Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

রানিদি আর দাঁড়িবাঁধা খেলা ।। দেবল দেববর্মা



তখন আমরা থাকতাম ঝাড়গ্রামে। আজকের জনবসতি ছড়ানো ঝাড়গ্রাম নয়। তখন ঝাড়গ্রাম ছিল খুবই ছোটো। স্টেশনের দিকটার নাম ছিল নিউ ঝাড়গ্রাম। আর রাজবাড়ির সংলগ্ন এলাকাটার নাম ছিল ওল্ড ঝাড়গ্রাম। কোর্ট-কাছারি, স্কুল এসব ছিল নিউ ঝাড়গ্রামে। আর ওল্ড ঝাড়গ্রামে রাজার প্যালেস, থানা আর চতুর্দিকে জঙ্গল। আগের ঝাড়গ্রামে জিনিসপত্র ছিল খুবই সস্তা। আদিবাসী মেয়েরা নানাধরনের সবজি, চাষের উৎপন্ন জিনিসপত্র ঝুড়িতে  করে বিক্রি করতে আনত। আমার মনে আছে ছোটো একটা ঝুড়িতে, যার মধ্যে সাত-আটটা মাঝারি সাইজের বেগুন ধরত তার দাম নিত তিন পয়সা কিংবা বড়ো জোর এক আনা।

এখন নিশ্চয় ঝাড়গ্রামে আর সেই সুখের দিন নেই। জিনিসপত্রের দাম অন্যান্য জায়গার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে উঠেছে। আর এতে অবাক হবার তো কিছু নেই। দিন যেমন এগিয়ে চলেছে জিনিসপত্রের দামও তেমনি বাড়ছে।

ঝাড়গ্রামে আমরা থাকতাম থানার কাছে, পুলিশ কোয়াটার্সে। আমার বাবা ছিলেন থানার বড়ো দারোগা। থানার সামনে ছিল বিরাট মাঠ। মাঠটা এত এতো বড়ো যে আমরা এক পাক ঘুরে আসতে হাঁফিয়ে পড়তাম। আমরা ছোটো-বড়ো মিলিয়ে প্রায় তের-চোদ্দজন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে খেলা করতাম। তখন এসব মফস্বল যায় ফুটবল খেলার তেমন প্রচলন হয়নি। তাই আমরা খেলতাম দাঁড়িবাঁধা খেলা কিংবা বুড়িচোর অথবা চোর-পুলিশ। এক-আধদিন হা-ডু-ডুও খেলতাম। যেদিন যেমন ইচ্ছে হত।

আমাদের দলে ছিল ছোটো দারোগার দুই ছেলে আর এক মেয়ে। আমরা দুই ভাই। আবগারী দারোগার দুই ছেলে আর এক মেয়ে, কন্ট্রাকটর সর্বাধিকারীবাবুর এক ছেলে আর এক মেয়ে। এছাড়া পাড়ার আরো তিন চারজন ছেলে-মেয়ে। আমাদের মধ্যে আবগারী দারোগার মেয়ে রানীদি বয়সে একটু বড়ো। শুনেছিলাম রানীদির বয়স তের-চোদ্দ হবে। আমরা বাকি সবাই দশ থেকে তেরোর মধ্যে।

তবে দাঁড়ি-বাঁধা খেলা ছিল আমাদের সবার প্রিয়। চোদ্দজন খেলুড়ে হলে দুই দলে সাতজন করে ভাগ করে নিতাম। সাধারণত রানীদির দলে সবাই যেতে চাইত। কিন্তু ওভাবে ইচ্ছেমতো রানীদির দলে থাকব বললেই তো আর হয় না। তাই দুই ক্যাপ্টেন ছাড়া বাকিদের  কাগজে নামটা লিখে এক জায়গায় জমা দিতে হত। দুই ক্যাপ্টেন রানিদি আর গগন পালা করে এক-একটা কাগজ তুলে নিত। তাতে যার নাম লেখা আছে সে রানিদি কিংবা গগনের দলে যাবে।

