![]() |
এই বাড়িটার মায়া কিছুতেই ত্যাগ করতে পারেনি ওই বুড়োটা।মানে সাহেবটা। সাহেবটা মরে যাওয়ার পর থেকে এই বাড়িটাতেই থাকে। তার অবশ্য কিছু কারণও আছে।
সে বহুকাল আগের কথা। এখানে লাক্ষার চাষ হত। আর সেই লাক্ষার জন্য ওই সাহেবটা এসেছিল কতদূর থেকে। জাহাজে চেপে আসতে নাকি ঢের দিন লেগে গিয়েছিল। তারপর এই জঙ্গলে একটা কারখানা গড়ে তুলেছিলেন। সেসময়ে জাহাজ ভর্তি লাক্ষা বিদেশে চালান হত।
এখন অবশ্য সেদিন নেই। এখন আর কেউ এখানে লাক্ষার চাষও করে না। কুলগাছই তেমন চোখে পড়ে না। সব জঙ্গল কেটে সাফ করে দিয়েছে। তো চাষ হবেটাই বা কোথায় ?
কিন্তু সাহেবের বাড়িটা রয়ে গেছে। যে বাড়িটা ওই সাহেব নিজে হাতে বানিয়েছিলেন। তখন তো এখনকার মতো ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ ছিল না। ফলে পাখা ঘুরত না। কিন্তু সাহেবরা তো এসেছে ঠাণ্ডার দেশ থেকে, ওরা গরম সহ্য করতে পারে না। তবে ওদের বুদ্ধি ছিল।
বাড়িটা যাতে ঠাণ্ডা থাকে তার ব্যবস্থা ওই সাহেব নিজেই করেছিলেন। কেমন সে ব্যবস্থা ?
বাড়িটার চারপাশে প্রচুর বড়ো বড়ো গাছ লাগিয়েছিলেন। নিম গাছ, শিরীষ, অর্জুন, শিশু, আসন গাছ।
এখন সেই গাছগুলোই এত বড়ো বড়ো আর মোটা হয়েছে যে ভাবাই যায় না। লোকে বলাবলি করে এখানকার এক একটা গাছের দাম নাকি লাখ টাকার উপরে।
সে যাক। যে কথা বলছিলাম। সাহেব ঘরগুলোকে এত উঁচু ও বড়ো মাপের করেছিলেন যে এখনকার লোকজন সেসব দেখে হাঁ হয়ে যায়। আর প্রতিটি ঘরে যেমন বড়ো বড়ো জানালা তেমনি উঁচু ও বড়ো বড়ো দরজা করেছেন। আবার প্রতিটি ঘরের মাথায় দুটো তিনটে করে ঢাকনা দেওয়া ফাঁকা জায়গা রেখেছিলেন। যাতে গরমকালে হাওয়া বাতাস যথেষ্ট পরিমাণে ঢুকতে পারে আবার শীতের সময়ে ঢাকনা বন্ধ করে দিলে ঘর গরম হয়ে যাবে। এসব বুদ্ধি ওই সাহেবের মাথা থেকেই বের হয়েছিল। আর গোটা বাড়িটাই তৈরী হয়েছিল চুন সুরকি দিয়ে। বাড়িটার মাথায় ছিল জলছাদ। ফলে ঘরগুলো সবসময়ই ঠাণ্ডা হয়ে থাকত।
