Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

সিংহবাহিনী ।। দেবদুলাল কুণ্ডু


 

পিওর সাইন্সের স্টুডেন্ট অয়ন। এবছর উচ্চ মাধ্যমিক দিয়েছে। শেষ পরীক্ষার দিন বিকেলে ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি হয়ে চলে এল চুঁচুড়া টাউন রোডের ধারে পুরনো বইয়ের দোকানে। অয়ন গল্পের বইয়ের ভীষণ পোকা। নতুন বই ও পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি পুরনো বই ঘাঁটতেও খুব পছন্দ করে। সস্তা দামে এখান থেকে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই সে পেয়েছে। এদিন পুরনো বই ঘাঁটতে গিয়ে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলা-দেশ-জুলেভার্ণ রচনাবলী ও শরৎসমগ্রের মাঝখানে 'গুপ্তধন' নামে একশো ষাট পাতার ছোটোদের একটা ম্যাগাজিন খুঁজে পেল সে। ম্যাগাজিনের কভার পেজ নেই, খয়েরি হয়ে যাওয়া প্রথম পাতার একেবারে নিচে চোখ রাখে অয়নতেরশো সাতাশির আশ্বিন সংখ্যা, একাদশ বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা। সম্পাদক অরুণাভ মিশ্র। সম্পাদকীয় দপ্তর উত্তর ২৪ পরগনার গোবরডাঙ্গা। পত্রিকাটি কিনে বাড়ি ফিরল সে।

চোদ্দশো আঠেরোর চৈত্রে বসে গুপ্তধনের পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে সে চলে গেল তেরশো সাতাশির আশ্বিনে, প্রায় একত্রিশ বছর আগে। আজকের দিনের মতো ঝাঁ-চকচকে ছাপা নয়, কালারফুল ছবি নেই, তবুও এই বইটির একটা আলাদা আকর্ষণী শক্তি আছে। সে শুনেছে, মাত্র দশ-পনের বছর আগেও বই ছাপা হত লেটারপ্রেসে, ছবি ছাপা হত কাঠের ব্লকে। তখনও ঘরে-ঘরে এভাবে কম্পিউটার আসেনি, তাই ডিটিপি বা ডিজিটাল কম্পোজের এমন সুবিধা ছিল না। তবুও এই পত্রিকার অলংকরণ ও ছাপা অয়নের মন ভরিয়ে দিল। ভূতের গল্প, গোয়েন্দা গল্প, হাসির গল্পের সম্ভারের মাঝে ধাঁধা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা তথ্য ছাপা হয়েছে। পাতা ওল্টাতে গিয়ে অয়নের চোখ আটকে গেল ধাঁধার পাতায়। ওপরে লেখা 'গুপ্তধনের খোঁজ' নিচে একটা বড়ো বৃত্ত, বৃত্তের ভেতরে আর একটা বৃত্ত, তার ভেতরে আরেকটা, এভাবে করে মোট চারটে বৃত্ত আছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বৃত্তের পরিধির মাঝখানে ফাঁকা জায়গায় লেখা আছে 'এগারো পাতার গল্প', দ্বিতীয় আর তৃতীয় বৃত্তের মাঝখানে লেখা 'কুড়ি পাতায় যাও'। তৃতীয় আর চতুর্থ বৃত্তের পরিধির মাঝখানে লেখা 'একশো একের পাতা থেকে নাও' এবং সবচেয়ে ছোটো বৃত্তের মাঝখানে একটা সিংহ মূর্তি।

অয়ন পত্রিকার বৃত্তের নির্দেশ অনুযায়ী এগারো পাতা খুলল, একটা রহস্য গল্প, 'সেগুন কাঠের চোরাচালান' ভদ্রেশ্বর দাসের লেখা। শিলিগুড়ি অঞ্চল থেকে কে বা কারা রাতের অন্ধকারে বেআইনিভাবে সেগুন কাঠ কেটে পাচার করেছে- এই নিয়েই গল্প। দ্বিতীয় বৃত্তের বাক্য অনুসারে এবার কুড়ি পাতা খুলল, গল্পটা হাসির, 'হাঁসখালি ব্লকে হাঁস', গল্পকার সুকুমার চট্টরাজ। নদীয়ার হাঁসখালি ব্লকে হাঁসেদের সম্মেলন, ধর্মঘট ইত্যাদি নিয়ে হাস্যরসের মধ্য দিয়ে গল্পটা পরিবেশিত হয়েছে। ধাঁধার নির্দেশ অনুযায়ী এবারে একশো এক পাতা ওল্টালো সে। বিজ্ঞানীধর্মী প্রবন্ধ 'জলের খোঁজ মঙ্গল গ্রহে' লিখেছেন কালিপদ চক্রবর্তী।

