![]() |
বাপ্পা, বাপ্তু, রাজু, সন্দীপ সেই বিকালে খেলতে গেছে, সন্ধ্যা প্রায় অনেকটা গড়িয়ে গেছে। এখনো বাড়ি আসছে না দেখে রাজুর মা রাজুর মৃদুল কাকাকে বলল একটু বেরিয়ে দেখতে। মৃদুল কাকা খুঁজতে বেরোল।
এদিকে হয়েছে কি এই চার বন্ধু মিলে খেলতে-খেলতে বনের শেষ প্রান্তে একটা পুরনো
পোড়ো বাড়ি দেখতে পেয়ে আস্তে-আস্তে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ল। বাড়িটা আগাছায়
ভরে গেছে, চারদিকে মাকড়সার
জাল। পোড়ো বাড়িটার মধ্যে ঢুকে ঘুরতে-ঘুরতে হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে ঘুরে দাঁড়াল
একটা দাড়িওয়ালা লোক। তার মাথায় পাকা চুল, পরনে ফতুয়া আর ময়লা শতচ্ছিন্ন একটা ধুতি।
লোকটা বারেবারে হাততালি দিচ্ছে আর কি সব আওয়াজ করছে। হঠাৎ ওরা খুব ভয় পেয়ে
যায়।
দাড়িওয়ালা লোকটা বলল, তোমরা এখানে কেন
এসেছ ?
রাজু সাহস করে বলল, আমরা পাশের
গ্রামে থাকি। বড়োরা আমাদের বলে- ওই পোড়ো বাড়ির দিকে যাবি না। তাই আমাদের মনে কৌতুহল
জাগল এই বাড়ির রহস্যটা কি জানতে হবে। তাই চলে এসেছি। কিন্তু তুমি কে ?
লোকটা বলল, আমি একসময় খেলা
দেখাতাম। বাঁদর, কুকুর, টিয়ে, কাঠের পুতুল আর আমার একটা বাঁশি নিয়ে। বাঁশিটা আর কাঠের পুতুলগুলো এখন আমার
এই ঝোলায় আছে।
বাপ্তু বলল, আর তোমার বাঁদর, কুকুর, টিয়ে এরা কোথায় ? লোকটা বলল, বাঁদর দুটো না খেতে পেয়ে পালিয়ে গেছে। কুকুরটা মরে গেছে। টিয়া পাখিটাকে ছেড়ে দিয়েছি। এখন তো এসব খেলা আর কেউ দেখে না। তাই পয়সা-কড়ি পাই না। আমি নিজেই খেতে পাই না, ওদের কি খাওয়াব!
সন্দীপ বলল, নাম কি তোমার ?
লোকটা বলল, আব্দুল ভাই। ছোটোবেলায় গ্রামে-গ্রামে, শহরে-গঞ্জে ঘুরে কত খেলা দেখিয়েছি। এই দেখো আমার ডুগডুগি, তখন কত লোক খেলা দেখত। কত পয়সা দিত। এখন আমাকে দেখলে সবাই তাড়া করে, পাগল বলে ঢিল ছোঁড়ে। তাই এটাই এখন আমার নিরাপদ আশ্রয়। রাতের দিকে খাবারের সন্ধানে বেরুই, কোনোদিন কিছু পাই, তবে বেশিরভাগ দিনই অনাহারে কাটে।
ওরা চার বন্ধু আব্দুল ভাইয়ের কথা এক মনে শুনছে। আব্দুল ভাই তখনও বলছে, তোমরা কিন্তু আমার কথা কাউকে বলো না। তাহলে আমার এই আশ্রয়টুকুও হারাতে হবে। সব শুনে ওদের আব্দুল ভাইয়ের ওপর কেমন মায়া পড়ে গেল। রাজু আর সন্দীপের কাছে কিছু টিফিনের পয়সা ছিল। ওরা আব্দুল ভাইয়ের হাতে দিয়ে পোড়ো বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল।
বাড়ির দিকে হাঁটছে এমন সময় দেখে মৃদুল কাকা হন্তদন্ত হয়ে ওদের দিকেই আসছে। মৃদুল কাকা বলল, কিরে তোরা কোথায় গিয়েছিলি ? বাড়িতে সবাই কত চিন্তা করছে। চল-চল তাড়াতাড়ি বাড়ি চল।
ওরা যে যার বাড়িতে চুপচাপ বকুনি শুনল, কাউকে কিছু বলল না। খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়ল। রাজু ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখল আব্দুল ভাই যেন তাদের খেলা দেখাচ্ছে। আব্দুল ভাই ডুগডুগি বাজাচ্ছে, বাঁদর দুটো ডিগবাজি খাচ্ছে আর তাদের সেলাম জানাচ্ছে। টিয়া পাখি সকলের কথা নকল করছে। এমন সময় এক পরি এসে বলল, রাজু তুমি এই পদ্মফুলটি নাও। এটাকে তুমি যা চাইবে তাই পাবে। এই বলে পরি চলে গেল। রাজু ফুলটি নিয়ে আব্দুল ভাইয়ের জন্য কত খাবার চাইল। জামা-কাপড় চাইল। আব্দুল ভাই কত তৃপ্তি করে খেল। কত আনন্দ পেল আব্দুল ভাই। তারপর রাজুর মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে বলল, আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুন। রাজুর ঘুম ভেঙে গেল। রাজু দেখল তার মা তার ঘুম ভাঙানোর জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকছে।
পরেরদিন রাজু, বাপ্পা বাপ্তু, সন্দীপ আরো কয়েকজন বন্ধু মিলে তাদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে আব্দুল ভাইয়ের জন্য খাবার কিনে নিয়ে গেল। এরপর থেকে প্রায় রোজই আব্দুল ভাইয়ের জন্য খাবার নিয়ে যেত।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬
0 মন্তব্যসমূহ