![]() |
আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগেকার কথা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ। সে সময় ইউরোপের সম্ভ্রান্ত বংশীয়দের কাছে ক্রীতদাস রাখা ছিল একটা শখের ব্যাপার। এদের কাছে ক্রীতদাসেরা থাকত বাড়ির আর পাঁচটা পোষা জন্তু-জানোয়ারের মতোই। কাজের একটু এদিক-ওদিক হবার জো নেই, হলেই পিঠে পড়ত চাবুক, পিঠ ফেটে রক্ত বেরিয়ে এলেও ক্রীতদাসকে তা মুখ বুজে সহ্য করতে হত। তাকে যে পয়সার বিনিময়ে কেনা হয়েছে, একথা মুহূর্তের জন্যেও তাদের মনিবরা তাদের ভুলতে দিত না। তবে সবাই যে একইরকমের নিষ্ঠুর প্রকৃতির মনিব হত, তা কিন্তু নয়, দু-একজন আবার খুব ভালোও হত। আর সেই সব ভালো মনিবদের কৃপায়, দয়ায় কখনো কখনো এই সব ক্রীতদাসেরা মুক্তিও পেয়ে যেত।
এই ইউরোপেরই এক বিখ্যাত দেশ গ্রীস আর সেই গ্রীসেরই একটা ছোট্ট দ্বীপ সামোস। এই সামোস দ্বীপেই বাস করেন মিঃ জ্যানমাস আর মিঃ ইয়াদমন। দুজনেই সম্ভ্রান্ত বংশীয়, তাই ক্রীতদাস রাখা তাদের মতে খুবই স্বাভাবিক। মিঃ জ্যানমাসের ঘরে থাকে একজন ক্রীতদাস। বয়স অল্প, দেখতে খুবই কুৎসিত, দেহও বিকলাঙ্গ উপরন্তু কথাও বলে তুতলিয়ে। কিন্তু এত দৈহিক প্রতিবন্ধকতা সত্বেও তার বুদ্ধি ছিল প্রখর আর বিচারশক্তি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তার একটা গুণ ছিল। জন্তু-জানোয়ারদের নিয়ে বানিয়ে-বানিয়ে গল্প বলতে পারত সে। কিন্তু যে বাড়িতে সে থাকত সেই বাড়ির মনিবের কাছে তার এই সমস্ত গুণের কোনো কদরই ছিল না। সারাদিন কি কঠিন পরিশ্রমটাই না করতে হত তাকে। দিনের শেষে ক্লান্ত হয়ে যখন কোথাও বসত তখন তার মনটাও ভীষণ খারাপ হয়ে যেত। আর যে ভালো লাগে না এই পরিবেশ। কিন্তু উপায় যে নেই, মনিব না ছাড়লে সে ছেড়ে যাবেই বা কি করে। সমস্ত মনপ্রাণ বিষিয়ে ওঠে, বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, একসময় ভাবে কোথাও পালিয়ে যাবে। কিন্তু তাতেই বা মুক্তি কোথায় ? যদি ধরা পড়ে যায়, সে যে ভয়ঙ্কর শাস্তি। সে শাস্তির কথা মনে হলেই আবার মনে-মনে শিউরে ওঠে তরুণ ক্রীতদাসটি। কখনো ক্রীতদাসটি বসে-বসে ভাবে, কতজনের কাছেই তো শোনা যায় কত দয়াবান মনিবের কথা। এরকম কোনো দয়াবান মনিব যদি তার কপালে জুটত, তাহলে হয়তো সে তার গুণের কদর পেত। কারণ সে তো জানে যে তার গল্প শুনতে ছোটো-ছোটো ছেলে-মেয়েরা কি পছন্দই না করে। সে শুধু ভাবে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। কিন্তু ভেবে কোনো কূল-কিনারা পায় না।
হঠাৎই একদিন এসে গেল সুযোগ। ভগবান বোধহয় মুখ তুলে চাইলেন। তার মনিব মিঃ জ্যানমাস তার কাজে একটুও সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাই বিরক্ত হয়ে একদিন তাকে বিক্রী করে দিলেন ওই দ্বীপেরই আরেকজন সম্ভ্রান্তবংশীয় বাসিন্দা মিঃ ইয়াদমনের কাছে।