কীভাবে এগোবে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না অয়ন। অবশেষে তিনটে রচনার শিরোনাম একটা খাতায় লিখল সে। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বেশ কয়েকবার শব্দগুলো পড়ল। না, কিছুতেই তো মিলছে না। কি শক্ত ধাঁধা রে বাবা! হঠাৎ মাথায় যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল তার। পাতা সংখ্যাগুলো একবার দেখি তো- ১১, ২০ ও ১০১, আরে! সংখ্যাগুলোর মধ্যে একটা সিমিলারিটি আছে। ১১-র দুটো এক যোগ করলে ২, ২০-র ২ ও ০ যোগ করলে পাওয়া যায় ২, আবার ১০১-এর ভেতরেও দুটো ১ আছে, যাদের যোগফল ২। এই ২ সংখ্যাটি কিসের ইঙ্গিত বহন করে! তাহলে কি প্রত্যেক শিরোনামের দ্বিতীয় শব্দের ভেতরেই লুকিয়ে আছে ধাঁধার উত্তর! প্রথম শিরোনামের দ্বিতীয় শব্দ হল 'কাঠের', দ্বিতীয় শিরোনাম থেকে পাওয়া গেল 'ব্লকে' এবং তৃতীয় শিরোনামের দ্বিতীয় শব্দ হল 'খোঁজ''কাঠের ব্লকে খোঁজ'

বাক্য একটা তৈরি হল ঠিকই, কিন্তু কিসের কাঠের ব্লক! কীভাবে খুজবে সে! অয়ন যখন এসব উত্তর খুঁজতে ব্যস্ত, তখন মায়ের ডাকে তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল, 'কিরে- রাত কত হল সেদিকে খেয়াল আছে ? খেতে আয়'

-এইতো যাচ্ছি।

-তোর পিসি ফোন করেছিল, বলল, 'টা দিন ওর ওখান থেকে ঘুরে আসতে।

অয়ন কয়েকমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বলল, পিসির বাড়ি মানে মসলন্দপুর, তারমানে গোবরডাঙ্গার পরের স্টেশন। ঠিক আছে, কালই যাব। পিসিকে জানিয়ে দাও।

-তুই খেতে বস। আমি ফোন করে আসছি।

অয়নের পিসির বাড়ি মসলন্দপুরের রাজবল্লভপুর গ্রামে, পিসেমশাই স্থানীয় পোস্টমাস্টার। স্বাভাবিকভাবেই এলাকার ইতিহাস ও স্থানীয় মানুষদের নাম-ঠিকানার অনেকটাই তার জানা। রাতে খাবার সময় অয়ন পিসেকে বলল, পিসেমশাই, তুমি গোবরডাঙ্গার অরুণাভ মিশ্রের নাম শুনেছ ?

-অরুণাভ মিশ্র! তুমি এই নাম কোথায় শুনলে ? পিসে জিজ্ঞাসা করল।

-একটা পুরনো পত্রিকায় পেয়েছি।

-ভদ্রলোকের জন্ম স্থানীয় জমিদার বংশে। বেশ গুণি মানুষ ছিলেন। গান-বাজনা, লেখালেখি নিয়েই থাকতেন। একটা প্রেসও ছিল ওঁর। নিজে একটা পত্রিকা চালাতেন।

-কোথায় বাড়ি বলতে পারো ?

-নেতাজি নগর, কালীবাড়ির পেছনে। প্রায় তিরিশ বছর আগে হঠাৎ একদিন কি এক অজ্ঞাত কারণে খুন হলেন তিনি। মুখ ধুয়ে গামছায় মুছতে-মুছতে জানাল পিসে।

-এমন ভালো মানুষ কেন খুন হলেন জানা গেছে ?

