Ticker

20/recent/ticker-posts

Header Ads Widget

সভ্য প্রাণী ।। বিপুল অধিকারী

সভ্য সভ্য আর সভ্য এই নিয়ে বনের মধ্যে হই-চই পড়ে গেল। সমস্ত জীবজন্তুরা ঠিক করল যে, তারা আর হিংস্র বর্বর ও অসভ্য হয়ে থাকবে না। তারা সভ্য প্রাণীদের মতো জীবন-যাপন করবে। তাই ওরা সবাই মিলে ঠিক করে এক সম্মেলন ডাকল। সন্ধ্যা হতে না হতেই বিশাল অন্ধকার অরণ্যের খানিকটা দূরে এক ছোটো নদীর তীরে ফাঁকা জায়গায় একে একে সমবেত হল।

সাঁঝ আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় দেখা গেল কেবল সাদা কালো পশুদের মাথা। একদিকে বাঘের পাল, অন্যদিকে হাতি, তার পাশে মহিষ, গরু, হরিণ প্রভৃতি প্রাণীরা মিলে একটা বালির উঁচু ঢিবিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।

এমন সময় প্রাণীরপাল থেকে সভাপতি বাঘ গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসল সেই মাটির ঢিবির ওপর। সমস্ত প্রাণীর সমাগমে বনের মধ্যে একটা গমগমে ভাব। সভাপতি উচ্চস্বরে শুরু করলেন- বন্ধুগণ, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন যে, মানুষ একসময় এই বনে বাস করত। কিন্তু এখন তারা জঙ্গলে বাস করে না। কারণ বুদ্ধির বলে আজ তারা কত উন্নত। অথচ আমরা এখনও এই বনেই পড়ে আছি। কিন্তু কেন? তার কারণ আমাদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা নেই। আছে জগড়া, বিবাদ, হিংসা, মারামারি। এই বলে সে পশুদের উদ্দেশ্যে বলল, তাছাড়া আমাদের গায়ে যে শক্তি আছে, তাই নিয়ে আমরা এক একজন পাঁচ-সাতজনকে অনায়াসে নাকানি-চোবানি খাওয়াতে পারি। তবে কেন আমরা পারব না, তাদের চেয়ে আরো বেশি উন্নত হতে।

সভাপতি বাঘের খুব কাছে বসে থাকা গোটা কতক খরগোশ কান খাড়া করে শুনছিল। তারা নাকানি-চোবানি কথা শুনে ভয় পেয়ে চলে যাচ্ছিল। বাঘ বুঝতে পেরে গলার স্বর নরম করে বলল, ও আমার কচি কচি বন্ধুরা, তোমাদের কোনো ভয় নেই। আজ থেকে কেউ কাউকে হত্যা করবে না খাদ্যের জন্য। এই কথা শুনে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক খেকশিয়াল বলল, তাহলে আমরা কি খেয়ে বাঁচব বাঘাজী? বাঘাজী বলল, কাল থেকে মাংসাশী প্রানীরা ঘাস খাবে, ঘাস।

এই কথা শুনে ছাগল ম্যাঁ-ম্যাঁ করে উঠে দুঃখ করে বলল, সবাই যদি ঘাস খায়, তাহলে বনের ঘাস একসময় ফুরিয়ে গিয়ে ডাইনোসরের মতো পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যাবে! একথায় টিকটিকি ঠিক-ঠিক করে গাছের ডাল থেকে সমর্থন জানাল। বাঘ কিছু না বলতে পেরে, কি যেন একটু ভেবে নিয়ে বলল, সময় নেই। তারপর হাতি এল বিরাট দেহটাকে একবার এদিক একবার ওদিক হেলিয়ে দুলিয়ে কুলোর মতো কানদুটো নাড়াতে-নাড়াতে শুঁড় তুলে বলল, মনে রাখবেন, ''হিংসা পরম ধর্ম'' মেনে চললে সর্বনাশ। এই কথা শেষ হতে না হতেই গরু ''হাম্বা'' ডেকে হাতিকে হামবড় বলল। হাতি প্রচণ্ড রেগে গেল। সে গরুকে বলল, কেন তুই আমার এত বড়ো কথা বললি। গরু বলল, কথাটা সম্পূর্ণ ভুল ছিল।

