা নিউজলপাইগুড়ি দার্জিলিং মেল ১১ নং প্ল্যাটফর্ম থেকে দশটা পাঁচ মিনিটে ছাড়বে।

স্টেশনে ওস্তাদই কালুকে পৌঁছে দিতে এসেছিল। হাজার হোক প্রথম দিন বলে কথা। ছ-মাস ধরে ট্রেনিং নিয়েছে কালু এই কাজে। কাজটা যে খুব গুরুত্বপূর্ণ তাতে সন্দেহ নেই। সহযাত্রীর সঙ্গে ভাব জমিয়ে তাকে মাদক মেশানো বিস্কুট খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে হবে। তারপর তার স্যুটকেসটি নিয়ে মাঝ পথে নেমে যেতে হবে।

এ পর্যন্ত গত ছ-মাসে এ লাইনে অন্তত পাঁচবার ওস্তাদের সহকারীর কাজ করেছে। ওস্তাদ স্যুটকেস নিয়ে প্লাটফর্মে নেমে তার হাতে স্যুটকেস তুলে দিয়েছে। সে ভোরের বাস ধরে সেটা কলকাতায় ডেরায় এনে তুলেছে। কিন্তু নিজের হাতে কাজ করা এই প্রথম।

ট্রেন ছাড়তে আর মিনিট পনের বাকি। ওস্তাদ বলল, তুই উঠে যা এবার। আমি অন্য কামরায় যাচ্ছি। মালদা স্টেশনে আবার দেখা হবে। স্যুটকেসটি আমার হাতে দিয়ে তুই স্টেশনেই শুয়ে থাকবি। ভোরের ট্রেন ধরে কলকাতায় ফিরবি। আর আমি কি করব বল তো?

কালু বলল, এতদিন আমি যা করেছি তাই। তুমি বাস ধরে কলকাতায় চলে আসবে। যেমন আমি আাসতাম।

-হ্যাঁ ঠিক তাই। আজ থেকে তুই-ই লাইনের ভার নিবি। এরপর তোকে অন্য লাইনে পাঠাব। এক লাইনে বেশিদিন আমি কাউকে রাখি না। মন দিয়ে কাজ করতে পারলে একদিন তুই আমার চেয়ে বড়ো ওস্তাদ হবি। তখন তোকে বম্বে পাঠিয়ে দেব। কে জানে একদিন তুই বোম্বের বড়ো ডন হয়ে উঠতে পারিস!

-ডন কী ওস্তাদ? মানে ডন বৈঠক দিতে হবে নাকি?

-আরে না রে না। ডন মানে হল তুই হবি গ্যাং মাস্টার। তখন তুই বম্বে বা দুবাই বসে থাকবি তোর লোকেরা রোজ কোটি কোটি টাকা কামাবে। তোর মধ্যে ডন হবার সব গুণ আছে। তুই পারবি।

কালু কি ভাবল কে জানে। তারপর বলল, সে সব পরের কথা। আমায় আশীর্বাদ করো ওস্তাদ। প্রথম দিনটা যেন ভালোভাবে উতরে যাই। তোমার হাতে যেন ভালো মাল তুলে দিতে পারি।

ওস্তাদ তার কাঁধে চাপড় দিয়ে বলল, পারবি-পারবি। এখন ট্রেনে উঠে তোর জায়গায় বসে পড়। সামনে শাঁসালো প্যাসেঞ্জার পাস তো ভালো। নয় তো আবার পরের সিটে গিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে ভাব জমাতে হবে। সেটা কিভাবে করতে হয় বলে দিয়েছি, মনে আছে তো?

-হ্যাঁ-হ্যাঁ। আমি গিয়ে বলব, আমার লোয়ার বার্থ আছে। আপনারা কেউ আমার সঙ্গে চেঞ্জ করতে পারেন। আপার বার্থ ছাড়া আমার ঘুম হয় না।

-ঠিক। দেখবি আপার বার্থের প্যাসেঞ্জাররা এক কথায় রাজি হয়ে যাবে। এইবার সেই প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে ভাব জমাবি, তারপর তাকে খাবার খাওয়াবি। কাজুর প্যাকেটগুলো নিয়েছিস তো?