-না। পুলিশ এল জিজ্ঞাসাবাদ চলল, ব্যাস এই পর্যন্তই। তবে লোকমুখে শোনা, পারিবারিক গুপ্তধনের লোভে কেউ তাকে খুন করেছে।

-এর পেছনে আবার গুপ্তধনের গল্প আছে ?

-বুড়ো নাকি পূর্বপুরুষের ধনরত্ন মাটির নিচে লুকিয়ে রেখেছিলেন। ওঁর ছেলে অনেক খোঁড়াখুঁড়ি করেছে, কিছু লাভ হয়নি।

-ওঁর ছেলে-মেয়েরা এখন কোথায় ?

-এক ছেলে, এখানেই থাকে। অবস্থা ভালো নয়। পৈত্রিক সম্পত্তি বেচতে-বেচতে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। নাও, এবার ঘুমোতে যাও। কাল সকালে অর্ঘ্যর সঙ্গে ঘুরতে যেও। পিসে বলল।

অয়নের পিসতুতো ভাই অর্ঘ্য এগারো ক্লাসে পড়ে। পরদিন সকালে দুজন ঘুরতে বেরোল। গোবরডাঙ্গার মিশ্র পরিবার খুঁজে পেতে দেরি হল না ওদের। অরুণাভ মিশ্রের ছেলে স্বর্ণাভ তখন বারান্দায় বসেছিলেন। ষাট ছুঁইছুঁই, লম্বা একহারা চেহারার ফর্সা মানুষটা তাদের দিকে অনুসন্ধানী চাউনিতে তাকালেন। অয়ন সংক্ষেপে নিজেদের পরিচয় দিয়ে তাদের আসার কারণ জানাল, শুধু ধাঁধার বিষয়টা চেপে গেল।

-আমার বাবা ছিলেন শিল্প-সাহিত্য রসিক। তিনি বেঁচে থাকলে তোমার আদর করতেন। আজ সে রামও নেই, অযোধ্যাও নেই। বিষাদের সঙ্গে কথাগুলো বলে ওদের বসতে দিলেন স্বর্ণাভ।

-আপনাদের বাড়িটা কি একটু ঘুরে... ?

-দেখবার আর কিবা আছে ? সামনের ওই ভাঙ্গা ঘরখানা ছিল বাবার ছাপাখানা। ভেতর বাড়িতে ওইটা হল ঠাকুরদালান। আশ্বিন মাসে খুব ধুমধামের সঙ্গে মা সিংহবাহিনীর পুজো হত। এখন পাড়ার লোকেরাই চাঁদাপত্র তুলে পুজো করে।

-আচ্ছা, আপনাদের ছাপাখানার কোনো যন্ত্রাংশ বা অন্য কিছু অবশিষ্ট আছে ?

-বাবা মারা যাওয়ার পরে বেশ কিছুদিন প্রেস চালাবার চেষ্টা করি। কিন্তু অফসেট প্রিন্টিং টেকনোলজি বাজারে আসার পরে আমরা পিছিয়ে পড়লাম, লেটারপ্রেস বন্ধ হয়ে গেল, লোহার যন্ত্রাংশ ওজনে বিক্রি করতে হল। স্বর্ণাভর গলায় বিষাদের সুর।

-কাঠের ব্লক বা ওই জাতীয় কিছু অবশিষ্ট নেই ?

-খাটের নিচে ঘরের এক কোণে কিছু কাঠের ব্লক আছে। বাবার নিজের হাতে তৈরি বলেই বিক্রি করিনি। কিন্তু এত কিছু জানতে চাইছো কেন বলতো ?

-আসলে এত ভালো কাজ তিনি কীভাবে করতেন, তার নমুনা দেখার লোভ সামলাতে পারছি না।

স্বর্ণাভ উঠে ঘরে গেলেন, একটু পরে ধুলোমাখা একটা পাটের থলে হাতে করে বেরিয়ে এলেন, -দেখো তো এর ভেতরে কিছু আছে নাকি!