ইয়াদমন মানুষ হিসেবে ছিলেন ভীষণ ভালো। তিনি ক্রীতদাসটার কাজে খুবই খুশি হলেন। আর শুধু খুশিই হলেন না; লেখাপড়ার ইচ্ছে আছে দেখে তার লেখাপড়ার একটা ব্যবস্থাও করে দিলেন। এযে সুবর্ণসুযোগ। তরুণ ক্রীতদাসটি তো আনন্দে আত্মহারা। সে তো ভাবতেই পারেনি যে কোনোদিন এমন সুযোগ তার জীবনে কখনো আসতে পারে। সে জানে সে আসলে ক্রীতদাস। ক্রীতদাসদের কোনো সখ-সৌখিনতা থাকতে নেই, ওসব তাদের জন্য নয়। তবু তার জীবনে এমন সুযোগ যখন এলো, একি কেউ হাতছাড়া করে ? তাই একটু সময় নষ্ট না করে প্রথমেই পড়াশুনোর কাজে লেগে গেল সে। আগেই বলেছি, ক্রীতদাসটির বিচার বুদ্ধি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, তাই খুব তাড়াতাড়ি লেখাপড়া শিখে ফেলল সে। আর সেই সঙ্গে একটা ভীষণ ভালো কাজও পেয়ে গেল। প্রতিদিন বিকেলে কাজের শেষে পথের ধারে বসে ঐ দ্বীপেরই ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের গল্প শোনানো। আর এই গল্প ব্যাপারে চিরকালই সে খুব পটু। ছোটো ছোটো তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে পশুপাখী জন্তুজানোয়ারদের জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে চমৎকার জমিয়ে গল্প বলত সে। তাই অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার গল্প শোনার জন্য ছেলেমেয়েদের ভীড় বাড়তে লাগল, আর সেই সঙ্গে তার নামও ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। সকলেই তার গল্পের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এদিকে তরুণ ক্রীতদাসটির জীবনে ঘটে গেল আরও একটি ঘটনা। তার মনিব কিছুদিনের জন্য ব্যবসার প্রয়োজনে একটা দূরের দেশে যাত্রা করলেন। সঙ্গে নিলেন কিছু খাবার-দাবার, ব্যবসার কাজে লাগে এমন কিছু জিনিসপত্র আর সেই সঙ্গে নিলেন... ব্যবহার যোগ্য কিছু বিছানা, জামাকাপড় ইত্যাদি। মনিবের সঙ্গে যাচ্ছে আরো কয়েকজন ক্রীতদাস। মোট হয়েছে বেশ কয়েকটা। তার মধ্যে একটা মোট আবার সব থেকে ভারী, কারণ ওটাতেই রয়েছে বেশ কয়েকদিনের খাবার-দাবার। ভারী দেখে কোনো ক্রীতদাসই ওটার দিকে গেল না, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার তরুণ ক্রীতদাসটি কোনো কথা না বলে ঐ ভারী বোঝাটাই তুলে নিল মাথায়। অন্যান্য ক্রীতদাসেরা আড়ালে তার এই বোকামী দেখে হাসাহাসি শুরু করল।