এখনও সেই বাড়িটা আছে। জঙ্গলের মধ্যে মস্ত বাড়িটায় এখন আর কেউ থাকে না। একরকম পরিত্যক্ত ও ভাঙাচোরা অবস্থাতেই পড়ে থাকে। লোকেরা বলাবলি করে, ওটা সাহেব ভূতের বাড়ি, ওটা বুড়ো ভূতের বাড়ি। সাহেবটা নাকি একাই থাকতেন। এখানেই তাঁর ব্যবসা-বাণিজ্য যা কিছু ছিল। তারপর তো বয়স হতে হতে একসময়ে তিনি বুড়োও হয়ে যান। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে এই বাড়ির পিছনেই তাঁকে কবরে শুইয়ে রাখা হয়েছে।
লোকেরা বলাবলি করে, অনেকেই নাকি সেই বুড়ো সাহেবকে মাঝেমধ্যেই বাড়ির সামনে পায়চারি করতে দেখে। বুড়োটা এই বাড়িটাকে আগলে রেখেছে। তা না হলে এখানকার লোকেরা ওরকম বড়ো বড়ো গাছগুলো কবে কেটে নিয়ে যেত। ইঁট-কাঠও থাকত না।
তো সেই বাড়িটার খবর পেয়ে, গরমের ছুটিতে
একদিনের জন্য বেড়াতে আসবে মউ, রূপু, বুবাই, টুকাইরা। অবশ্যই সঙ্গে আছেন ওদের মা এবং বাবা।
হরিকাকু বলেছেন, দেখবে জায়গাটা কত আরামের। একদিনের জায়গায় হয়তো দুদিনও থেকে যেতে হতে পারে। হরিকাকু সম্পর্কে ওদের বাবার বন্ধু। এখানে ওনার বহু দিনের বাস।
হরিকাকু বলেছেন, আমি লোক লাগিয়ে দিচ্ছি সব সাফসুতরো করে দেবে। আর একজনকে দেব যে সবরকম ফাইফরমাস খেটে দেবে। বাজারহাট প্লাস রান্নাও।
তবে বাজারটা ওখান থেকে বেশ দূরে। পাহাড়ি চড়াই-উৎরাই রাস্তা তো। যেতে আসতে সময় লাগে। সেজন্য আপনাদের যা যা লাগবে সব একসঙ্গে বলে দেবেন, ও এনে দেবে। কোনো সমস্যাই হবে না।
মউরা গাড়ি থেকে নামতেই অবাক হয়ে দেখল, গাছগাছালি ছায়ায় ঘেরা বাড়িটা অদ্ভুত সুন্দর। বাড়িতে ঢোকার রাস্তার দু’পাশে বাহারি ফুলের গাছ। নানা রঙের ফুল ফুটে আছে সেখানে।
তারপর ঘরে ঢুকে সকলেই অবাক। মস্ত হল ঘরটায় পাশাপাশি লোহার খাট। তার উপরে বিছানো আছে সুদৃশ্য বিছানা। কোথাও এতটুকু মলিনতা নেই। ধুলো ময়লা বলে কিছু নেই। তবে ঘরের পাশে গাছ থেকে উড়ে উড়ে পড়ছে শুকনো পাতা।
হরিকাকুর রাখা লোকটির নাম রাবন হাঁসদা। সে একমুখ হাসি নিয়ে সব সময়েই সামনে দাঁড়িয়ে। চোয়াল পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে বলল, আপনেদের জন্য জল আছে বাতরুমে। চোবচ্ছা ভরা আছে। এবারে বলেন কি রান্না হবে ? কি খাবেন ?
কি পাওয়া যায় এখানে ? জানতে চাইল টুকাইয়ের মা।
মোরগা পাবেন। আন্ডা মিলবে। রাবন জানাল, তোবে আপনেদের মছলি এখানে মিলবে না।
মছলির দরকার নেই। রূপুর বাবা পকেট থেকে টাকা বের করে দিয়ে বললেন, মুরগির ঝোল কর। আর ভাত। পারবে তো ?