-চার প্যাকেট নিয়েছি।

-ওতেই হবে।

কালু একদিন ভাবত, সে সিনেমা স্টার হবে। কখনো ভাবত ক্রিকেট খেলোয়াড় হবে। কিন্তু পড়াশোনায় বেশি দূর এগোতে পারেনি বলে শেষ পর্যন্ত ওস্তাদের পাল্লায় পড়ে স্যুটকেস ছিনতাইবাজ হয়েছে। তবে এই কাজের মধ্যে যেমন টাকা আছে তেমনি রোমাঞ্চ আছে। লেখাপড়ার মতো অনেক খতরনক জিনিস দুনিয়ায় আর কিছু আছে নাকি!

কালুর অনেক কষ্টে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে ছিল। ভাগ্যিস তাদের স্কুলে পাশ ফেল ছিল না। একেবারে ননস্টপ দুরন্ত এক্সপ্রেস। কোথাও না থেমে সে ক্লাস এইট পর্যন্ত উঠেছে। কিন্তু সে বুঝে গিয়েছিল সে কোনোরকমে নামটা সই করতে পারে। আরও দু'বছর পড়ে পুরো টুকে মাধ্যমিক পাস করতে পারে। টোকাটুকিতে তার বিকল্প কেউ নেই। কিন্তু তার আর পড়ার ধৈর্য্য নেই। তাই সে ও লাইনে আর এগোয়নি। ক্লাস এইটে কালু সব লিখিত পরীক্ষাতেই দশ-এর বেশি পেল না, ওদিকে সরকারি নির্দেশ- সব ছাত্রছাত্রী ক্লাস নাইনে তুলতেই হবে। হেডমাস্টার কালুকে বললেন, তোমায় আর লিখিত পরীক্ষা দিতে হবে না। তোমার জন্য একটা মুখে মুখে পরীক্ষা নিচ্ছি। আমাদের একটা রেকর্ড রাখতে হবে তো।

কালু বলল, এখন আর রেকর্ড নেই স্যার, এখন সিডির যুগ।

হেডমাস্টার মহাশয় বললেন, ঠিক আছে, রেকর্ড যখন নেই, তখন সিডিই রাখছি। আচ্ছা বল তো কালু, শের শাহ কাকে হারিয়ে দিল্লির গদির দখল নিয়েছিলেন?

কালু মাথা চুলকে বলল, টিমটার নাম মনে পড়ছে না স্যার।

ক্লাস শুদ্ধু ছেলেরা হো-হো করে  হেসে উঠল।

হেডমাস্টার মশাই কালুর বাবাকে জানালেন, কালুকে ক্লাস নাইনে তোলা যাবে না। ক্লাস এইট-এর বিদ্যাই তার যথেষ্ট।

বাড়িতে ফিরে বাবাকে রেজাল্ট দেখাতে বাবা এবার এমন একটা চড় মারলেন কালুকে, যে কালু ছিটকে পড়তে-পড়তে দেওয়াল ধরে কোনোক্রমে রক্ষা পেল। বাবা আবার তেড়ে আসছেন দেখে কালু একেবারে একছুটে বাড়ির দরজা পেরিয়ে সোজা রাস্তায়। রাস্তায় নেমে ছুটতে ছুটতে রেল স্টেশন। স্টেশনে বারোটা পাঁচের শিয়ালদা লোকাল দাঁড়িয়েছিল। তাতে উঠে পড়ল সে।

সেটা ছিল ডাউন শিয়ালদা লোকাল। ঠাসা ভিড়। কিন্তু দত্তপুকুর স্টেশন আসতেই ভিড় পাতলা। যারা দাঁড়িয়ে ঝুলছিল মুহূর্তের মধ্যে তারা বেপাত্তা, কালু শুধু একটা কথা শুনল, সবাই বলছে, চেতনা-চেতনা।

এ লাইনে খুব কম লোকই টিকিট কাটে। সবাই ২৯দিন বিনা টিকিটেই যায়। অনেকের মান্থলি আছে বিধান নগর টু শিয়ালদা। খাপের মধ্যে থাকে- কোথা থেকে কাটা কে আর দেখছে। কিন্তু চেতনা মানে হল স্পেশাল চেকিং। পুলিশ টিটির বিরাট বাহিনী। সঙ্গে এক জন করে ম্যাজিস্ট্রেট। ধরা পড়লে ৫০০টাকা ফাইন। নয়তো জেলখাটা। উইথ আউট টিকিটের যারা, তারা সঙ্গে একটা ৫০০টাকার নোট রেখে দেয়। ধরা পড়ার চান্স বছরে হয়তো একবার।

কিছু ভাববার আগেই একজন চেকার এসে কালুকে বলল, টিকিট!