সেগুন কাঠের ব্লকগুলো সাগ্রহে দেখতে থাকে অয়ন। ব্লকের একদিকে নানা ছবি খোদাই করা, অন্যদিকে ছোট্ট একটা সিম্বল, কোনোটায় পেঁচা, কোনোটায় সাপ, বাঘ ইত্যাদি প্রাণীর মুখ আঁকা। কিন্তু সিংহের সিম্বল যুক্ত ব্লক সে খুঁজে পেল না, যে সিম্বলটা পত্রিকার ধাঁধার একদম ভেতরের বৃত্তে ছিল। অনেকক্ষণ ধরে খোঁজার পরে একটা ভাঙা ব্লক খুঁজে পেল, যার সিম্বলটি ঠিক মতো বোঝা যাচ্ছে না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বুঝল এটাই তার কাঙ্খিত ব্লক, সিংহের মুখের ছবিটা আবছা হয়ে গেছে। অয়ন বলল, মেসোমশাই, এই ব্লকটা আমি আজকের দিনটা আমার কাছে রাখতে চাই।

-রাখো, কিন্তু দেখা হলেই ফিরিয়ে দিও। বাবার হাতের জিনিস তো!

পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখালেন স্বর্ণাভ, টালির মতো আকৃতির ইঁট, কড়ি-বর্গা দেওয়া ছাদ আর সুরকির গাঁথনির মাঝখানে ইতিহাস যেন কথা বলে। থামের ওপর একটা সিংহ বসে যেন পাহারা দিচ্ছে এই বাড়ির অন্দরমহল। থামের নিচে মেঝে চৌকো-চৌকো গেরুয়া রঙের পাথরে বাঁধানো।

-খামের ওপর যে সিংহটা দেখছ, এটা সূর্য ঘড়ি, সিংহের মাথার ওপর তিনকোনা একটা দণ্ড ছিল। সেটা ভেঙে গেছে। একসময় এই দণ্ডের ছায়া দেখে সময় নির্ণয় করা হত। এটাও বাবার তৈরি।

-এখানে না এলে অনেক কিছুই জানতে পারতাম না। কয়েক মুহূর্ত থেমে আবার অয়ন জিজ্ঞেস করল, আপনাদের পারিবারিক 'গুপ্তধনের' কথা শুনেছিলাম।

অয়নের কথা শেষ না হতেই চমকে ওঠেন স্বর্ণাভ, চোখে-মুখে কেমন যন্ত্রণা ফুটে ওঠে তাঁর। তারপর অয়নকে তিনি যা বলেন, তার সারবস্তু এই, ১৩৮৭-র আশ্বিনের অরুণাভ মিশ্র সম্পাদিত 'গুপ্তধন' পত্রিকার শেষ সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়। তারপর থেকে তাঁদের বাড়িতে অনেক চিঠিপত্র আসতে শুরু করে। রাতে মাঝে-মাঝে বাড়ির চারপাশে অচেনা ছায়ামূর্তির আবির্ভাব ঘটতে থাকে। এক রাতে আততায়ীর হাতে খুন হলেন অরুণাভ। পারিবারিক ধনরত্নের ইঙ্গিত তিনি স্বর্ণাভকে দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, কাঠের ব্লকগুলো সাবধানে রাখতে। বাবার কথার অর্থ পরিষ্কারভাবে বুঝে উঠতে না পারলেও এটা বুঝেছিলেন, কাঠের ব্লকের সঙ্গে পত্রিকা এবং গুপ্তধনের একটা নিবিড় যোগ আছে।

রাতের খাওয়া সেরে অয়ন কাঠের ব্লকটা নিয়ে বসল। অসাধারণ কারুকার্য তার চোখ জুড়িয়ে দিল। ব্লকে কালি মাখিয়ে কাগজের ওপর ছাপ দিল সে। একটা আবছা সিংহের মুখ ভেসে উঠল কাগজে। এর থেকে কোনো হদিশ পাওয়া দুষ্কর। ব্লকটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল, চারপাশে সরু সুতোর মতো আড়াআড়ি দাগ চোখে পড়ল। সাঁড়াশি দিয়ে একটু জোরের সঙ্গে দাগ বরাবর চাপ দিতেই দুই ভাগ হয়ে গেল। এক ভাগের ভিতর থেকে বেরুল হলুদ হয়ে যাওয়া পার্চমেন্ট কাগজের একটা টুকরো। টুকরোটা হাতে নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল অয়নের চোখ-মুখ। ভাঁজ খুলে সে কাগজে লেখা পড়ল-

