![]() |
ভ্যান থেকে নামতেই ঋজুর চোখ গেল গেটের সামনে পড়ে থাকা একটি পাথর খণ্ডে। দুপুরের রোদে ওর ফর্সা গাল লাল হয়ে আছে। ওইটুকু ভ্যান-রিকশায় দশ-বারোটি বাচ্চার গাদাগাদি ভিড়ে কাহিল অবস্থা। তবুও বয়স তিন বছর পার হতে না হতেই শিক্ষার চাপে ওরা চিড়েচ্যাপ্টা। সাঁতার, ছবি আঁকা, গাদাগাদি স্কুল গাড়ি সব মিলে ওদের বিধ্বস্ত শৈশব। আয়ামাসি চন্দ্রা চিৎকার করে উঠল- কি নিলে হাতে ঋজু, ফ্যালো।
কিছু না, একটা পাথর।
চন্দ্রার চোখে পড়ল সাদা পাথর খণ্ডটা। কথা বাড়াতে ইচ্ছে করল না তার। ঋজুর বাবা-মা দুজনেই স্কুলে গেছে। চন্দ্রা ডান হাতে তুলে নিয়েছে ঋজুর কাঁধের বইয়ের ভারী ব্যাগ। হাত টনটন করছে ওর। তবুও বাম হাতে মেলে ধরেছে দরজা। ঋজু ঢুকে গেল ঘরে। সেগুন কাঠের সুদৃশ্য দ্বার পেরিয়ে রুচিসম্মত গোজগাছ করা ড্রয়িং রুম। বীথিকার ঘরসজ্জায় এলেম আছে। ইন্টেরিয়র ডেকোরেটিং-এর কোনো পাঠ তার নেওয়া না থাকলেও প্রফেশনাল ডেকোরেটরদেরও চক্ষু ছানাবড়া করা তার কাছে জলভাত। আসলে বীথিকার চোখ বড়ো ধারালো। সামান্য সামান্য জিনিসও তার ঘরসজ্জার কাজে ব্যবহারের গুনে অসামান্য হয়ে ওঠে। ড্রইং রুমে ঢুকতেই ডানদিকের সেল্ফে সুন্দর করে সাজানো অজস্র শো-পিস। তারপর ডানে-বাঁয়ে কাচের শোকেস। একটিতে ভরা কক্ষনো না পড়া বিদেশি সাহিত্যের সম্ভার। অন্যটিতে অজস্র দামি পুতুল আর বাবা অরিন্দম, মা বীথিকার নামে চালানো বাজার থেকে কেনা বিভিন্ন আকারের প্রচুর ধাতব মেমেন্টো। ওগুলো দেখে ঋজু অনুপ্রাণিত হবে সমস্ত প্রতিযোগিতায় প্রথম হতে। চার বছরের ঋজু আজও প্রতিযোগিতা কি- বুঝতে শেখেনি। ঋজুর প্রিয় বস্তু গাড়ি। দিনভর ওর গাড়ি নিয়ে স্বপ্ন দেখা। পথের সব গাড়ি ওর। বড়ো হয়ে সে ড্রাইভার হতে চায়, বড়ো ট্রাকের ড্রাইভার। অরিন্দম-বীথিকার কাছে এটা বড়ো লজ্জার, বড়ো বেদনার।
মোবাইল বাজছে। এরই মধ্যে কানে ধরেছে চন্দ্রা। বীথিকার উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর- ঋজু এসেছে চন্দ্রা?
এই তো এল।
চন্দ্রার কথায় যেন স্বস্তির হাঁফ ছাড়ল বীথিকা। চন্দ্রা জিজ্ঞেস করল, কেন কি হয়েছে ম্যাডাম?
বাইরে গন্ডগোল। কাল বর্ধমানের কোথায় যেন কি হয়েছে, আজ চারিদিকে মহাগন্ডগোল। অবরোধ, গাড়ি-ঘোড়া ভাঙচুর।
তোমরা পৌঁছেছ তো?
এই এতক্ষণে-।
কথা শেষ হতে না হতেই ঋজুর হাতের পাথরটি আছড়ে পড়ল কাচের শোকেসে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাচ। ঋজু হাতে তুলে নিচ্ছে একেকটি শো-পিস, মেমেন্টো। ছুঁড়ছে এদিক-ওদিক। একে-একে ভেঙে পড়ছে চারিদিকের ভঙ্গুর আসবাবপত্র, জানলার কাচ। চিৎকার করে সামলাতে গেল চন্দ্রা ঋজুকে। কাচের টুকরো লেগে গেল চন্দ্রার পায়ে। রক্ত ঝরছে গলগলিয়ে। আর্তনাদ করে উঠল চন্দ্রা। ওপার থেকে বীথিকা অসহায় ভাবে শুনতে পাচ্ছে ঘরে কিছু অনাসৃষ্টি ঘটছে। ঋজুর আরো একটি ঢিল গিয়ে লাগল ডাইনিং টেবিলে। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল ডাইনিং টেবিলের সুদৃশ্য কাচ, খাবার-দাবার রাখা বাসনপত্রসহ। ঋজু এবার ভয় পেয়ে চুপ মেরে গেছে। চন্দ্রার পায়ে রক্ত ঝরছে, কঁকিয়ে চলছে। পাশে পড়ে আছে টেলিফোন। ঋজু হাতে নিল সেটি। ধীরে ধীরে কানে তুলে ভয়ে ভয়ে কেঁদে বলল, হ্যালো মা।
মা চিৎকার করছে উৎকণ্ঠায়, কী হয়েছে ঋজু? মাসি চিৎকার করছে কেন? কিসের এত শব্দ ঘরে?
ঋজু কেঁদে-কেঁদেই উত্তর দিল, আমার গাড়িগুলো ওরা ভেঙে দিল রাস্তায় পাথর দিয়ে। আমিও সব ভেঙে দিলাম, আমার পুতুল, আমার ঘর।
বলতে বলতে কান্নার দমক বেড়ে গেল শিশুটির। তবুও সে বলছে, ওরা সবার রক্ত বের করে দিয়েছে, আমিও মাসির রক্ত বের করে দিয়েছি।
ফোনের ওপার থেকে বুঝতে পারছে বীথিকা তার শিশুসন্তানের ভেতরে অদম্য ভাঙচুর। স্কুলে আসার পথে ওই বর্বরতা দেখেছে বীথিকাও। ভাঙ্গা গলায় মা বলল, তুমি শান্ত হও বাবা, তোমার জন্য অনেক গাড়ি আনব, একতলা বাস, দোতলা বাস, তিনতলা বাস, অনেক। তুমি চালাবে সব। কেউ ভাঙতে পারবে না আর।
ঋজু বলল কেঁদে কেঁদে, গাড়ি চাই না, তোমরা ফিরে এসো এক্ষুণি। ওরা তোমাদেরও মারবে।
ওর পরের কথাগুলো কান্নার দমকে হারিয়ে গেল, কিছু বোঝা গেল না আর, ভাঙচুর ছাড়া।
অলংকরণ- অমর লাহা
প্রকাশিত- ছেলেবেলা । শারদীয়া ১৪১৬
Topic : The story of feeling in
Bengali
0 মন্তব্যসমূহ