কালু টিকিট দেখাতে পারল না। তার পকেটে একটা পয়সাও নেই। সে হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই চলে এসেছে। অতএব তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে হাজির করা হল। তার ফাইন হল সাড়ে চারশো টাকা, অনাদায়ে তিন দিনের জেল। কালু জেলেই গেল।

জেলে গিয়ে কালুর মনে হল, ভালোই হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে মুড়ি আর চা এসে গেল। দেখল জেলের ভিতর একটা বিরাট হলঘর। সেখানে শ-দুয়েক লোক বসে গুলতানি করছে। যেন শিয়ালদা প্ল্যাটফর্ম। একজন গাট্টাগোট্টা লোক এসে বলল, এই খোকা তোর কি বিষয়ে? কালু ভাবল বুঝি ক্লাসে পড়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করছে, সে বলল, ইংলিশ, হিস্ট্রি, জিওগ্রাফি আরো কত কি আছে। আমার অতো মনে থাকে না।

লোকটি হেসে বলল, আরে তোকে পড়ার খবর কে জিজ্ঞাসা করেছে! কত সেকশনের আসামি? চুরি না পকেটমারি?

-না-না, আমি চুরি টুরি করি না। উইথ আউট টিকিটে যাচ্ছিলাম।

-বাড়িতে খবর দিসনি? তোর বাবা-মা কেউ নেই?

-আছে। আমি আর  বাড়ি ফিরতে চাই না।

-কেন রে? তোর তো আর আমার মতো কেস নয়। আমি দুটো খুন করেছি। সাত বছর আছি। আর তিন বছর বাকি আছে। তোর মেয়াদ তো বড়ো জোর তিন দিন।

-তিন দিন মাত্তর?

-কেন, তোর কি এখানে থাকতে ভালো লাগছে?

-তা খারাপ কি! দুবেলা খেতে দেয়। টিভিও আছে। কত লোক, গুলতানি করা যায়। আর সব থেকে বড়ো কথা পড়তে হয় না। পরীক্ষা দিতে হয় না।

-তোর পড়তে ইচ্ছা করে না?

-একদম না। বাবা জোর করে পড়াবে। আর আমি পড়ব না।

লোকটি বলল, জেল থেকে বেরিয়ে তাহলে বাড়ি ফিরে যাবি?

-কখনো না।

-তাহলে কি করবি?

-এখনো বলতে পারছি না। শিয়ালদা স্টেশনে গিয়ে মোট বইব। কুলির কাজ করব সেও ভালো।

-ধ্যুৎ, সেখানে কুলিদের ইউনিয়ন আছে। বাইরের লোককে ঢুকতেই দেবে না। তাছাড়া কুলিদের আয় কমে গেছে। চাকাওয়ালা স্যুটকেস হয়ে গিয়ে।

-তাহলে ভাবছি সিনেমা করব। পড়াশুনো ছেড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে অনেকে হিরো হয়েছে।

-আরে বোকা, তোর এই কাংলা চেহারায় তোকে কে হিরোর পার্টে নেবে! আজকাল হিরোদেরও ফরফর করে ইংরেজি বলতে হয়। তুই ইংরেজি জানিস? বল তো, ভেরি গুড ভেরি গুড মেম ইটস বিস্কুট, মানে কি?

-মানে?

কালু অম্লানবদনে বলল, মানে, মেম সাহেব একটা বিস্কুট ইঁটের চেয়ে শক্ত তা কি তুমি জানো?

লোকটি বলল, তুই দেখছি ইংরেজিতে ইঁটের মতোই শক্ত। আরে বুদ্ধু এর মানে হল, বিস্কুট খাওয়া খুব ভালো। সেজন্য মেম সাহেবরা বিস্কুট খায়। তুই কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছিস?

-এইট।

-আমি ক্লাস ফোর পর্যন্ত উঠে পড়া ছেড়েছি। তোর চেয়ে বেশি ইংরেজি জানি। সেন সাহেবের গাড়ি চালাতে চালাতে সেন সাহেব আর তাঁর মেয়ের মধ্যে ইংরেজির কথা শুনে শুনে ইংরেজি শিখেছি।

-গাড়ি চালাতে তো, এই জেলখানায় এলে কেন?