তবে রানিদি ছিল ওস্তাদ খেলুড়ে। দাঁড়িবাঁধা খেলায় চৌকো ঘর আঁকা হত চুন দিয়ে। তারপর এক দলের সব খেলুড়ে একটা ঘর থেকে বেরোবার চেষ্টা করত। তখন বিপক্ষ দলের দুই পাহারাদারের কেউ একজন তাকে ছুঁয়ে দিলেই দলটা 'মোর' বা হেরে যেত। তবে রানিদির দলকে হারানো খুব শক্ত ছিল। কারণ রানিদি পা দুটো সুন্দরভাবে মাটির ওপর ঘষে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে পারত। কোমর বেঁকিয়ে তার এই ক্ষিপ্রগতিতে অন্য ঘরে যাওয়া গগনের দলের কেউ আন্দাজ করতে পারত না। ফলে রানিদি কোন ফাঁকে যে ঘর থেকে বেরিয়ে অন্য ঘরে গিয়ে শেষ ঘরে দাঁড়িয়ে 'দাঁড়' বলে হাঁক দিলেই গগনের দলের যে চৌকো ঘরে পাহারায় ছিল সে ঘর ফেলে শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছবে। সেই ফাঁকে দলের অন্য সবাই এ-ঘর, সে-ঘর করে শেষ ঘরে চলে যাবে। তার মানেই জিত, রানিদির দল জিতে যেত।

তবে রানিদি য়ে সর্বদাই জিততো তা নয়। মাঝে-মধ্যে দলের অন্য কেউ ঘর থেকে বেরুতে গিয়ে মোর হয়ে যেত। এভাবেই হার-জিত চলত। তবে হারের চেয়ে জেতার ভাগ্যটা রানিদির কপালেই বেশি জুটত।

কিন্তু হঠাৎ একটা সংবাদ ছড়িযে পড়তেই আমাদের অমন সাধের দাঁড়ি-বাঁধা খেলায় ছেদ পড়ল। খবরটা ছোটো দারোগার ছেলে সাধন নিয়ে এল। সে নাকি ওর মায়ের কাছ থেকে শুনেছে। রানিদিকে গতকাল সন্ধের পর কারা নাকি দেখতে এসেছিল। যার সঙ্গে রানিদির বিয়ে হবে তার চুঁচুড়ায় বাড়ি। কোনো এক বন্ধুর বাড়ি ঝাড়গ্রামে এসেছিল বেড়াতে। বন্ধুর নাম শ্রীকান্ত। ওর বাবা সরকারি উকিল। কোনো একটা কাজে রানিদি শ্রীকান্তর দিদির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল তাদের বাড়ি। সেখানেই রানিদিকে দেখে সেই ভদ্রলোকের খুব পছন্দ হয়।

তারপর গতকালই বিকেলের পর শ্রীকান্তদা, তার বন্ধু, শ্রীকান্তদার মা আর দিদি সবাই মিলে রানিদিদের বাড়িতে আসে। বিয়ের কথাবার্তা নাকি তখনই পাকা হয়ে যায়। শ্রীকান্তদার সেই বন্ধু সরকারি চাকুরে। মা আছেন তবে বাবা বেঁচে নেই। এক কাকা নাকি গার্জেনের মতো। তিনিও আর আপত্তি করেননি।

পরদিন সকালেই সেই বন্ধু চুঁচুড়ায় ফিরে যাবার পরই শ্রীকান্তদার বন্ধুর কাকা এসে মেয়ে দেখলেন। আর মেয়ে দেখেই পছন্দ। অঘ্রাণের শুরুতেই বিয়ের তারিখ ঠিক হয়ে গেল। মেয়ের বাড়ি থেকে একটু আপত্তি করা হয়েছিল। মেয়ের বিয়ে বলে কথা। তার জোগাড়-যন্তর এসব করতে সময় চাই বৈকি। কিন্তু ছেলেপক্ষের জেদাজেদি। পাত্রের যখন বিয়েতে অমত নেই তখন আর বিলম্ব করে লাভ কি ?