কথায় কথায় যখন ঝগড়া বেধে যাচ্ছিল। তখন গাধা জানায় এটা শান্তি বৈঠক ঝগড়া চলবে না। এই বলে দুজনকে চুপ করতে বলে আরম্ভ করল, হাতি বন্ধুর কথাটা একটু ভুল ছিল। সংশোধন করলে এইভাবে যে ''অহিংসা পরম ধর্ম''

এদিকে ভাল্লুক আর হায়নাদের চোখের সামনে মোটা-মোটা নাদুস-নুদুস ইঁদুর আর বিড়াল। দেখে লোভে জিভ লকলক করে এল। তাদের বড়ো খিদেও পেয়েছে। তারা সমস্বরে গাধাকে বলল, ছাড়ুন তো মশাই আপনার ধর্ম-কর্ম। এখন বলুন আমরা কি খাব।

-যে সকল বনবাসী এই শান্তি সম্মেলনে আসেনি তারা আমাদের শত্রু, সুতরাং তাদের খাওয়া হবে। যেমন মাংসাশী প্রাণী, ছোটো ছোটো প্রাণীদের যেমন, মাছ, কাঁকড়া আর বিভিন্ন ধরনের পোকা খাবে। আর তৃণভোজী প্রাণীরা যেমন  ঘাস গাছের পাতা খেত, তাই খাবে।

চমৎকার বক্তৃতা চারিদিকে হাততালি পড়ে গেল। উৎসাহে গাধার শরীর ফুলে পাঁজা হয়ে গেল। সে তখনই উঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবল আমাকে সবাই বোকা ভাবে। কিন্তু আমি মোটেই বোকা নই মহাজ্ঞানী আমি। না হলে সবাই যে কাজ পারল না আমি তা করলাম। গাধা আবার শুরু করল, সবাই নড়েচড়ে বসল। সভা জমে উঠেছে।

এদিকে ঝিঁ-ঝিঁ পোকা, জোনাকি পাশের ঝোপ থেকে আগাগোড়া শুনছিল। তাদের আমন্ত্রণ করা হয়নি বলেই, তারা বড়োদের সামনে আসেনি। গাধার এই ঘোষণায় সমস্ত পোকারাই ভয় পেয়ে ছুটে গেল সিংহ মামার কাছে। তারপর কেঁদে কেঁদে বিস্তারিত বলল। সিংহাসনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। আমাকে না জানিয়ে সভা করা দেখাচ্ছি মজা। এই বলে পোকাদের পরামর্শ দিল, তোমরা গিয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দাও, আমি যাচ্ছি।

পোকাদের চিৎকারে যখন সভার কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল না, হঠাৎ বিরাট এক গর্জনে বন কেঁপে উঠল। সবাই গেলো চমকে। গাধার মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগের কথা, তাকে খাবে বলে সিংহ সেদিন এমন দৌড় করিয়েছিল যে, সেদিনের কাটা পা এখনও ভালোভাবে সারেনি। হাওয়া খারাপ দেখে এক লাফ দিয়ে ঢিবি থেকে নেমে সে পালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু যাবে কোথায়, চতুর্দিকে তো সভার সদস্যরা বসে। গাধার ভাবগতি দেখে তারাও পালাতে চেষ্টা করল। শুরু হল পালানোর প্রতিযোগিতা। এ-ওর গায়ে, এ-ওর ঘাড়ে, হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে গেল। কে কোথায় ছুট মারল তার ইয়ত্তা নেই। এদিকে গাধা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়ে পড়ল, এক জল-কাদার মাঝে। একে পায়ের ব্যথায় খোঁড়া, তার উপর পা গেছে গেড়ে। সে কোন দিকে পালাতে না পেরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলতে থাকল, বাবা-গো মা-গো আমি কিছু জানি না গো। তারপর অনেক কষ্টে কোনোমতে কাদা থেকে উঠে ছুটে পালাল। গাধার ভুল সিদ্ধান্ত থেকে সে বুঝতে পারল, সত্যিই সে বোকা।

বন্য জন্তুদের আর সভ্য হওয়া হল না।

 

অলংকরণ- অমর লাহা

প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শরৎ ১৪১৬

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