-ওই যে বললাম না, মার্ডার কেস।

-মানে খুন?

-হ্যাঁ, তাহলে আর বলছি কি? জেলের ভিতর খুনিদের সবচেয়ে বড়ো প্রেস্টিজ। প্রেস্টিজ মানে জানিস?

-জানি। কুকারের নাম। প্রেস্টিজ কুকারে মা রান্না করে।

হো হো করে হেসে লোকটি বলল, তুই বড়ো মজার ছোকরা আছিস! তোকে দিয়েই হবে।

-কি হবে?

-আমার সাকরেদ ইদ্রিসের কাছে তোকে পাঠাব। ওর সঙ্গে আমার রোজ মোবাইলে কথা হয়। আমি যে গ্যারেজে সেন সাহেবের মোটর সার্ভিস করাতাম। ইদ্রিস সেখানকার হেলপার ছিল। এখন সে টানা কাজ করে।

-টানা কাজ মানে?

-ট্রেনের প্যাসেঞ্জারদের মাল হাফিজ করে দেয়। এখন তার কারবার খুব বড়ো হয়েছে। এ লাইনে ভালো চটপটে কারিগর পাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে তাই রোজ বলে, ওস্তাদ তোমার ওখানে তো ভালো ভালো কারিগর আছে। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ভালো কাম কাজ করতে ইচ্ছুক ছেলে পেলে খবর দিও। বাঙালির ছেলেরা মোটেই এ লাইনে আসতে চায় না। বলে বড় রিস্ক।

পরপর দু-দিন ধরে লোকটি কালুকে জপালো। ঠিকানা দিয়ে দিল। ৩৭নং চিৎপুর বস্তি। ইদ্রিস মিঞাঁর নাম বললে, সবাই দেখিয়ে দেবে। তাকে গিয়ে বলবি, কর্মকার পাঠিয়েছে।

-তোমার নাম কর্মকার?

-হ্যাঁ, বাচ্চু কর্মকার।

-তা বাচ্চুদা, তুমি যে খুনি দেখে তো মনে হয় না।

-আরে খুনিদের গায়ে কি লেখা থাকে? আর আমি তো খুনী হয়ে জন্মাইনি। সেন সাহেব আমাকে মিথ্যে অপবাদ দিতেন, আমি নাকি তেল চুরি করি। আমি কসম খেয়ে অনেকবার বলেছি, সাহেব আমি গরিব হতে পারি কিন্তু চোর নই। কিন্তু সাহেব তা শুনতেন না। একদিন রেগেমেগে গাড়ি স্টাটার দিয়ে সাহেবের মাথায় টুক করে একটু মারতেই সাহেব একেবারে অক্কা পেয়ে গেলেন। আর আমিও মক্কায় চলে এলাম। তা এখানে না এলে কি এত প্রেস্টিজ পেতাম! কোনো ভাবনা চিন্তা নেই, খাচ্ছি-দাচ্ছি, তোফা ফুর্তিতে আছি। জেলর পর্যন্ত আমায় খাতির করে। তুই যদি ইদ্রিস-এর সঙ্গে কাজে লেগে যাস তাহলে হয়তো আবার এখানে আসতে হতে পারে। তখন আরো বেশি দিন থাকতে পারবি। তবে আমি আর তিন বছর আছি। আসলে তার মধ্যে আসতে হবে।

কালু জেল থেকে বেরিয়ে ইদ্রিস-এর সঙ্গে দেখা করেছে। তার চেহারার দিকে তাকিয়ে ইদ্রিস বলেছিল, তুই কি পারবি? বহুৎ রিস্কি কাজ।

কালু বলেছিল, পড়াশোনা ছাড়া যা বলবে তাই পারব। পড়াশোনাটা আমার একদম মনে থাকে না। আমাকে আমার নাম লিখতে বল, কল্লোল লিখতেই বানানে ভুল হবে। তাই কালু নামটি সব জায়গায় লিখি।