যাইহোক, যাত্রা শুরু হল। সমস্ত ক্রীতদাসের মাথাতেই বোঝা। সকলেই বোঝা মাথায় হেঁটে চলেছে। তরুণ ক্রীতদাসটি বোঝার ভারে যতই পিছিয়ে পড়তে লাগল, অন্যান্য ক্রীতদাসেরা ততই তাকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। তরুণ ক্রীতদাসটি কিন্তু তাদের এই ঠাট্টা বিদ্রুপের উত্তরে কিছুই বলল না- নীরবে বোঝা মাথায় নিয়ে হেঁটে চলল। আসল ব্যাপারটা কিন্তু ধরা পড়ল কদিন বাদেই। তরুণটির কাছে ছিল খাবারের বোঝা যতদিন যেতে লাগল খাবার খাওয়া হতে হতে বোঝাও ততই হালকা হতে থাকল। ফলে পথ চলার পরিশ্রমে যখন অনেকের বোঝাগুলি হয়ে উঠেছে আরও ভারী তখন তরুণটির বোঝা অনেক হালকা। পথ চলায় বা বোঝা বইতে তখন আর কোনো অসুবিধাই নেই। এতদিন অন্যান্য যে সমস্ত ক্রীতদাসেরা তাকে বোকা মনে করে ঠাট্টা-রসিকতা করত, এবার তারা নীরবে ভারী বোঝা বইবার চালাকিটা ধরে ফেলে নিজেরাই বেবাক বোকা বনে গেছে।
মনিব কিন্তু তার এই উপস্থিত বুদ্ধি দেখে খুবই খুশি হলেন। আরো খুশি হলেন ফিরে এসে যখন তার গল্প বলার প্রশংসার কথা তাঁর কানে গেল।
ইয়াদমন মানুষতো খুবই ভালো। তিনি সত্যিকারের গুণীকে সম্মান দিতে জানেন। একদিন তিনি তরুণ ক্রীতদাসকে ডাকলেন নিজের কাছে। জানালেন তাকে তাঁর খুশির কথা। আশীর্বাদ করলেন প্রাণ ভরে আর সেই দিন তাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে দিলেন চিরকালের জন্য। বললেন, আমি চাই তুমি আরও বড়ো হয়ে ওঠো।
ক্রীতদাসটা কোনো কথা বলতে পারল না। তার দুটো চোখ তখন জলে ভরে উঠেছে, মনিবের প্রতি কৃতজ্ঞতায় আর মুক্তির আনন্দে।
এটা যে সময়ের ঘটনা, সেই সময় কোনো
ক্রীতদাস দাসত্ব থেকে মুক্তি পেলে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে খুব সম্মানের সঙ্গে
ফিরে আসতে পারত। তরুণটিও তাই সমাজ জীবনে ফিরে আসা নিয়ে কোনো কথা ছিল না। সে মুক্তি
পেয়েই ফিরে এল তার পুরোনো স্বাভাবিক জীবনে। ফিরে এসে তার প্রথম কাজ হল নিজের জ্ঞান
ভাণ্ডারকে বাড়িয়ে তোলা। সেজন্য সে আর দেরি না করে বেরিয়ে পড়ল দেশ-বিদেশ ভ্রমণ
করতে। এইভাবে নানা দেশে ঘুরতে ঘুরতে কত মানুষের সঙ্গে হল তার পরিচয়, নানা রকমের জীবন দেখতে পেল সে। এর ফলে তার লাভও
হল খুব, বেড়ে উঠল তার
জ্ঞান ভাণ্ডার।
এমনি করে দেশ-বিদেশ ঘুরতে ঘুরতেই একসময় সে হাজির হল লিডিয়ার রাজধানী সার্ডিস-এ। লিডিয়ারাজ ক্রীসাস তার ক্ষুরধার বুদ্ধি ও উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগের শক্তিতে মুগ্ধ হয়ে তাকে তাঁর দেশে পাকাপাকিভাবে থেকে যেতে অনুরোধ জানালেন। এই জ্ঞানলাভে উৎসাহী রাজার অনুরোধ সে কিছুতেই ঠেলতে পারল না, তাই শেষ পর্যন্ত সার্ভিসেরই বাসিন্দা হয়ে গেল সে।
শুধু যে বাস করতে লাগল- তাই নয়, রাজার কাজেও লেগে গেল সে। রাজা নানা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের জন্য আসতেন তাঁর কাছে। আর যে তবে তীক্ষ্ণবুদ্ধি ও সূক্ষ্মবিচার করবার ক্ষমতা দিয়ে সে সমস্ত সমস্যার সামাধানের পথ বাতলে দিত। এইভাবে কখনও গল্প বলে, কখনও নানা কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করে তার দিনগুলি খুব সুন্দর কেটে যাচ্ছিল। আর এইসঙ্গে দিনে-দিনে সুনামও হচ্ছিলও রাজ্যজোড়া। একবার তো শুধুমাত্র গল্প বলেই জনতার সঙ্গে শাসকদলের বিরোধ মিটিয়ে দিল সে, ফলে সেখানেও পেল ভূয়সী প্রশংসা। এই কাহিনিটিরই পরে কাব্যরূপ দেন গ্রীসের বিখ্যাত দার্শনিক ও কবি সক্রেটিস।