''একটা যখন ঘড়ির কাঁটায়

হাই তুলছে সিংহ মশাই

ছায়ার তলে খোঁজো তোমরা

পেয়ে যাবে প্রাণ ভোমরা।''

গুপ্তধনের ধাঁধার মর্মোদ্ধারের আনন্দ আর উত্তেজনায় অয়নের ঘুমটা এসেছিল শেষ রাতে। তাই ঘুম ভাঙতে-ভাঙতে পরদিন সকাল ন'টা বেজে গেল। এগারোটা নাগাদ সে রওনা দিল স্বর্ণাভ মিশ্রের বাড়ির উদ্দেশ্যে। তাকে দেখে স্বর্ণাভর মুখমণ্ডল হাসিতে ভরে গেল।

-তারপর খুদে গোয়েন্দা! গুপ্তধনের রহস্য ভেদ হল ? স্বর্ণাভ জিজ্ঞাসা করলেন।

-আপনার বাবা যদি ঠিক মতো নির্দেশিকা দিয়ে থাকেন, তবে আজই সিংহের ঘুম ভাঙবে।

অয়ন কাঠের ব্লকে প্রাপ্ত কাগজটা স্বর্ণাভকে পড়তে দিল, ছড়াটা পড়ে স্বর্ণাভ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন। বললেন, অসাধ্য সাধন করলে তুমি! ব্লকের ব্যাপারটা জানলে কি করে ?

অয়ন পত্রিকার ব্যাপারটা আনুপূর্বিক জানাল, তারপর বলল, ছড়ার প্রথম দুই চরণ দেখুন- 'একটা যখন ঘড়ির কাঁটায়/ হাই তুলেছে সিংহ মশাই'। কি বোঝাচ্ছে, সূর্য ঘড়িতে যখন একটা বাজবে, তখন সিংহ হাই তুলবে অর্থাৎ একটার সময় সিংহ মুখ খুলবে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় চরণে বলা হয়েছে- 'ছায়ার নিচে খোঁজো তোমরা/ পেয়ে যাবে প্রাণ ভোমরা'। এর মর্মবস্তু দাঁড়াল, দুপুর একটার সময় সিংয়ের মুখের ছায়া যেখানে পড়বে, সেই ছায়াতলে প্রাণভোমরার দেখা পাবে। অয়ন বিশ্লেষণ করল।

এরপর দুজনে সিংহের থামের কাছে এসে ভালো করে সিংহটাকে দেখল। এখানে দাঁড়িয়েই কতদিন সকাল-সন্ধে দেবীর আরতি দেখেছেন স্বর্ণাভ, কোনোদিন ঘুণাক্ষরেও গুপ্তধনের কথা মনে জাগেনি। মেঝের দিকে তাকালেন তিনি, গেরুয়া রঙের চৌকো রক্ মার্বেল বাঁধানো উঠোন। জায়গায়-জায়গায় শ্যাওলা ধরেছে, কিন্তু মেঝেতেও অসাধারণ কারুকার্য ফুটিয়ে তুলেছিলেন অরুণাভ।

ঘড়িতে একটা বাজতেই অয়ন ঝুঁকে পড়ল মেঝেতে, ছায়াসিংহের মুখের ফাঁকা জায়গাটা খড়ি দিয়ে চিহ্নিত করল। স্বর্ণাভ একটা শাবল দিয়ে চৌকো পাথর খণ্ডে আড়াআড়ি চাপ দিতে লাগলেন, স্বর্ণাভর ছেলেরাও হাত লাগাল। বেশ কিছুটা কসরৎ করার পর চৌকো পাথর খণ্ডটা উঠে এল। তারপর গর্তের মধ্যে কিছুক্ষণ খোঁড়ার পর ঠং করে একটা ধাতব শব্দ হল। অয়ন ও স্বর্ণাভর চোখে-মুখে তখন পড়ন্ত সূর্যের স্বর্ণালী আভা। একটা মাঝারি মাপের পেতলের ঘড়া বেরিয়ে এল গর্ত থেকে। সিংহবাহিনীর মূর্তির সামনে উপুড় করতেই ঝনঝন শব্দে মেঝের ওপর পড়তে থাকল অনেকগুলো চকচকে সোনার গিনি।

 

অলংকরণ- রাহুল মজুমদার

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