-শোন তোর এই কাজে তোকে লিখতেও হবে না পড়তেও হবে না, শুধু কথা বলতে হবে। তোকে ট্রেনের টিকিট কেটে দেব। প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে ভাব জমাতে হবে। তারপর তাকে ওষুধ মেশানো বিস্কুট অথবা কাজু বাদাম খেতে দিবি। একটা খেলেই যথেষ্ট। রাতে অঘোরে ঘুমিয়ে থাকবে। তখন তার স্যুটকেস নিয়ে পরের স্টেশনে নেমে যাবি। আমার লোক তোর জন্য অপেক্ষা করবে। যে লোক তোর সঙ্গে দেখা করবে তাকে স্যুটকেসটা দিয়ে দিবি। পরদিন যে কোনো ট্রেন ধরে তুই কলকাতায় চলে আসবি। স্যুটকেসে যা পাওয়া যাবে তার তিনভাগের একভাগ তোর। কি, শুনে কেমন লাগছে?

-দারুণ। মার্ভেলাস।

-তার মানেটা কি?

-মার্বেল খেলার চেয়েও সোজা কাজ। কবে থেকে জয়েন করব? আর থাকব কোথায়? আমার কিন্তু থাকার জায়গা নেই। পকেট গড়ের মাঠ। আর পেটের ভেতর সত্তর-আশিটা ছুঁচো ডন মারছে।

ইদ্রিস বলল, তোর পেটের ছুঁচোরা ছুঁচ হয়ে যেমন ঢুকেছে তেমনি ফাল হয়ে বেরিয়ে যাবে। এই বলে 'আনোয়ার-আনোয়ার' বলে হাঁক পাড়তেই এক বুড়ো মতো লোক এসে দাঁড়াল। তাকে বলল, একে আগে খিলাও। তারপর ওকে আচ্ছাসে পড়াও।

কালু বলল, মানে এখানেও আবার পড়াশোনার ব্যাপার আছে নাকি?

- না, পড়াও মানে ট্রেনিং। হাতে কলমে ট্রেনিং হবে তোমার।

দার্জিলিং মেলের নাম শুনে এসেছে কালু। কিন্তু চোখে দেখেনি। এখন তো সে সেই স্বপ্নের ট্রেনে উঠেছে। ভেতরটা কি ঠাণ্ডা। আর কি সুন্দর গদি পাতা। সিটু কামরায় তার বার্থ পড়েছে ৩৫নং-এ। দু-পাশে বোঝাই যাত্রী। পরিবার নিয়ে ছুটিতে দার্জিলিং বেড়াতে চলেছে। কেউবা একা চলেছে অফিসের কাজে। অনেক ব্যবসায়ী কাজ সেরে শিলিগুড়ি ফিরছে।

ওস্তাদ ইদ্রিস তাকে শার্ট-প্যান্ট-টাই কিনে দিয়েছে। ভালো করে দাড়ি কামিয়ে নিয়েছে। ইদ্রিস তাকে চাকা দেওয়া একটা স্যুটকেসও কিনে দিয়েছে। তাতে তার আর এক সেট পোশাক আছে। মালদা স্টেশনে সেটা পড়বে। আছে কিছু টাকাও। ফেরার টিকিট কাটতে হবে প্রথম দিন বলে ইদ্রিস নিজেই যাচ্ছে মালদা পর্যন্ত।

ইদ্রিস বলে দিয়েছে মহিলাদের সঙ্গে মাসীমা বলে আলাপ জমাতে হবে। তারা যদি কিছু খেতে দেয় বিশ্বাস জমাবার জন্য খেতেও হবে। তারপর সেই ওষুধ মেশানো কাজুর প্যাকেট বার করতে হবে। সবাইকে বলতে হবে যে, শিলিগুড়ি যাচ্ছে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে।

আহা কি ভাগ্যি! মেঘ না চাইতেই জল। সামনের সিটে এক ফ্যামিলি। এক তরুণ ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা। তার সিটের নিচে দুটো নতুন স্যুটকেস। তার ওপরের বার্থে একটি অল্প বয়সের ছেলে। ছেলেটি তেমন শাঁসালো খদ্দের নয়। তার সামনের বার্থে আর দু-জন। এক মাঝ বয়সী স্বামী-স্ত্রী। তাদের সঙ্গে একটা ভারি ট্রাংক। তাও আবার চেইন দিয়ে বাঁধা। এটা নামানো অসম্ভব। কালু তাক করল, সামনের দম্পতির স্যুটকেস, ভদ্রমহিলার ভ্যানিটি ব্যাগ আর ভদ্রলোকের অ্যাটার্চি দিকে। মনে হচ্ছে ভেতরে ভালো মাল আছে।

আলাপ জমানোর চেষ্টা করল কালু। মাসিমা দার্জিলিং যাচ্ছেন বুঝি?