রাবন মাথা নুইয়ে জবাব দিল, এটা তার কাছে কোনো ব্যাপারই নয়।
রাবন সেই যে গেছে ফেরার নাম নেই। বাচ্চাগুলোর খিদে পেয়ে যাচ্ছে। মায়েরা স্নান সেরে খাটে শরীর এলিয়ে দিয়েছে। বাবারা লনে বসে নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টা করছেন এবং এই বাড়িটাকে নিয়ে কত-কত কল্পনা করে চলেছেন। ছোটোরা ছোটাছুটি- খেলাধূলাতে ব্যস্ত।
এমন সময়ে রাবন এল। এক হাতে মুরগি ঝোলানো অন্য হাতে থলে ভর্তি পেঁয়াজ রসুন আদা ইত্যাদি। দেখা গেল অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় রাবন উনুন তৈরি করে কাঠকুটো জ্বেলে রান্না করে দিল।
পুরোনো আমলের টেবিল চেয়ার। সাহেবরা যে এখানে ছিল তার প্রমাণ মেলে এইসব
আসবাবপত্রেই। মাঝে একটা ঘর আছে। সেটাই যে ডাইনিং ছিল বোঝা যায়। সেখানেই রাবন
পরিবেশন করতে লাগল। প্রত্যেকের সামনেই থালা গেলাস বাটি। সবই এখনকার আমলের। হরিকাকু
রাবনের সঙ্গে ওইসব পাঠিয়ে দিয়েছে। যাতে রূপুদের কোনো অসুবিধে না হয়।
প্রত্যেকের পাতে পড়ল গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত। সঙ্গে আলু ভর্তা এবং বাটিতে মুরগির ঝোল। ভাত এবং আলু ভর্তা অবধি ঠিক ছিল। কিন্তু মাংসের বাটি এগিয়ে দিতে সকলেই অবাক। যে যেমনটি পছন্দ করে একেবারে তেমনটি তার বাটিতে।
রূপুর জন্য ওর মা বাড়িতে স্টু করে দেয়। দেখা গেল ওর বাটিতে স্টু। টুকাইয়ের মা পছন্দ করে ঝাল-ঝাল কষা মাংস। তাঁর বাটিতে যথারীতি ঝাল-ঝাল কষা মাংস। মউ, টুকাই এবং বুবাই পছন্দ করে আঝালা ঝোল মাংস। ওদের বাটিতে কিন্তু তাই তুলে দিয়েছে রাবন। আবার বুবাইয়ের বাবা পছন্দ করেন ঝাল ঝোল মাংস। তাঁর সামনে ঝাল ঝোল মাংস।
সকলেই অবাক। রূপুর মা বললেন, রাবন করেছ কী !
বুবাইয়ের বাবা বললেন, তুমি সবার পছন্দের কথা জানলে কীভাবে ?
রাবন একমুখ হাসি ছড়িয়ে জানাল, বাচ্চাদের কাছ থেকেই জেনে নিয়েছি কে কি পছন্দ করে। সেরকম চেষ্টা করেছি। আপনেরা খেইয়্যে দেখ্যেন।
সকলেই রাবনের রান্নার তারিফ করতে লাগল।
এমন সময় সকলেই অবাক হয়ে দেখল অবিকল রাবনের মতো আরেকজন হাতে মুরগি ঝুলিয়ে আর থলে ভর্তি বাজার নিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে এদিকেই আসছে। এক মুখ। এক হাইট। একরকম দেখতে।
তাহলে এ কে ? যে রান্না করে দিল! ওদের আদর যত্ম করল ? অথবা ওই বা কে ? যে মুরগি আর থলে হাতে নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে ? ভারী ধন্দে পড়ে গেল সকলে।
থলে হাতে বাজার ও মুরগি নিয়ে রাবন সামনে এসে জানাল, দেরি হয়ে গেল বাবু। কাল রেইত্যে টিরেনে একটা খোকা হাতি কাটা পইড়্যছে। সেটা দেইখ্যতে গিয়্যেই দেরি হয়্যে গেল।
মউ এবং রূপুর বাবা দুজনেই একসঙ্গে ধমকে উঠল, কে তুমি ? রাবন তো আমাদের রান্না করে খাইয়ে দিয়েছে।
এজ্ঞে আমিই তো রাবন। তাহলে উ...
দেখা গেল একটু আগে যে ওদের রান্না করে পরম যত্নে খাইয়েছে সে আর নেই।
সব শুনে রাবন বলল, এসব তাহলে ওই বুড়ো ভূতের কাণ্ড!
ভূত! ঘাবড়ে গেল সকলেই।
রাবন জানাল, ডর ন্যেই বাবু। উ কারুর ক্ষেতি করে না। উ সাহেব ভূত আছ্যে।
তারপর ওই সাহেব ভূতের খোঁজে সবাই মিলে গোটা বাড়ি তন্ন-তন্ন করে ঘুরল। কিন্তু
কোথাও তাঁকে খুঁজেই পাওয়া গেল না।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা ।
Topic: Ghost story in Bengali
0 মন্তব্যসমূহ