দিন যায় এইভাবেই, নানা খ্যাতির মধ্যে যুবক ক্রমে প্রৌঢ় হয় আর গল্প বলায় হয়ে ওঠে এক খ্যাতিমান পুরুষ।
এতক্ষণ যাঁর জীবনের কাহিনি তোমাদের শোনালাম, তিনি কে জান ? তিনি আর কেউ নন, তিনি হলেন গ্রীক সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ কিংবদন্তীর নায়ক ঈশপ (Aesop)। ঈশপের গল্প পড়েনি, বাংলাদেশে এমন ছেলেমেয়ে প্রায় নেই বললেই চলে। যেমন গ্রীক সাহিত্যে তাঁর স্থান জ্যোতিষ্কের মতোই উজ্জ্বল, তেমনি সারা পৃথিবীর ছেলেমেদের কাছেও তিনি অমর হয়ে আছেন।
এইরকম একজন মানুষ অথচ তাঁর জীবন সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু জানা যায় না। যেটুকু জানা গেছে তার প্রায় সবকিছুই নানা কিংবদন্তীকে ভিত্তি করে। একজন ঐতিহাসিক, নাম হেরোডোটাস, তিনি বলেন, ঈশপের জন্ম ষষ্ঠশতাব্দীর শেষ ভাগে। এরকম আরো নানামত, নানা কথা তাঁর জীবন সম্পর্কে আজও চলে আসছে। শুধু জীবনই বা কেন তাঁর মৃত্যু, মৃত্যু নিয়েও কি কম মতভেদ, কত মনীষী কত জনের মতই না প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ বলেন, রাজা ক্রীসাস তাঁকে প্রচুর ধনসম্পত্তি দিয়ে ডেলকাই অঞ্চলে পাঠান সেখানকার সাধারণ লোকের মধ্যে তা বিলিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু তিনি সেখানে গিয়ে দেখলেন সেখানকার লোকেরা ভীষণ লোভী। দেখে তিনি খুবই দুঃখ পান, তাই তাদের কিছু না দিয়ে ধনসম্পত্তি তিনি আবার রাজাকে ফিরিয়ে দেন। এতে ডেলকাই-এর লোকেরা ঈশপের উপর ভয়ঙ্কয় রেগে যায় এবং তাঁর বিরুদ্ধে অ্যাপেলো দেবতার মন্দির থেকে স্বর্ণপাত্র চুরির অভিযোগ আনে, বিচারে তার প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়। আর সেই আদেশের ভিত্তিতেই তাঁকে একটি পাহাড়ের মাথায় নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে নীচে ফেলে তাঁকে হত্যা করা হয়।
গ্রীস দেশের ভ্রান্তি বিশ্বাস, ঈশপ নাকি মৃত্যুর পরে পূনর্জীবন লাভ করেন আর থার্মোপাইলের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ঈশপের মৃত্যুর প্রায় দুশো বছর পরে এথেন্সের বিখ্যাত ভাস্কর লাইসিপ্পাস (Lysippus) তাঁর একটি মূর্তি খোদাই করেন এবং সেই মূর্তিটিকে ক্রীসাসের সভার সন্ত-মনীষীর মূর্তির সামনে রাখা হয়। তবে সেই মূর্তি দেখে কিন্তু বোঝা যায় না যে ঈশপের চেহারায় কোনো বিকৃতি ছিল।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- চিরকালের ছেলেবেলা । ডিসেম্বর ২০১২
0 মন্তব্যসমূহ