ভদ্রমহিলা বললেন, হ্যাঁ।

-আমি মালদায় যাচ্ছি। মালদায় আমার একটা ইন্টারভিউ আছে কিনা। কালু বলল।

এবার ভদ্রলোক কালুকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি চাকরি?

কালু একটু ঘাবড়ে গেল? কি চাকরি- সেটা তো সে ভেবে রাখেনি। তবে সে না ঘাবড়ে বলল, অফিসার গ্রেড।

-কোন কোম্পানি?

কোন কোম্পানি- তাও সে ভেবে রাখেনি। সে শুনেছিল মালদা শহরে আমের চাটনি তৈরি হয়। সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, ওই আম কোম্পানি। নাম গীতা ম্যাংগো প্রোডাক্টস। কোম্পানিটা তেমন জুতসই বলে মনে হয় না। খুব বেশি নাম নেই। তবে বেকার বসে আছি পাস করে। হাতের কাছে যা পাই। ৫০০০ দেবে আপাতত।

এই বলে কালু একটা গল্প ফেঁদে বসল। সে বি.এস.সি পাশ করে বেকার বসে আছে। এমন সময় কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত করে চাকরির জন্য। আর ইন্টারভিউ পেয়ে সে ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে সে খুব নার্ভাস ফিল করছে। প্রথমে ইন্টারভিউ তো।

-বাড়িতে কে আছে তোমার? বাড়ি কোথায়?

কালু বলল, নিউ আলিপুর। (এটা ইদ্রিস শিখিয়ে দিয়েছিল। আলিপুর কোথায় তাও জানে না, তার ওপর আবার নিউ আলিপুর।)

-নিউ আলিপুর কোথায়? কোন ব্লগ?

-রোড ব্লক।

কালু কলকাতায় দেখেছিল, একটা রাস্তায় লেখা রোড ব্লক। তাই রোড ব্লক কথাটাই তার মনে এল।

-মানে? ভদ্রলোক অবাক হলেন।

ভদ্রমহিলা বললেন, বোধ হয় '' ব্লকের কথা বলছে। রাস্তাটা অনেক দিন বন্ধ আছে না। বুঝতে পেরেছি '' ব্লকে থাকো। কত নম্বর?

-ফোর টোয়েন্টি।  কালুর জবাব।

এবার হেসে গড়িয়ে পড়লেন ভদ্রমহিলা। তুমি বেশ রসিক তো!

ভদ্রলোক বললেন, তোমার বাবা কি করেন?

কালু বলল, ব্যবসা। বাবার অনেক ব্যবসা আছে। আমি অতশত জানি না। আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই। আর দাঁড়ানোর পর চলতে হবে। চলতে গেলে খেতে হয়। আর খাবার সংস্থান করার জন্যই প্রথম চাকরিটা নিচ্ছি।

ওরা সবাই হেসে উঠল।

-এবার বলুন মেসোমশাই আপনাদের খবর। আপনাদের সঙ্গে বেশি মালপত্র তো দেখছি না।

-আমরা এই দুটো স্যুটকেস নিয়ে যাচ্ছি। আসলে আমরা যাচ্ছি একটা বিয়েবাড়ি। তাই মালপত্র একটু কমই নিলাম। নতুন বউয়ের শাড়ি আর ক-টা গহনা শুধু আছে।

কালুর মনে মনে খুব উৎফুল্ল হলাম।

-তা রাতে চেন দিয়ে বেঁধে রাখবেন। চোরের উপদ্রব, কালু বলল।

-না-না, এলাইনে সে সব ভয় নেই। ভদ্রলোকই বললেন আর আমাদের সঙ্গে চেনও নেই।

-আর আমি তো আছি। আমার আবার ট্রেনে ঘুম হয় না। আমি জেগেই থাকব। আর মালদা আসবে ভোর চারটে নাগাদ।

 এগারোটা নাগাদ কালু উসখুস করতে লাগল। এবার কাজুর প্যাকেট খুললে মন্দ হয় না। এখন না খাওয়ালে এরপর সবাই ঘুমিয়ে পড়বে। আর সে পকেট থেকে কাজুর প্যাকেটটি বার করে বলল, ম্যাডাম আপনি কি কাজু বাদাম খান?