খেলার মাঠে আমরা সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসলাম। রানিদি না খেললে তো আমাদের দাঁড়ি-বাঁধা খেলাই বন্ধ হয়ে যাবে। বিয়ের পর রানিদি তো শ্বশুরবাড়ি চুঁচুড়ায় চলে যাবে। তার মানে আমাদের খেলার দফা রফা। বলতে আপত্তি নেই আমরা খুব সমস্যায় পড়ে গেলাম।

রানিদির বিয়েতে আমরা সব বন্ধু মিলে পেট পুরে খেয়ে এলাম। পরদিন বিকেলে রানিদি তার স্বামী আর অন্যান্য আত্মীয়দের সঙ্গে চুঁচুড়া চলে গেল। আমাদের খেলা অবশ্য বন্ধ হয়নি। রানিদি ছাড়া বাকি সবাই মিলে দুটো দল করে খেলতাম। একটা দলের ক্যাপ্টেন গগন আর একটা দলের ক্যাপ্টেন ধীরেন। আগের মতো না খেললেও খেলাটা বন্ধ হয়নি। তবে রানিদি থাকতে যেমন হুটোপুটি করে খেলতাম তেমনটা ঠিক আর হচ্ছিল না।

মাস ছয় বাদে হঠাৎ একদিন খবর পেলাম রানিদি নাকি চুঁচুড়া থেকে আসছে। আগামীকালই তার ফেরার কথা। খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই গগন আর নীরেন  দুজনে কন্ট্রাক্টরের গোডাউন থেকে চুন এনে কোট কাটতে শুরু করে দিল।

রানাদি নিশ্চয়ই এসে তাদের সঙ্গে দাঁড়িবাঁধা খেলবে। আজ বিকেলেই তার পৌঁছবার কথা। তাহলে আগামীকাল মাঠে রানিদির তাদের সঙ্গে খেলতে অসুবিধা কোথায়।

রাত্রিরটা এক ঘুমে কাবার করে সকালেই আমরা রানিদির বাড়ি যাব বলে ঠিক করলাম। আজ বিকেলেই যেন রানিদি দাঁড়ি-বাঁধা খেলতে আসে। এমন মজার খেলা ছেড়ে রানিদি কি একটা দিনও থাকতে পারবে ?

'টা বাজতেই আমরা রানিদির বাড়ি যাব বলে তৈরি হয়ে গেলাম। গগন, ধীরেন, নীরেন, হরি, বাবলা, নীলা, মাধুরী আরো অনেকেই। ডাকাডাকি শুনেই রানিদির মা বেরিয়ে এলেন। শুকনো মুখ, সমস্ত বাড়িটা যেন চুপচাপ। মনে হল কেউ যেন একটা লাঠির বাড়ি মেরে গোটা বাড়িটাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে।

রানিদির মা বললেন, তোমরা একটু দাঁড়াও। আমি রানিকে ডেকে দিচ্ছি।

মিনিট তিন-চার বাদেই রানিদি ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। যেদিন বিয়ের পর চুচুঁড়া গিয়েছিল রানিদি সেদিন তার পরনে ছিল লাল বেনারসি, গলায় সীতাহার, চোখে কাজল, কানে সুদৃশ্য দুল আর কাজললতা। আর আজ রানিদির পরনে ফিতে পাড় শাড়ি, তার সাদা রং, গলায় একটা সরু হার, কানে ছোট্ট দুটি দুল। আর সেই কাজলতাটা কবে বিসর্জন দিয়ে এসেছে কে জানে ?

শুনলাম মাত্র তিন দিনের জ্বরে ভুগে রানিদির স্বামী হঠাৎ মারা যান ? খবর পেয়েই রানিদির বাবা গিয়ে তাকে নিয়ে এসেছেন। এরপর রানিদি হয়তো এ বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে দাঁড়ি-বাঁধা খেলা ?

কেউ না বললেও আমরা সকলেই সেটা জানি। রানিদি আর কোনোদিন দাঁড়ি-বাঁধা খেলবে না।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ফেব্রুয়ারি ২০১৩

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