-খুব একটা না।

-আমার বাবা কাজু এক্সপোট করেন বিদেশে। সাহেবরা তো বাবার কাজু খাবার জন্য মুখিয়ে থাকে। আমাদের কাজু গার্ডেন আছে দার্জিলিঙে।

-দার্জিলিংয়ে কাজু? ভদ্রলোক সন্দেহ প্রকাশ করলেন।

-ঠিক দার্জিলিং না, শিলিগুড়ির কাছে। সেখানকার কাজু পৃথিবীর সেরা। ডঃ মনমোহন সিং সকালে ব্রেকফাস্ট সারেন আমাদের কাজু দিয়ে। একটা ট্রাই করে দেখুন আপনারা।

এই বলে কাজুর প্যাকেট ধরে এগিয়ে দিল কালু। দু-জনে নিল। তারপর বলল, আর না, আর না। বাকিটা তুমিই খাও।

-আমি আমার কাজু তো খাবই। আপনারা গেস্ট। আপনারা আগে। কালু বলল।

ভদ্রলোক বললেন, তার আগে একটু চা হয়ে যাক। সুদেষ্ণা একে একটু চা দাও।

-না-না, আমি এখন চা খাই না।

-তা কি হয়, কাজু দিয়ে চা খুব জমবে।

ভদ্রমহিলা বললেন, তুমি আগে খেয়ে নাও। তারপর কাপটা ধুয়ে আমরা খাব। এই বলে কাপে চা ঢেলে এগিয়ে দিলেন ভদ্রমহিলা।

-কিন্তু আপনি কাজু না খেলে আমি চা খাব না  মাসিমা।

-খাব, চায়ের সঙ্গে খাব। তুমি আগে চেখে দেখো আমাদের চা-টা। কাজু দিয়েই চা খাও। খুব কাজে দেবে চা-টা।

একরকম জোর করেই চায়ে চুমুক দেওয়ালেন ভদ্রমহিলা। তারপর তার হাতের কাজু থেকেই খুব আদর করে ওর মুখে ভরে দিলেন কয়েকটা। পরপর দু-টো কাজু।

তারপর? তারপর প্রচণ্ড ঘুম এসে গেল কালুর। আর তার কিছু মনে নেই। কালুর ঘুম ভাঙল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে।

সব যাত্রী হুড়মুড় করে নামছে। তাড়াতাড়ি উঠে কালু তার নিজের স্যুটকেসটি খোঁজ করল। নেই।

সেই ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা যাঁরা তাকে চা খাইয়ে ছিলেন তাঁরাও নেই।

আর একজন যাত্রী তার মালপত্র নিয়ে নামছে। না, তার হাতে সেই বিশাল ট্রাঙ্ক, স্যুটকেস নেই।

কালু ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করল, আমার উপরের বার্থের ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা কোথায় গেলেন জানেন?

-ওই যাত্রী বললেন, রাত চারটে চা খেতে উঠেছিলাম। ওরা তো মালদা নেমে গেলেন। আমি যেন শুনেছিলাম আপনিও মালদা নামবেন। তা কত ডাকলাম, আপনি অঘোরে ঘুমোচ্ছিলেন। আপনাকে আর ডিস্টার্ব করলাম না।

-আমার স্যুটকেস?

-ওই ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলার তো দুটো স্যুটকেস নিয়ে নামলেন। তার একটা হয়তো আপনারই হবে।

-আপনি বাধা দিলেন না?

-এতো অদ্ভুত কথা বলছেন মশাই, আমি কি করে জানব কোনটা কার? আমাকে কি আপনি দেখিয়ে রেখেছিলেন? এই লাইনে স্যুটকেস চোরের কত উপদ্রব জানেন? নিজের মাল নিজে সামলে রাখতে পারেন না? বলিহারি ঘুম, যা হোক!

ভদ্রলোক গজ গজ করতে করতে নেমে গেলেন। কালুর স্যুটকেসটা যে একদম নতুন ছিল। ৩০০০টাকায় কেনা আর ভেতরে নগদ ২০০০টাকা ছিল। বাস ভাড়ার টাকা।

 

অলংকরণ- রাহুল মজুমদার

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২০

Topic : Best Social story in Bengali, সামাজিক গল্প


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